জাল

 প্রকাশিত: ২০২০-০৪-২২ ১৫:২৬:০৭

 আপডেট: ২০২০-০৪-২২ ১৫:৩০:১০

শ্যামল কান্তি ধর:

এ গ্রামে প্রায় প্রতি বর্ষায় বন্যা হয়। গ্রামবাসীরা তাই প্রস্তুত থাকে। সবুজ ধান যখন একটু একটু করে হলুদ হতে শুরু করে, তখন একদিন সকালে ঘুমভাঙা মানুষ দেখে আধপাকা ধান পানির নিচে। তাদের মন খারাপ হলেও হতাশ হয় না। পুকুরে ডুবানো নৌকা তখন ভাসানো হয় বন্যার পানিতে। পানির নিচের ধান কাটার কষ্টকর কৌশল তাদের জানা। সারা দিন চলে যায় পানির নিচের ধান কাটায়। ছোট ছোট শামুক লেগে থাকে তাতে। এগুলো ছাড়িয়ে ধান আলাদা করাটাই অনেক কষ্টের। তবু তারা ধান বাছাই করে ব্যবহার উপযোগী করে তুলে। দিন যায়, বৃষ্টি বাড়ে। সাথে বাড়ে বন্যার পানি। এ পানি ছুঁয়ে যায় কারো কারো বাড়ির উঠান পর্যন্ত। তখন নৌকাই যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম হয়ে যায়। যাদের নৌকা নেই তারা কলাগাছ কেটে তৈরি করে ভেলা। যারা তাও পারে না, কোমর পর্যন্ত পানি চিরেও হেঁটে পৌঁছে যায় গন্তব্যে। প্রায় তিন মাস পানিবন্দি থাকতে হয় তাদের। গ্রামবাসীদের হাতে তখন কোন কাজ থাকেনা। গৃহস্থরা তাদের গৃহপালিত পশুদের খাদ্য নিয়ে বেশ সমস্যায় পড়ে যান। পশুখাদ্যের অভাব দেখা দেয়। জমিয়ে রাখা খড় এবং বন্যার পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানাই তখন একমাত্র খাদ্য। তবে বন্যা শুধু কেড়েই নেয় না, গ্রামবাসীর জন্য নিয়ে আসে প্রচুর অবসর। আর নিয়ে আসে বিচিত্র সব মাছের সমাহার।

এ গ্রামের নাম রূপাপুর। বন্যার এই সময় গ্রামের মানুষ অবসর সময় কাটায় মাছ ধরে, গ্রামীণ আড্ডায়। ছোট ছোট নৌকা নিয়ে তখন যেন তারা জলসখা। তবে এ গ্রামে মাছধরা অনেকের কাছে কেবল অবসরের বিনোদন হলেও, কারো কারো কাছে তা জীবিকার অবলম্বনও হয়ে উঠে। অনেক দুরের মানুষও চলে আসে বন্যা কবলিত এ গ্রামে। তাদেরই দুজন নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিন। তারা প্রথম যেদিন এ গ্রামে আসে, গ্রামবাসীর প্রবল বাধার মুখে পড়ে। তাদের দাবি এ গ্রামের পানিতে মাছ ধরা যাবে না। এই এলাকার মাছের অধিকার একমাত্র তাদের। পরে এ বলে দফারফা হয় যে, তারা মাছ ধরতে পারবে তবে আগে মাছ বিক্রি করতে হবে এই গ্রামে। এখানে বিক্রি করার পর যা থাকবে তা তারা বাজারে নিয়ে যেতে পারবে। নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিন তাতে নীরবে রাজি হয়ে যায়। তবে এই ভেবে ভয় পায় যে এখানে মাছ বিক্রি করলে হয়তো দামে ঠকতে হবে। তবু রাজি হয় এই ভেবে যে গ্রামবাসীরা তো তাদের কাছে বিনে পয়সায় মাছ চাইতে পারত। তাতো চায়নি।

বিজ্ঞাপন

তার পরদিন থেকেই শুরু হল টানা বৃষ্টি।রাতে কয়েক ঘণ্টার বিরতি। বাকি সময় সবাই বৃষ্টিভেজা সময় কাটায়। নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিনের নৌকাটির উপরে বাঁশের তৈরি বেতের ছাউনি দেয়া। গ্রামের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ আজমল বখত এর বাড়ীর নিকটেই তাদের অস্থায়ী নিবাস।বর্ষার বৃষ্টি নিয়ে এসেছে শীতকালের হিমেল বাতাসের আমেজ। তারা দুজন এখন ছাউনির ভেতর ঘুমিয়ে কাটাচ্ছে। ঘুমানোর জন্য নৌকায় রয়েছে একটি মাদুর, দুটো বালিশ ও দুটো কাঁথা। সবাই দেখল এই বৃষ্টিতে তারা ঘুমিয়েই কাটাচ্ছে।তখন নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিন মনে মনে হাসে। কারণ তারা রাতে মাছ ধরে, যখন গ্রামবাসীরা গভীর ঘুমে। এই ফাঁকি দিতে পেরে তারা খুব আরাম বোধ করে। ভোর হবার আগেই তারা চলে যায় নন্দপুর বাজারে। বেশ চড়া দামে মাছগুলো বিক্রি হয়ে যায় বেপারিদের কাছে। প্রয়োজনীয় চাল, ডাল কিনে বাকী টাকা তারা রেখে আসে বাজারের এক বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীর কাছে। সবাই জেগে ওঠার আগেই তারা চলে আসে। নৌকায় রান্নার কাজ সাধারণত কফিলউদ্দিন করে। নেছার মিয়া তখন জমানো টাকার হিসেব করে। আর দুটো মাস এখানে থাকতে পারলে মেয়ের বিয়ের জন্য কিছু টাকা সঞ্চয় করা যাবে। বেশ ভালো একটা ছেলের আলাপ কয়েক মাস ধরে চলছে।রান্না শেষ হয়ে গেলে তারা খেয়ে দেয়ে দিনব্যাপী ঘুমের আয়োজন করে। সারা রাতের বিরামহীন পরিশ্রমে ক্লান্ত শরীর তখন আরও অবশ হয়। সারা শরীরে পৌঁছে যায় ঘুমের নিমন্ত্রণ।শীতল মাদুরে কাঁথা গায়ে দিয়ে বালিশে যখন তারা মাথা রাখে তখন নৌকার দুলুনির সাথে বৃষ্টির রিমঝিম ঘুমের এক মিষ্টি ছন্দ এনে দেয়।


কয়েকদিনের টানা বৃষ্টির পর গ্রামবাসীদের একসাথে জড়ো হবার সুযোগ মিলেছে। চারিদিকে অথৈ পানি। এতটুকু ভাসমান মাটির দেখা মেলা দায়। আজমল বখত এর বাড়ি একটু উঁচুতে হওয়ায় এখনো উঠান পানিবন্দি হয়নি। আজ তার বাড়ির ঘাটে কয়েকটি নৌকা। সন্ধ্যায় হারিকেনের মৃদু আলো জ্বালিয়ে নৌকাতে বসেই সবাই গল্পের পসরা সাজায়। বেশীরভাগ গল্পই অলৌকিক রহস্যময়তায় আবৃত। পুবপাড়ার হরিদাস শুনায় এক “দেওলা”র গল্প। “দেওলার” গল্প এ গ্রামে খুব প্রচলিত। লোকমুখে প্রচলিত এই যে, অনেক প্রাচীন মাছ বড় হতে হতে একসময় দেওলা হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের পরের বছর হরিদাস এই রকম এক দেওলার দেখা পেয়েছিল। নিশীথ রাতে “আলো শিকারে” গিয়ে এক চিতলের পেছনে ছুটতে ছুটতে দেখা গেল এটা একটা দেওলা।পরের দিন থেকে হরিদাসের সারা শরীরে ব্যথা, জ্বর ও রক্তবমি শুরু হয়। পরে বীরেন ওজার চিকিৎসায় মুক্তি মেলে। কোনাবাড়ির জলিল মিয়া জানায়, গাঙ পারের বাঁকা গাছটি আরও বাঁকা হচ্ছে। জলিল মিয়ার কাছ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে পরেশ নাথ শোনায়, এক অমাবস্যার রাতে বাঁকা গাছটির ডাকের এক গা ছমছম কাহিনী। একে একে সবাই কোন না কোন রহস্যময়তার গল্প শুনায়।আজমল বখত হুঁকার নলে টান দিতে দিতে আরাম করে বসেন তার হেলান চেয়ারে। এই হুঁকা অনেক পুরনো। সবসময় না হলেও মাঝে মাঝে তিনি হুঁকার নলে টান দিতে পছন্দ করেন। গা ছমছম এ সন্ধ্যায় গল্প বেশ জমে যায়। পুব পাড়ার গোবিন্দকে সবাই গ্রামের সবচেয়ে নীরব ধূর্ত হিসাবে জানে। সে কথা বলে কম। কিন্তু কুটচালে খুবই পটু। বেশীর ভাগ সময় সে পান চিবোয়, তাই মুখ সবসময় বিশ্রীরকম ভাবে লাল থাকে। সে বসে ছিল একটি সরু নৌকার গলুইয়ে। হঠাৎ সে কফিলউদ্দিনদের কথা তুলে। সে জানায়, “আমার মনে হয় ঐ দুজন রাতে মাছ ধরে, তাই সারা দিন ঘুমায়।” গ্রামবাসীর কয়েকজনের মুখে চঞ্চলতা দেখা দেয়। গোবিন্দর সামনে বসা ছিল মুদি দোকানদার আব্বাস। সে পেছনে ঘুরে গোবিন্দের কানে কানে কি যেন বলে। গোবিন্দর ধূর্ত চোখ আরও ছোট হয়ে আসে। লুঙ্গির গাঁট থেকে আরেকটি পান বের করে সে মুখে দেয়। একসময় শেষ হয় গল্পের আসর।

বিজ্ঞাপন


আজ আকাশে বিশাল চাঁদ। কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা পেরিয়ে নেমে এসেছে রাতের নিস্তব্ধতা। পাশের গ্রামের পালবাড়ির সন্ধ্যা আরতীর রেশ রয়ে গেছে এখনো। নৌকা থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে মৃদঙ্গের শব্দ। আজ আকাশ পরিস্কার, মেঘমুক্ত নির্ভার। মেঘদলের ছুটোছুটি নেই আগের মত। হালকা হিমেল বাতাসে সৃষ্ট ছোট ছোট ঢেউ মৃদু ঝঙ্কার তুলছে তাদের নৌকায়। গলুইয়ে রান্নার আয়োজন করে কফিলউদ্দিন। পেঁয়াজ কাটতে কাটতে নেছার মিয়ার উদ্দেশে বলে, জালটা বের কর নেছার। আজ খেপ মনে হচ্ছে ভালো হবে। পাটাতনের উপরে মাদুরের উপর উপুড় হয়ে শুয়ে আরাম করছিল নেছার মিয়া। আজ তার শরীর মানছে না। “আজ বাদ দেন চাচাজি”। বয়সে দুজনের খুব বেশী পার্থক্য নেই, তবু নেছার কফিলউদ্দিনকে চাচা বলে সম্বোধন করে। কফিলউদ্দিন চুপচাপ থাকে। নেছার মিয়া একটা বিড়ি ধরিয়ে আয়েশ করে টান দেয় তাতে। চাঁদ ক্রমেই ছড়িয়ে দিচ্ছে তার কমনীয় আলো।পানিতে রূপালী ঢেউ এর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে কফিল উদ্দিন। এ দীর্ঘশ্বাসের কারণ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে তাদের জীবনে। রান্না শেষ করে কফিলউদ্দিন পাটাতনের ভেতর থেকে জাল বের করে আনার জন্য হাত বাড়ায়। নাগাল পায় না। “ও নেছার একটু উঠ, জালটা মনে হয় ভেতরের দিকে আছে”। নেছার মিয়া উঠে বাকী পাটাতন সরিয়ে ফেলে। কিন্তু একী! জাল নেই। “জাল কি ভেতরে ঢুকিয়ে রেখেছিলে নেছার”।কফিল উদ্দিনের মুখে চিন্তার ছাপ। নেছার মিয়া মাথা চুলকায়। ঠিক মনে করতে পারে না। ঝাপ দেয় পানিতে। চারিদিক খুঁজে নেয়। না কোথাও নেই। হতাশ হয় দুজন। জাল হারিয়ে পাগলপ্রায় দুজন নৌকা চালায় আজমল বখতের বাড়ির দিকে। আজমল সাহেব পুরো ঘটনা শুনে বলেন, তোমরা কি কাউকে সন্দেহ করছ? দুজনেই প্রায় একই সাথে বলে, গ্রামের সবাইকে ভালো করে চিনি না, কাকে সন্দেহ করব বলেন?। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে আজমল সাহেব বলেন, ঠিক আছে, কাল সকালে আস। দেখি কি করা যায়। ওরা চলে যাবার পর তিনি মোবাইল কল করেন কাজল মেম্বারকে। সবকিছু শোনে কাজল মেম্বার জানায়, কাল সকালে সে আসবে। কাজল মেম্বার বহুদিন পর একটা বিচারের গন্ধ পায়। হোক ছোট, তবুতো বিচার। “চেয়ারম্যান সাহেবকে কি একটা খবর দেয়া দরকার?” অবশ্য এইসব ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেব আর আসতে চান না কি আশ্চর্য! চেয়ারম্যান সাহেব রাজী হয়ে গেলেন। আজমল বখতকে ব্যাপারটা জানিয়ে দেয় কাজল মেম্বার।


আজমল সাহেবের বাড়ির ঘাটে আজ অনেক নৌকা। পুকুরে উনার নিজস্ব জাল ফেলা হয়েছে। নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিনের উপর দায়িত্ব পড়েছে মাছ ধরার। তাদের মন খারাপ থাকলেও মহা উৎসাহে তারা পানিতে নেমে পড়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব এসেছেন, সাথে আরও দলীয় লোকজন। উঠানের এক কোনে রান্না বান্নার আয়োজন চলছে। রান্না বান্নার তদারকি করছে জলিল মিয়া। দুটো খাসী প্রস্তুত রাখা আছে। আজমল সাহেব অনুমতি দিলেই এগুলোর ব্যবস্থা সে নিমিষেই করে ফেলবে। নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিন দুজনই খুব অবাক ও আনন্দিত, তাদের জাল উদ্ধারের জন্য চেয়ারম্যান সাহেব নিজে উপস্থিত হয়েছেন। গ্রামবাসীদের মাঝে আজ এক উৎসবের আমেজ। পুকুর ঘিরে দাঁড়িয়ে গেছে অনেকেই। কেউ কেউ নেমে পড়েছে নেছার মিয়াদের সাথে মাছ ধরায়। আজমল সাহেবের সাথে চেয়ারম্যান সাহেবের সম্পর্ক অনেক পুরনো। উপজেলায় দুজনের অংশীদারিতে একটা রাইছমিল রয়েছে। বেশ ভালোই চলে। নির্বাচনের সময় আজমল সাহেবের বড় ভূমিকা থাকে, তাই চেয়ারম্যান সাহেব আজমল সাহেবের বাড়িতে আসার উপলক্ষ অবজ্ঞা করতে পারেন না, তা যত ছোট হোক। আর এই গ্রামে বেশীরভাগ মানুষই তার ভোটার। সামনের বছরেই আবার নির্বাচন। আরেকটা উদ্দেশ্যও অবশ্য আছে, তাই আসা।

বিজ্ঞাপন

চেয়ারম্যান ও আজমল সাহেবকে মাঝখানে রেখে গ্রামের কয়েকজন চারিদিকে গোল হয়ে বসে। গ্রামবাসীরা আবার সাজায় গল্পের পসরা। তবে বেশীরভাগই জানে না, নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিনের জাল হারানোর ঘটনা। গল্পের মাঝখানে কাজল মেম্বার তোলে ধরে ঘটনা। অনেকেই অবাক হয়। এদিকে তাদের পুকুরে উৎসাহ নিয়ে মাছ ধরার ঘটনায় বিভ্রান্ত হয় গ্রামবাসীরা। আজমল সাহেব জানতে চান এ বিষয়ে কেউ কিছু জানে কিনা। উপস্থিত সকলেই মাথা নেড়ে বলে, না তারা কেউ কিছু জানেনা।একসময় মাছ ধরা শেষ হয়। ভেজা কাপড় নিয়েই নেছার মিয়া ও কফিলউদ্দিন বসে গ্রামবাসীর সাথে। তারা শুনে গ্রামের অনেক পুরনো গল্প। চেয়ারম্যান গ্রামের অনেক অমীমাংসিত কিছু ঘটনার বর্তমান অবস্থা জানতে চান।


খাবারের আয়োজন বেশ ভালোই হয়েছে। নেছার মিয়া ও কফিলউদ্দিন বেশ তৃপ্তিতেই খেল। তারা এবার কিছু চিন্তামুক্ত, চেয়ারম্যান সাহেব যখন এসেই গেছেন তখন আর চিন্তা নেই।বেশ আয়েশ করেই পান মুখে দেয় কফিল উদ্দিন। খাবার শেষে এখন চলছে পান খাবার আয়োজন। চেয়ারম্যান সাহেব পান মুখে দিয়ে খাবারের বেশ প্রশংসাই করলেন। তার মুখের কাছে হুঁকার নলটা এগিয়ে দিল গোবিন্দ। হুঁকাতে টান দিয়ে কাশতে কাশতে বলেন, “প্রিয় গ্রামবাসী, আগামী মাসের প্রথম শুক্রবার আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ের দিন ধার্য হয়েছে। গ্রামের কেউ যেন বাকী না থাকে”। আজমল সাহেবকে দাওয়াত বুঝিয়ে দিতে দিতে তিনি চলে যাবার প্রস্তুতি নিলেন। তখনই তার চোখ পড়ল নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিনের দিকে। “তোমরা দুজনও যেও” বলে চলে যেতে যেতে আজমল সাহেব ও কাজল মেম্বারের উদ্দেশ্য বললেন, ওদের জালটার ব্যাপারে একটু গুরুত্ব সহকারে দেখবেন। আমাকে এখন একবার ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হবে। ত্রাণের চাল এসেছে।

প্রতিদিন আজমল সাহেবের দিবানিদ্রার অভ্যাস। দুপুরের খাবারের পর তিনি বেশী সময় বসে থাকতে পারেন না। তিনি কাজল মেম্বারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দিবানিদ্রায় গেলেন। কাজল মেম্বার নেছার মিয়া ও কফিলউদ্দিন দুজনকেই ডেকে বলল, “শোন ভাইয়েরা, আজ আমারও একটু ইউনিয়ন পরিষদে যেতে হবে, ত্রাণের বরাদ্দের চালের বস্তা নিয়ে আসতে হবে। তোমরা আজকের রাত একটু অপেক্ষা কর। কালকে ব্যাপারটা নিয়ে আবার বসব।” পাশে বসে থাকা গোবিন্দ ও আব্বাস দুটো দীর্ঘশ্বাস শুনল। তারা জানে এই হারানো জালের গুরুত্ব নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিনের কাছে কতখানি। চেয়ারম্যান, আজমল সাহেব ও কাজল মেম্বারদের কাছে হয়তো অবসর বিনোদনের অংশ, কিন্তু এই জাল তাদের কাছে জীবনের একটা অংশ। হয়তো আবার আজমল সাহেবের বড় উঠানে বসবে বিচার। কিন্তু তাদের জাল প্রাপ্তির বিষয়টা অনিশ্চিতই রয়ে যাবে কিংবা সমাধান হবে কিন্তু তখন বড় দেরী হয়ে যাবে। গোবিন্দ ও আব্বাস দুজন তাকায় দুজনের দিকে।কথা হয়ে যায় চোখে চোখে।

বিজ্ঞাপন


বিকেল বিদায় নিয়েছে সন্ধ্যার কাছে। আকাশ কাঁপিয়ে উড়ে যাচ্ছে এক ঝাঁক বক। নেছার মিয়া ও কফিলউদ্দিনের নৌকা চলছে আরেক অজানার উদ্দেশ্যে। আকাশ ধীরে ধীরে কালো হচ্ছে।বাতাস ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে। এ বাতাস খুবই পরিচিত তাদের কাছে। তুফান আসবে। এরই আগে পৌঁছতে হবে তাদের নতুন কোন গন্তব্যে। নতুন একটা জালের ব্যবস্থা করতে হবে কয়েকদিনের মধ্যেই। কিন্তু কিভাবে করবে তা তাদের এখনো অজানা। নেছার মিয়ার হাতে বৈঠা,কফিল উদ্দিনের হাতে লগি।বাতাস আরও জোরে বইছে। তারা জাল প্রাপ্তির বিষয়টি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর ভরসা রাখতে পারেনি।

তারা জানে না, দূর থেকে আরেকটা নৌকা তাদের অনুসরণ করছে।গোবিন্দ ও আব্বাসের নৌকা। তুফান পূর্ব বাতাসের তোড় আরও জোরে বইছে। গোবিন্দ আরও জোরে চালায় নৌকা, যেভাবেই হোক তাদের তুফানের আগে পৌঁছতে হবে ওদের নৌকার কাছাকাছি। তারা তো জানেনা নেছার মিয়া ও কফিল উদ্দিনের গ্রামের ঠিকানা। ওদের নৌকা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে কিভাবে পৌঁছানো যাবে তাদের জাল। গোবিন্দের বাহুতে আজ অনেক শক্তি, যেভাবেই হোক পৌঁছতে হবে। আকাশ আরও কালো হচ্ছে।

আপনার মন্তব্য