প্রচেষ্টা এবং প্রত্যাশার ফারাক

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২৯ ১৫:৫০:৫৯

 আপডেট: ২০১৬-০১-২৯ ১৬:০১:০১

ফয়সল সাইফ:

ব্যক্তি এবং সমাজ উভয়ের ক্ষেত্রেই সাফল্যকে মোটা দাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়; ছোট এবং বড়। ছোট সাফল্যগুলো সব সময়ই দীর্ঘ যাত্রায় সামনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরণাদায়ক ভূমিকা পালন করে। এবং সেগুলোর প্রভাব একটা নির্দিষ্ট সময়ের পর হারিয়ে যায়। তবে বড় সাফল্যের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।

ব্যক্তি বা সমাজ উভয়ের ক্ষেত্রেই বড় সাফল্য এমন এক জিনিস যা শুয়ে-বসে অর্জন করা যায় না। তার জন্য প্রয়োজন সামগ্রিক প্রচেষ্টার। সামগ্রিক প্রচেষ্টার ঘাটতি সত্ত্বেও ছোটখাটো সাফল্য আসতে পারে। কিন্তু বড় সাফল্যের জন্য উদ্যম, নিষ্ঠা, সততা, আত্মনিবেদন, কর্মস্পৃহা, প্রতিভা, শৃঙ্খলা, সমন্বয়, অনুপ্রাণিত করার গুণ, চিন্তায় অভিনবত্ব, পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য অর্জনের প্রতি অদম্য আকাঙ্ক্ষা থাকা অপরিহার্য। এগুলো ছাড়া কখনোই ব্যক্তি স্টিভ জবস, টমাস আলভা এডিসন বা গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপলের মত প্রতিষ্ঠান বা নরওয়ে, ফিনল্যান্ডের মত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়।

আজ আমরা এমন এক বাংলাদেশে বাস করছি, যেখানে অনেককিছুই নতুন করে শুরু করার বাকি। আবার অনেককিছুই শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু এখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেনি। কিছুকিছু ক্ষেত্রে আমরা সাফল্যের মুখ দেখলেও, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রসর বিশ্বের তুলনায় বেশ পিছিয়ে রয়েছি। এসবের মধ্যে আমাদের সিনেমাশিল্প অন্যতম।

একইভাবে বলা যায় সমগোত্রীয় প্রকাশনাশিল্পের কথাও। উভয়ের পথচলাই এ দেশের প্রেক্ষাপটে পুরনো গল্প। উভয় শিল্পেই বই প্রকাশ বা সিনেমা মুক্তির সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। কিন্তু সেসবের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য যে পাঠক বা দর্শকগণ, তাঁদের কাছে প্রত্যাশামাফিক আবেদন সৃষ্টিতে অক্ষম। ফলে এত বছর পেরিয়ে এসেও দুটো শিল্পই এখনো পায়ের নীচে যথেষ্ট মাটি জমা করতে পারেনি। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মাঝে মাঝেই শিল্প দুটোকে বাঁচিয়ে রাখতে অন্যান্য রুগ্ন খাতের মত সরকারের কাছে কৃপা প্রার্থনা করেন।

তবে সরকারী কৃপা পেলেই যে শিল্প দুটো তরতর করে এগিয়ে যাবে এ ব্যাপারে সন্দেহের যৌক্তিকতা রয়েছে। যদিও সরকারের সহযোগিতা এই শিল্প দুটোর জন্যও অপরিহার্য। এবং তা প্রাপ্যও বটে। কিন্তু দিন শেষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দক্ষতা-যোগ্যতার ওপরই শিল্প দুটোর সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভরশীল। আর এখানেই ঘাটতিটা স্পষ্ট। দুঃখজনক হলেও সত্য আমরা এতকাল পেরিয়ে এসেও ঠিকঠাক দক্ষতা-যোগ্যতার পরিচয় দিতে পারছি না। আর তা পারলে আমরা এতটা পিছিয়েই বা কেন? তবে এর পেছনে দায় যতটা না আমাদের সীমাবদ্ধ সামর্থ্যের, তার চেয়েও বেশি আমাদের গড়ে তোলা ব্যবস্থার।

দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, এ দেশে প্যাঙ্গুয়িন র‍্যানডম হাউজ, ডাবল ডে, ব্লুমসবারি পাবলিশিং, পিয়ারসন, লিটল ব্রাউন এন্ড কোম্পানির মত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বা মারভেল স্টুডিও, টেম্পল হিল এন্টারটেইনমেন্ট, লেজেন্ডারী পিকচার্স, টুয়েন্টিন্থ সেঞ্চুরি ফক্সের মত প্রোডাকশন কোম্পানি গড়ে ওঠেনি। কেন গড়ে ওঠেনি? এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে না ওঠার কারণ কেউ সেভাবে ব্যবসা করতে পারেনি। সেভাবে ব্যবসা করতে না পারার কারণ এখানে সেই ধরণের দর্শক বা পাঠক সমাজ গড়ে ওঠেনি। এবং তা গড়ে না ওঠার কারণ ওই সব প্রতিষ্ঠান যে ধরণের গুণগত মান সম্পন্ন বই বা সিনেমা তাঁর পাঠক-দর্শকদের উপহার দিতে পেরেছে বা পারছে, আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান তা সেভাবে পারছে না।

তাঁরা যেভাবে নিজেদের পণ্যগুলো বাজারজাত করেছে বা করছে, আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান তা পারেনি এবং পারছে না। তাঁরা যে কৌশলে নতুন পাঠক-দর্শক তৈরি করছে বা পুরনোদের ধরে রাখছে, আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান তা পারছে না। এবং তাঁরা যেভাবে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে, আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান তা পারছে না। কারণ তাঁরা যে ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে তাঁদের যাত্রা শুরু করেছিল, সেই ধরনের পরিকল্পনা আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের তখনো ছিল না; এখনো নেই। বরং যে জিনিসটার উপস্থিতি এখানে প্রবল তা হল যেনতেনভাবে টিকে থাকার পন্থা অবলম্বনের স্বতঃস্ফূর্ততা।

সাফল্যের পথে পৌঁছতে একজন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান বা সমাজের পদযাত্রা সব সময়ই একটা সংগ্রামমূখর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শুরু হয়। তখন সবার সামনেই অস্তিত্ব রক্ষার একটা চ্যালেঞ্জ থাকে। সমস্যা হচ্ছে অন্যরা একটা নির্দিষ্ট সময় শেষে তা কাটিয়ে ওঠতে পারলেও আমরা পারছি না। বরং এ সংগ্রাম করে করেই আমরা ক্লান্ত! অথচ আমাদের বাজারটাও কম বড় নয়। পাঠক-দর্শকের সংখ্যায় আমাদের সম্ভাবনাকেও খাটো করে দেখার সুযোগ ছিল না বা এখনো নেই। তারপরও কেন আমরা মুখ থুবড়ে পড়ে আছি? কারণ আমাদের সমাজে মুলা ঝুলিয়ে সুবিধা আদায় করে নেওয়ার মত প্রতিভাবানের সংখ্যা অগণিত।

বিছানায় শুয়ে আকাশের চাঁদ পাওয়ার স্বপ্ন দেখার লোকও নেহাত কম নয়। সহজ শর্তে সরকারী ঋণ পেয়ে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানকে হাতি-ঘোড়া বানিয়ে ফেলবেন, এমন প্রকাশক এদেশে বিরল নন। ভালো কয়েকটা প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান এবং ডিজিটাল প্রজেকশন সহ ভাল পরিবেশের সিনেমা হল পেলেই সিনেমায় দর্শকদের জোয়ার বইয়ে দেবেন, এমন পরিচালকের সংখ্যাও এ দেশে উল্লেখ করার মত। কিন্তু যে জিনিসগুলো থাকা উচিত ছিল অথচ সেভাবে নেই, সেগুলো নিয়ে কাজ করতে পারলেই বরং ইতিবাচক পরিবর্তন নিয়ে স্বপ্ন দেখাটা বাস্তবসম্মত হবে। এবং সরকারের কাছে শুধুমাত্র আর্থিক সাহায্য ছাড়া প্রকাশক-পরিচালকরা পরিস্থিতির উন্নয়নে নিজেরাও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারবেন এমন কি সহযোগিতা আশা করেন তাও পরিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ।

মনে রাখা উত্তম যে, শুধু মোটা অঙ্কের বিনিয়োগই সবকিছু বদলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। মোটা অঙ্কের বিনিয়োগের সামর্থ্য অর্জন করা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে প্রত্যাশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বাজার গঠনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের দেশে স্থানীয় পাঠাগারগুলোর কথা তো বলে লাভই নেই, এমনকি স্কুল-কলেজ পর্যায়ের পাঠাগারগুলো পর্যন্ত বলার মত সচল নয়। জনমনে সিনেমা হলগুলো সম্পর্কে ধারণা যাচ্ছেতাই। সময় এখন এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতিকে মেনে নিয়ে তা পক্ষে আনার জন্য লড়াইয়ে নামার। কিন্তু আমাদের সেই বিকার নেই।

আমরা ওঠতি লেখকদের মহাজনের টেলিস্কোপ দিয়ে ফেরিওয়ালার অবয়বে দেখি। সিনেমার দর্শকদের অশ্লীলরূপে কল্পনা করি। যৌনতাকে পণ্য বানিয়ে বিক্রির পাঁয়তারা করি। সমাজকে বোকা মনে করি। পুরাতনকেই নতুন বলে বিশ্বাস করি। দলবদ্ধ স্বার্থকে ব্যক্তিগত স্বার্থের টানে বিসর্জন দেই। ফলে আমরা দলবদ্ধভাবেই পেছনে পড়ে থাকি। এই পেছনের সারি থেকে সামনে আসার জন্য আমাদের একটু ভিন্ন প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

গোলটেবিল বৈঠকে বসে বসে টেবিল চাপড়ে আর জাতির রুচিবোধ নিয়ে বিষোদগার করে তা সম্ভব নয়। যে লেখক বা স্বপ্নচারী তরুণ নির্মাতার নিজেরই পায়ের নীচে মাটি নেই, তাঁর কাছে বেশি কিছু আশা করা অন্যায়। কিন্তু যাঁরা স্রোতের অনুকূলে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা পেয়ে ধন্য তাঁদের দায়িত্ব সচেতন হওয়া কর্তব্য।

ফেব্রুয়ারির প্রথম দিন থেকেই শুরু হচ্ছে দেশের সবচেয়ে বড় এবং ঐতিহ্যবাহী বইমেলা। প্রকাশকদের দাবী অনুযায়ী গত দুই বছর মেলা ভাল চলেনি। এবার তাঁরা দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠার ব্যাপারে আশাবাদী। কিন্তু দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো প্রচেষ্টা ছাড়াই এমন আশাবাদী হওয়ার যৌক্তিকতা কম।

তারপরও আমরা আশাবাদী হতে চাই। এ মাটিতে যাঁরা দু-চার কলম লেখালেখি করেন, এখনো পর্যন্ত এটাই তাঁদের সবচেয়ে বড় আশার জায়গা। এবং যাঁরা সিনেমা নিয়ে কাজ করেন তাঁদেরও। আমি আমার পুরোটা লেখায় বইয়ের সাথে সিনেমাকেও রেখেছি! কারণ আমি বাজার সম্প্রসারণের প্রশ্নে দুটোকেই এক মনে করি।

কারণ আমি জানি না হ্যারি পটার সিরিজটাকে ঠিক কোন উপাদানটি বেশি জনপ্রিয়তা দান করেছে, জেকে রাওলিংয়ের লেখা নাকি এর ভিত্তিতে নির্মিত সিনেমা? একই ভাবে টোয়াইলাইট, দ্যা লর্ড অফ দ্যা রিংস, দ্যা হবিট বা এরকম সবগুলো সিরিজের কথাই বলব। যদিও সত্য হচ্ছে দুটোই একে অপরের প্রচারে কাজে দিয়েছে।

ফয়সল সাইফ : উপন্যাসিক।

আপনার মন্তব্য