বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা: (প্রথম পর্ব : নির্ভারতা এবং ভার - ১,২ এবং ৩)

 প্রকাশিত: ২০১৫-১২-০১ ১৩:০৬:১২

 আপডেট: ২০১৫-১২-১২ ১১:২৪:৪৭

কাজী মাহবুব হাসান:

ভূমিকা:

‘বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা’ চেক লেখক মিলান কুন্দেরার (Milan Kundera) চেক ভাষায় লেখা উপন্যাস Nesnesitelná lehkost bytí র ইংরেজি অনুবাদ - The Unbearable Lightness of Being এর বাংলা ভাবানুবাদের একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা। মিলান কুন্দেরা বিশ্ব সাহিত্যের অত্যন্ত সমীহ জাগানো একটি নাম। বহু বছর ধরে সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেল জয়ীদের তালিকায় আমরা তাঁর নাম দেখে আসছি। মিলান কুন্দেরা ১৯২৯ সালে ১ এপ্রিল চেকোস্লোভাকিয়ার বর্নো শহরে ( বর্তমানে যা চেক প্রজাতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত) জন্ম গ্রহণ করেছিলেন, তবে ১৯৭৫ থেকেই ফ্রান্সে, প্রথমে নির্বাসিত লেখক ও পরে ফরাসী নাগরিক হিসাবে তাঁর বসবাস।

কুন্দেরার সাহিত্যকর্মগুলো মধ্যে তাঁর উপন্যাস The Unbearable Lightness of Being সবচেয়ে সুপরিচিত। ১৯৮৪ সালে লেখা এই উপন্যাসটির কাহিনী মূলত ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ার সংঘটিত প্রাগ স্প্রিং এর প্রেক্ষাপটে দুজন নারী, দুজন পুরুষ এবং একটি কুকুরের জীবনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চেকোস্লোভাকিয়ায় অব্যাহত সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন ১৯৬৮ সালে সদ্য নির্বাচিত হওয়া চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান অ্যালেক্সান্ডার ডুবসেক। তাঁর সংস্কারের সূচনাই সুপরিচিত প্রাগ স্প্রিং (Prague Spring) নামে, যে সংস্কার আন্দোলনকে দমন করার জন্য ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ করেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে ওয়ারশ প্যাক্ট ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো। ১৯৮২ সালে লেখা উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, তবে সেটি মূল চেকভাষায় না, বরিস পাস্তারনাকের ডঃ জিভাগো’র মতই অনুবাদের (ডঃ জিভাগো প্রথম প্রকাশিত হয় ইতালীয় ভাষায়) মাধ্যমে এটি বিশ্বসাহিত্যে আবির্ভূত হয়েছিল ফরাসী অনুবাদে (L'Insoutenable légèreté de l'être)। বইটি তাকে বিশ্বখ্যাতি দিলেও চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট সরকার বইটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল কোনো ধরনের প্রকাশনা থেকে।

১৯৮৯ সালে ভেলভেট বিপ্লবের মাধ্যমে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট শাসনের অবসান হলে বইটির উপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। তবে ১৯৮৫ সালে মূল চেকভাষায় বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় স্বদেশের বাইরে, কানাডার টরোন্টো ভিত্তিক প্রকাশনা 68 Publishers এর পক্ষ থেকে। ২০০৬ সালে তাঁর জন্মশহর বর্ণোতে পুনপ্রকাশিত হয় বইটি। আর এই বিলম্বের কারণ কুন্দেরাই অনেকদিন চাননি বইটি চেকোস্লোভাকিয়া থেকে প্রকাশিত হোক। ১৯৮৪ সালেই ফরাসী অনুবাদের সাথে সাথেই মাইকেল হেনরী হাইমের ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে। এই অনুবাদের জন্য আমি মাইকেল হেনরী হাইমের ইংরেজি অনুবাদটি অনুসরণ করেছি। মিলান কুন্দেরা বেশ কিছু উপন্যাস, নাটক, গল্প ,কবিতা ও প্রবন্ধ সংকলনের রচয়িতা। প্রায় সব সময়ই গণমাধ্যমের অন্তরালে থাকা এই লেখকের সর্বশেষ উপন্যাস - The Festival of Insignificance (La fête de l'insignifiance) প্রকাশিত হয়েছে গতবছর (২০১৪)।


প্রথম পর্ব : নির্ভারতা এবং ভার

চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের [১] ধারণাটি খুব রহস্যময় একটি ধারণা, আর নীচাহ [২]  প্রায়শই এই ধারণাটি ব্যবহার করে অন্য দার্শনিকদের ধাঁধার মধ্যে ফেলে দিতেন: এমনটা ভাবা যে, আমাদের জীবনে ঘটে যাওয়া সব ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটে ঠিক যেমনটা আগেই ঘটেছিল আমাদের অভিজ্ঞতায়, আর এই পুনরাবৃত্তিরও পুনরাবৃত্তি চলতে থাকে অনন্তকাল! এই উন্মত্ত অলীক ধারণাটি কি অর্থ হতে পারে?

নেতিবাচকভাবে যদি ব্যাখ্যা করতে চাই, চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের মিথটি বলছে যে, কোনো একটি জীবন যা একবার চিরকালের মত হারিয়ে গেছে, কখনোই যা আর ফিরে আসবে না, সে জীবন আসলে ছায়ার মত, নির্ভার, আগে থেকেই মৃত এবং হতে পারে সেই জীবন ছিল ভয়াবহ, সুন্দর কিংবা মহৎ, এর ভয়াবহতা,মহিমান্বিত রূপ এবং সৌন্দর্য সব কিছুই অর্থহীন। চতুর্দশ শতাব্দীর আফ্রিকার কোনো দুটি রাজ্যের মধ্যকার যুদ্ধকে আমরা যতুটুকু গুরুত্ব দেই, যে যুদ্ধ পৃথিবীর নিয়তিতে বিন্দুমাত্র কোনো পরিবর্তন করেনি, এমনকি যদি সেখানে লক্ষ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ তীব্রতম নিপীড়নের দ্বারা নিশ্চিহ্ন হয়েও থাকে, সেই জীবনকে আসলে আমাদের তার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দেবার আমাদের কোনো প্রয়োজন নেই।

চতুর্দশ শতাব্দীর আফ্রিকার দুটি রাজ্যর মধ্যে যুদ্ধটাই কি বদলে যাবে যদি বার বার এর পুনরাবৃত্তি হয়, চিরন্তন প্রত্যাবর্তনে?
হবে, পরিবর্তিত হবে সেটি: এটি পরিবর্তিত হবে কঠিন ঘণ একটি বস্তুপিণ্ড, চিরস্থায়ী ভাবে প্রস্ফীত, যার অর্থহীনতা অসংশোধনীয়।
যদি ফরাসী বিপ্লবের পুনরাবৃত্তি হতে থাকে চিরন্তনভাবে, ফরাসী ঐতিহাসিকরা রোবসপিয়েরকে [৩] নিয়ে খানিকটা কম গর্ব অনুভব করতেন। কিন্তু যেহেতু তারা এমন একটি বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, যা আর কখনোই ফিরে আসবে না, বিপ্লবের সেই রক্তাক্ত বছরগুলো পরিণত হয়েছে শুধুমাত্র কতগুলো শব্দ, তত্ত্ব আর আলোচনায়, পালকের চেয়েও যা নির্ভার হয়ে গেছে গেছে, কারো মনেই  আর তা ভীতির উদ্রেক করেনা। একজন রোবসপিয়ের, যে ইতিহাসে মাত্র একবার আসে এবং যে রোবসপিয়েরের চিরন্তন পুনরাগমন ঘটে ফরাসীদের মাথা কাটার জন্য, তাদের মধ্যে পার্থক্য অসীম।

আসুন সেকারণে আমরা অন্তত একমত হই, চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের ধারণাটি আমাদের এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গির ইঙ্গিত দেয়, যেখান থেকে কোনো কিছুকে আমরা যেভাবে চিনি তার চেয়ে ভিন্ন অনুভূত হয়: তারা আবির্ভূত হয় তাদের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির মাধ্যমে গুরুত্ব হ্রাস করে দেয়ার মত কোনো পরিস্থিতি ছাড়াই। এই গুরুত্ব প্রশমন করিয়ে দেবার মত পরিস্থিতি আমাদের বাধা দেয় কোনো একটি মতামতে পৌছাতে। কারণ কিভাবে আমরা কোন কিছুকে দোষারোপ করবো, যা ক্ষণস্থায়ী, আসা যাওয়ার মধ্যে যার অবস্থান?

অবসানের গোধুলীবেলায় অতীত বিধুরতার আলোয় উদ্ভাসিত হয় সবকিছু, এমনকি গিলোটিনও (৪)।
বেশী দিন আগে নয়, একটি অবিশ্বাস্য অনুভূতির উপস্থিতি আমি টের পেয়েছিলাম আমার ভিতরে, হিটলারের (৫) উপর একটি বইয়ের পাতা উল্টাতে গিয়ে, তার কিছু প্রতিকৃতি আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল: আমার শৈশবের কথা মনে করে দিয়েছিল সেই ছবিগুলো। যুদ্ধের সময়েই আমি বড় হয়েছিলাম, আমার পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যও তাদের জীবন দিয়েছেন হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে (৬); কিন্তু আমার জীবনের হারানো সেই সময়ের সব স্মৃতি, যে সময় কোনোদিনও আর ফিরে আসবে না, তার তুলনায় তাদের মৃত্যু আমার কাছে আসলে কি?
হিটলারের সাথে এই পুনর্মিলন আসলে প্রকাশ করে এই পৃথিবীর একটি গভীরতম নৈতিক বিকৃতি, যা নির্ভর করে প্রধানত পুনরাবৃত্তির অনস্তিত্বের উপর, কারণ এই পৃথিবীতে সবকিছুই পূর্বেই ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং সেকারণে সবকিছুই নৈরাশ্যজনকভাবেই অনুমতিপ্রাপ্ত।
 

যদি আমাদের জীবনের প্রতিটি সেকেন্ডের পুনরাবৃত্তি ঘটে অসীম সংখ্যক বার, তবে অনন্তকালের কাছে আমরা চিরবন্দী, ক্রুশে পেরেক দিয়ে বিদ্ধ যীশু খ্রিস্ট যেমন। ভয়ঙ্কর একটি ভবিষ্যৎ। চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের পৃথিবীতে দুঃসহ দায়িত্বের ভার আমাদের প্রত্যেকটি কাজের উপর ভর করে থাকে। একারণেই নীচাহ চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের ধারনাটি চিহ্নিত করেছিলেন সবচেয়ে ভারী বোঝা হিসাবে (৭) যদি চিরন্তন প্রত্যাবর্তন আমাদের উপর সবচেয়ে ভারী বোঝা হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের জীবনগুলো এর বিপরীতে সুস্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত হতে পারে তাদের সব চমৎকার নির্ভারতা সহ।কিন্তু  এই ভার কি আসলেই নিন্দনীয় আর নির্ভারতা চমকপ্রদ?

সবচেয়ে ভারী বোঝাগুলো আমাদের ভেঙ্গে ফেলে, আমরা এর নীচে পতিত এবং পিষ্ট হই, মাটির সাথে এটি চেপে ধরে রাখে আমাদের। কিন্তু প্রতিটি যুগের ভালোবাসার কবিতায়, নারী পুরুষের শরীরের ভার তাদের উপর অনুভব করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে আসছে। সবচেয়ে ভারী বোঝা তাহলে একই সাথে জীবনের সবচেয়ে তীব্র পরিপূর্ণতারও একটি দৃশ্য। বোঝা যত ভারী হবে, আমাদের জীবন ততই পৃথিবীর সন্নিকটে আসে, তত বেশী বাস্তব আর সত্যনিষ্ঠ হয়।

এর বিপরীতে, বোঝার চূড়ান্ত অনুপস্থিতি মানুষকে বাতাসের চেয়েও নির্ভার করে তোলে, অনেক উপরে তাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, পৃথিবী এবং পার্থিব অস্তিত্বকে পরিত্যাগ করে এবং রূপান্তরিত করে শুধু অর্ধেক সত্যে, তার প্রতিটি কর্ম যেমন মুক্ত ঠিক তেমনই গুরুত্বহীন।
তাহলে আমরা কোনটাকে বেছে নেব? ভার নাকি নির্ভারতা?

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারমেনিডিজ [৮] ঠিক এই প্রশ্নটি উত্থাপন করেছিলেন। তিনি পৃথিবীটাকে  বিভাজিত দেখেছিলেন বিপরীতমুখী যুগলে: আলো/অন্ধকার, সূক্ষ্মতা/স্থূলতা, উষ্ণতা/শীতলতা, অস্তিত্ব/অনস্তিত্ব। এই বিপরীতমুখী যুগলে অর্ধেককে তিনি চিহ্নিত করেছেন ইতিবাচক হিসাবে (আলো, সূক্ষ্মতা,উষ্ণতা, অস্তিত্ব) এবং অন্য অর্ধেককে নেতিবাচক হিসাবে। আমরা  ইতিবাচক এবং নেতিবাচক মেরুতে তার এই বিভাজন প্রক্রিয়াকে শিশুসুলভ সরল মনে করতে পারি শুধু একটি সমস্যা ছাড়া: কোনটি ইতিবাচক, ভার নাকি নির্ভারতা?
পারমেনিডিজের উত্তর ছিল: নির্ভারতাই ইতিবাচক, ভার নেতিবাচক।
তিনি কি সঠিক অথবা না?

সেটাই প্রশ্ন। শুধুমাত্র একটি বিষয় নিশ্চিত তাহলো: নির্ভারতা/ভার বৈপরীত্যটি সবচেয়ে বেশী রহস্যময় আর অস্পষ্টতা একটি বিষয়।
 

অনেক বছর ধরেই আমি টমাসের কথা ভাবছিলাম। কিন্তু  শুধুমাত্র এইসব ভাবনার আলোকেই তাকে বোধহয় আরো স্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছিলাম। তার ফ্লাটের জানালার সামনে আমি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম, মাঝের কোর্ট ইয়ার্ডে অন্য পাশে বিপরীত দিকের দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল সে, বুঝতে পারছিল না কি করবে সে।

তিন সপ্তাহ আগে একটি ছোট চেক শহরে তেরেজার সাথে তার প্রথম দেখা হয়েছিল। এমন কি পুরোপুরি একঘণ্টা সময়ও তারা এক সাথে কাটায়নি। তেরেজা স্টেশন পর্যন্ত এসেছিল টমাসের সাথে, যতক্ষন না টমাস ট্রেনে উঠে বসেছে, ততক্ষণ অপেক্ষাও করেছিল তার সাথে। এর ঠিক দশ দিন পর তেরেজা দেখা করতে এসেছিল তার সাথে। তার পৌঁছানোর দিনেই তারা শারীরিকভাবে মিলিত হয়েছিল। আর সে রাতেই হঠাৎ করে খুব জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিল তেরেজা এবং পুরো এক সপ্তাহ টমাসের ফ্লাটে সে থেকেছে ফ্লু নিয়ে।

প্রায় সম্পূর্ণ এই আগন্তুকটির প্রতি টমাস একসময় এক ধরনের অবর্ণনীয় ভালোবাসা অনুভব করতে শুরু করেছিল। তার কাছে তেরেজাকে শিশুর মত মনে হয়েছ. একজন শিশু যাকে কেউ আলকাতরা দিয়ে লেপা একটি বুলরাশের [৯] এর ঝুড়িতে শুইয়ে নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে, যেন টমাস তার বিছানার নদীর পাড়ে তাকে খুঁজে পায়।

টমাসের সাথে সে এক সপ্তাহ কাটিয়েছিল সেবার, যতদিন পর্যন্ত না সে সুস্থ বোধ করে। তারপর ফিরে গিয়েছিল তার শহরে, প্রাহা [৬] থেকে প্রায় একশ পচিশ মাইল দুরে। এবং তারপর আমি যে সময়ের কথা দিয়ে টমাসের গল্প শুরু করেছিলাম কিছুক্ষণ আগে, সেই সময়টা এসেছিল এবং যে সময়টা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসাবে আমি দেখছি : জানালায় দাড়িয়ে, কোর্ট ইয়ার্ডের অপর প্রান্তে টমাস তার বিপরীত দিকে দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল আর গভীরভাবে ভাবছিল।

সে কি তেরেজাকে প্রাহাতে আবার ডেকে আনবে স্থায়ীভাবে তার সাথে থাকার জন্য? কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার ব্যপারে সে শঙ্কিত বোধ করে। কারণ যদি তাকে আসার জন্য সে আমন্ত্রণ জানায়, সেক্ষেত্রে তেরেজা অবশ্যই আসবে তার কাছে আর তাকে উৎসর্গ করবে তার জীবন।

অথবা তেরেজার প্রতি অগ্রসর হওয়া থেকে তার কি বিরত থাকা উচিৎ? সেক্ষেত্রে মফস্বল শহরের একটি হোটেলের রেস্টুরেন্টে তেরেজা চিরকালই একজন ওয়েট্রেস হয়েই রয়ে যাবে এবং তার সাথে আর কখনোই দেখা হবেনা টমাসের।
সে কি চাচ্ছে সে আসুক, নাকি চাচ্ছে না?
কোর্ট ইয়ার্ডের অপর প্রান্তের দেয়ালের দিকে তাকিয়ে একটা উত্তর খুঁজছিল টমাস।

বার বার টমাসের মনে পড়ছিল তার বিছানায় তেরেজার শুয়ে থাকার দৃশ্যটা; তার অতীত জীবনের কারো কথাই তেরেজা মনে করিয়ে দেয় না। সে না রক্ষিতা না স্ত্রী। সে যেন একটা শিশু, আলকাতরা লেপা বুলরাশের ঝুড়িতে কেউ তাকে তার বিছানা নদীর তীরে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘুমিয়ে পড়েছিল তেরেজা। পাশে হাঁটু গেড়ে বসেছিল টমাস। তেরেজার জ্বরের নিশ্বাস ধীরে ধীরে দ্রুত হচ্ছিল এবং একসময় সে গোঙ্গানীর মত দুর্বল একটি আওয়াজ করে ওঠে। টমাস তার গাল তেরেজার গালের সাথে চেপে ধরেছিল, ঘুমের মধ্যে তাকে ফিস ফিস করে কথা বলে শান্ত করার চেষ্টা করছিল। কিছুক্ষণ পর সে টের পেয়েছিল তেরেজার নিঃশ্বাস তার স্বাভাবিক গতি ফিরে পেয়েছে। অবচেতনভাবেই তার গাল টমাসের গালের আরো কাছাকাছি নিয়ে আসে সে। জ্বরের সূক্ষ্ম একটা গন্ধ অনুভব করেছিল টমাস, আরো বেশী করে নিঃশ্বাসের সাথে গন্ধটি বুকের মধ্যে টেনে নেয় সে, যেন তেরেজার শরীরের অন্তরঙ্গতা দিয়ে নিজেকে অতিরিক্ত পূর্ণ করতে চেষ্টা করছে সে এবং একই সাথে কল্পনা করছে, তেরেজা যেন তার সাথে আছে বহু বছর ধরে এবং এখন সে মারা যাচ্ছে। সুস্পষ্ট ভাবে হঠাৎ করে টমাস অনুভব করেছিল, তেরেজার মৃত্যু হলে সে আর বেঁচে থেকে পারবে না। তেরেজার পাশে শুয়ে এবং তার সাথে মরে যেতে চেয়েছিল টমাস। তার মাথার পাশে বালিশে টমাস তার মুখ চেপে ধরে রেখেছিল অনেকক্ষন ধরে।
এখন জানালা দাড়িয়ে সেই মুহূর্তগুলো বোঝার চেষ্টা করছে সে। তার ভিতরে ভালোবাসার ঘোষণা ছাড়া আর কিইবা হতে পারে সেই মুহূর্তের অনুভূতিগুলো?

কিন্তু এটা কি ভালোবাসা ছিল? তেরেজার পাশে শুয়ে মৃত্যুর বাসনাটা স্পষ্টতই বাড়াবাড়ি: তেরেজাকে এর আগে সে দেখেছিল মাত্র একবার। এটা কি শুধুমাত্র সেই পুরুষের উন্মত্ততা ছিল, যে কিনা অন্তর থেকেই জানে তার ভালো না বাসতে পারার অক্ষমতার কথা, অথচ এমন অনুভূতি প্ররোচনা করার জন্য সে আত্মপ্রবঞ্চনীয় একটি প্রয়োজীনতা অনুভব করেছিল? তার অবচেতন মন কি এতই ভীরু যে, এই ছোট কমেডির জন্য সে সঙ্গী হিসাবে পছন্দ করেছে দুর্ভাগা মফস্বল শহরের কোনো ওয়েট্রেসকে,  বাস্তবিক অর্থে তার জীবনে প্রবেশ করার যা কিনা কোনো সম্ভাবনাই নেই!

কোর্ট ইয়ার্ডে ওপাশে ময়লা দেয়ালগুলোর দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল, তার কোনো ধারণাই নেই, এটা কি নিছক পাগলামি ছিল নাকি ভালোবাসা।
এবং টমাস খুবই অস্থির বোধ করছিল, এরকম কোন পরিস্থিতিতে যখন কোনো প্রকৃত পুরুষ তাৎক্ষনিক ভাবে বুঝতে পারতো তার কি করা উচিৎ, সেখানে সে এই অস্বস্তিকর দোটানায় ভুগছে, আর সেকারণে সে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহূর্তগুলোর অনুভূতিগুলোকে ( তেরেজার বিছানার পাশে হাটু গেড়ে বসে থাকা এবং ভাবা যে তেরেজার মৃত্যু হলে তার পক্ষেও আর বেঁচে থাকা সম্ভব না) তাদের অর্থ থেকে বঞ্চিত করছিল।

নিজের উপর বিরক্তিটা রয়েই গেল যতক্ষণ না পর্যন্ত অবশেষে সে বুঝতে পারে, সে কি চাচ্ছে সেটা না জানাটাই আসলে খুবই স্বাভাবিক।
আমরা কখনোই আসলে জানতে পারিনা, কি চাইবো বা কি চাইতে হবে, কারণ, শুধুমাত্র একটি জীবন কাটিয়ে, আমরা যেমন না পারি আমাদের অতীতের জীবনের সাথে তুলনা করতে, তেমনি পারিনা চাওয়াগুলোকে আমাদের অনাগত জীবনে ক্রটিহীন করে তুলতে।
তেরেজার সাথে থাকাটাই কি ভালো হবে, নাকি একা থাকা ?

পরীক্ষা করে দেখার কোনো উপায় নেই, কোন সিদ্ধান্তটি আসলে অপেক্ষাকৃত ভালো, কারণ তুলনা করার কোন মানদণ্ডও নেই। জীবন যেভাবে আমাদের মুখোমুখি হচ্ছে আমরাও সেভাবেই বাঁচি, কোন সতর্কবাণী ছাড়াই, হঠাৎ আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া কোনো অভিনেতার মত। এবং সেই জীবনের কি মূল্য হতে পারে, যদি জীবনের প্রথম রিহার্সেলটাই আসল জীবন? সেকারণেই জীবনটা সবসময় একটা রেখাচিত্রের মত। না, ‘রেখাচিত্র’ শব্দটি ঠিক হলো না। কারণ রেখাচিত্র হলো কোনো কিছুর নকশা, কোনো একটি ছবির মূল ভিত্তি, অন্যদিকে যে রেখাচিত্র আমাদের জীবন, সেটি আসলে কোনকিছুরই রেখাচিত্র নয়, কোন ছবি ছাড়া একটি নকশা মাত্র।
টমাস স্বগতোক্তি করে, ‘আইনমল ইস্ট কাইনমল’ [১১], এই জার্মান প্রবাদবাক্যটি যা বলে তা হলো, শুধু মাত্র একবারের জন্য যা ঘটে, তা আসলে একেবারে কোনোদিনও না ঘটবার মতই। যদি মাত্র একটি জীবন আমরা বাঁচার জন্য পাই, তাহলে হয়তো আমরা আসলে কোনদিনও বেঁচেই থাকিনি।


(চলবে...)

নোটস:

[১]   চিরন্তন প্রত্যাবর্তন বা Eternal Return: নীচাহ’র একটি দর্শন ধারণা। যদিও এটি এর আগেও ভেবেছিলেন কিছু দার্শনিক।
[২] ফ্রিয়েডরিখ নীচাহ  - ১৮৪৪-১৯০০) : বিখ্যাত জার্মান দার্শনিক।
[৩] ম্যাক্সিমিলিয়েন রোবসপিয়ের ( ১৭৫৮ - ১৭৯৪) ফরাসী আইনজ্ঞ এবং রাজনীতিবিদ। ফরাসী বিপ্লব ও রেইন অব টেরর পর্বে অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব।
[৪] গিলোটিন বা গিয়োটিন, ধারালো ছুরি ফলা যুক্ত একটি যন্ত্র, যা ফরাসী বিপ্লবের সময় ব্যবহৃত হয়েছে দ্রুত শিরোচ্ছেদ করার জন্য।
[৫] হিটলার- অ্যাডলফ হিটলার, জার্মান চ্যান্সেলর ও নাৎসি পার্টি প্রধান।
[৬] কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প: বিনা বিচারে বহুসংখ্যক মানুষকে বন্দী রাখার জন্য নির্মিত ক্যাম্প।
[৭] das schwerste Gewicht - নীচাহ’র ইটারনাল রিটার্ন ধারণাটির সাথে সংশ্লিষ্ট, যেখানে চিরন্তন প্রত্যাবর্তনের ধারণাকে তিনি বলেছিলেন das schwerste Gewicht যার অর্থ সবচেয়ে ভারী বোঝা।
[৮] পারমেনিডেজ (খ্রিস্টপূর্ব ৫১৫-৪৬০): গ্রীক দার্শনিক, যার ঙহ ঘধঃঁৎব  নামের একটি মাত্র কবিতা এখনও টিকে আছে।
[৯] বুলরাশ: এক ধরনের ঘাস জাতীয় উদ্ভিদ - নলখাগড়া জাতীয় উদ্ভিদ।
[১০] প্রাহা - বা প্রাগ চেক প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে বড় শহর এবং রাজধানী।
[১১] Einmal ist keinmal জার্মান এই প্রবাদের অর্থ once doesn't count ( আক্ষরিকার্থে once is never),

আপনার মন্তব্য