বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, কিস্তি ১৪-১৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-১২ ০০:০৪:৪৮

 আপডেট: ২০১৬-০১-১২ ০০:১৫:৩২

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

১৪
এবং তার যে কোনো কিছুই করার ক্ষমতা নেই, এই বোধটি তাকে ভারী হাতুড়ীর মত আঘাত করে, কিন্তু তারপরও ব্যাপারটা রহস্যজনকভাবেই তাকে সুস্থিরও বোধ করায়। তাকে সিদ্ধান্ত নিতে কেউ বাধ্য করছে না। সে কোনো প্রয়োজন অনুভব করে না কোর্টইয়ার্ডের অপর দিকে বাড়ীগুলোর দেয়ালের দিকে তাকিয়ে ভাবতে, তেরেজার সাথে সে জীবন কাটাবে, কি কাটাবে না। তেরেজা নিজেই সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে যায় টমাস। হতাশাগ্রস্ত ছিল সে, কিন্তু খেতে খেতেই তার সেই মূল হতাশাটার প্রভাব কমে আসে, দুর্বল হয়ে পড়ে, এরপর বেশ তাড়াতাড়ি বিষণ্ণতা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না তার মনে। তেরেজার সাথে কাটানো বছরগুলোর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সে অনুভব করে, তাদের কাহিনীর এর চেয়ে ভালো আর কোনো সমাপ্তি হতে পারেনা। যদি কেউ এমন একটি গল্প তৈরি করতো, ঠিক এভাবে টমাস সেই কাহিনীটাকে শেষ করতো।

একদিন কোনো আমন্ত্রণ ছাড়াই তেরেজা তার কাছে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই একদিন সে চলে গেছে। ভারী একটা সুটকেস নিয়ে সে এসেছিল, ভারী একটা সুটকেস নিয়েই সে ফিরে গেছে।

বিল পরিশোধ করে রেস্টুরেন্ট থেকে সে বের হয়ে আসে। রাস্তা দিয়ে হাটতে থাকে, তার বিষণ্ণতাও ধীরে ধীরে বাড়ছিল আরো সুন্দর হয়ে। তার জীবনের প্রায় সাতটি বছর সে কাটিয়েছে তেরেজার সাথে এবং সে অনুধাবন করে, তেরেজার সাথে কাটানো সেই বছরগুলোর স্মৃতি,আসল সেই কাটানো সময়ের তুলনায় বরং বেশী আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল টমাসের কাছে।

তেরেজার জন্য তার ভালোবাসা অবশ্যই সুন্দর, কিন্তু সেটা আবার খুব ক্লান্তিকরও ছিল: সারাক্ষণই তেরেজার কাছ থেকে নানা কিছু লুকিয়ে রাখতে সে বাধ্য হয়েছে, কখনো ভান করতে হয়েছে, লুকাতে হয়েছে তার আসল অনুভূতি, দোষ স্বীকার করতে হয়েছে, তাকে খুশী করতে হয়েছে, অস্থির হলে শান্ত করতে হয়েছে, তেরেজার জন্য তার অনুভূতির প্রমাণ তাকে দিতে হয়েছে বহুবার, তার হিংসাগুলো অভিযোগগুলোর আসামী হতে হয়েছে, তেরেজার কষ্ট, আর দুঃস্বপ্নের জন্য তার অপরাধবোধে ভোগা, অজুহাত দেয়া, ক্ষমা চাওয়া, এসব যা কিছু ছিল ক্লান্তিকর তাদের সেই সম্পর্কে ,আজ সব বিলীন হয়ে অবশিষ্ট রয়ে গেছে শুধুমাত্র এর সৌন্দর্যটুকু।

শনিবারেই প্রথমবারের টমাসকে জুরিখের রাস্তায় একা একা হাটতে দেখা গেল, তার সদ্যপ্রাপ্ত স্বাধীনতার মাতাল করা নিঃশ্বাস সহ। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে তার জন্য এখন অপেক্ষা করছে নতুন কোনো অভিযান। ভবিষ্যৎ আবারো রূপান্তরিত হয়েছে গোপনীয় এক সম্ভাবনায়। তার পুরনো স্বাধীন ব্যাচেলর জীবনের অভিমুখেই সে যাত্রা শুরু করেছে, যে জীবনটাকে একসময় সে তার নিয়তি বলেই মনে করেছিল, যে জীবন সে আসলেই যেমন, তাকে ঠিক তেমনই হবার সুযোগ দেবে।

সাতটা বছর সে তেরেজার সাথে বন্দী জীবন কাটিয়েছে, তার প্রতিটি পদক্ষেপেই ছিল তেরেজার দৃষ্টি , বলা যায় সে তার গোড়ালিতে লোহার বেড়ী পরিয়ে দিয়েছিল। হঠাৎ করে যেন তার প্রতিটি পদক্ষেপে সে হালকা বোধ করে। সে যেন ভাসতে থাকে। পারমেনিডেজ এর যাদুর ক্ষেত্রে সে প্রবেশ করেছে তখন: সে তার বেঁচে থাকার মাদকীয় মধুর নির্ভারতা উপভোগ করতে শুরু করে।

(সে কি সাবিনাকে জেনেভায় ফোন করতে চাচ্ছিল? কিংবা অন্য নারী বন্ধুদের, যাদের সাথে জুরিখে গত সাত মাসে তার পরিচয় হয়েছে? না, একদমই না। হয়তো সে বুঝতে পেরেছিল যে অন্য কোনো নারী তার তেরেজার স্মৃতিকে আরো অসহনীয় বেদনাময় করে তুলবে।)

১৫
টমাসের এই অদ্ভুত বিষণ্ণ মুগ্ধতা স্থায়ী ছিল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত। কিন্তু সোমবারে, সবকিছু বদলে যায়-টমাসের চিন্তায় তেরেজা জোর করে ঢুকে পড়ে : তেরেজাকে সে কল্পনা করে টেবিলে বসে তার জন্য বিদায়ের সেই চিঠিটি লিখছে, তার মনে হয় তেরেজার হাত একটু কাঁপছে। টমাস দেখতে পায়, ভারী সুটকেসটা সে টানছে এক হাতে, অন্য হাতে ধরা কারেনিনের গলায় বাধা বাধনটা। টমাস কল্পনা করে, তেরেজা প্রাহাতে তাদের ফাকা ফ্ল্যাটের দরজা খুলছে আর সম্পুর্ণতম পরিত্যক্ততার একটি দীর্ঘশ্বাস তেরেজা তার মুখের উপর অনুভব করছে।

টমাসের সেই দুটি সুন্দর বিষণ্ণ দিনে, তার সমবেদনা ( আবেগীয় টেলিপ্যাথির সেই অভিশাপ) ছিল অনুপস্থিত, যেন খনি শ্রমিকের রোববারের গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন ছিল সেটি, যাদের সারা সপ্তাহ পরিশ্রমের পর সোমবারের আবার পরিশ্রমের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে হয়।

রোগীদের চিকিৎসা করার বদলে টমাস তেরেজাকে দেখে; নিজেকে মনে করিয়ে দেবার আন্তরিক চেষ্টা করে সে, তেরেজাকে নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না,তার কথা ভেবো না;টমাস নিজেকে বলে, আমি সমবেদনার অসুখে অসুস্থ হয়ে পড়েছি, ভালোই হয়েছে সে চলে গেছে,আমি আর তাকে কখনোই দেখবো না; যদিও এটা কিন্তু তেরেজা না, যার থেকে আমাকে মুক্তি পেতে হবে- বরং সেই অসুখ,অসহনীয় সমবেদনা, আমার ধারনা ছিল যার থেকে আমি সুরক্ষিত, কন্তু শুধুই ততক্ষণই,যতক্ষণ অবধি তেরেজা আমাকে এই সমবেদনার অসুখ দিয়ে সংক্রমিত করেনি।

শনিবার এবং রোববারে, টমাস অনুভব করেছিল, বেঁচে থাকার একটা মধুর নির্ভারতা ভবিষ্যতের গভীর থেকে তাকে স্পর্শ করছে। কিন্তু সোমবার, সে অনুভব করে সম্পূর্ণ অচেনা একটি ভার; রুশ ট্যাঙ্কের টন পরিমাণ স্টিলের ভার সেই তুলনায় যেন কিছুই নয়। কারণ সমবেদনার তুলনায় আর কোন কিছুই ভারী নয়,আমরা যে কষ্টটা অন্য আরেকজনের জন্য অনুভব করতে পারি,তার তুলনায় নিজের কষ্টের ওজনও এতো ভারী মনে হয়না। কারণ, অন্য কারো জন্য,আমাদের অনুভূত সেই কষ্টটি আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে কল্পনায় ভর করে, এবং প্রলম্বিত হতে থাকে শত প্রতিধ্বনিতে।

নিজেকে বারবার সে সতর্ক করেছিল, সমবেদনার অনুভূতির কাছে কিছুতেই হার না মানতে; আর সমবেদনা যেন মাথা নিচু করে খানিকটা অপরাধবোধ নিয়ে শুনছিল তার নিষেধাজ্ঞা। সমবেদনা জানতো তার আচরণ উদ্ধত অংহকারপূর্ণ; তারপরও সে তার অবস্থান ত্যাগ করেনি এক বিন্দু; এবং তেরেজার চলে যাবার পর পঞ্চম দিনে টমাস তার হাসপাতালের পরিচালককে ( যিনি রুশ আগ্রাসনের পর প্রতিদিন প্রাহাতে টমাসকে ফোন করতেন) জানায়, তাকে তার নিজের দেশে ফিরে যেতে হবে এখনই। টমাস লজ্জিত ছিল, কারণ সে জানতো, এ ধরনের কোন পদক্ষেপ দ্বায়িত্বজ্ঞানহীন এবং ক্ষমার অযোগ্য বলে মনে হতে পারে তার কাছে। সে ভেবেছিল, তেরেজা এবং তার জন্য টেবিলের উপর রেখে যাওয়া চিঠিটার কথা তাকে বলে মনের কিছুটা ভার লাঘব করবে,কিন্তু সেটা না করার সিদ্ধান্ত নেয় সে; সুইস পরিচালক এর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তেরেজার এই অন্তর্ধান শুধু পাগলামি আর ঘৃণ্য একটি কাজই মনে হতে পারে। এবং টমাস তেরেজাকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবার সুযোগ কাউকে দিতে অস্বীকৃতি জানায়।
হাসপাতালের পরিচালক মূলত অপমানিত বোধ করলেন।

টমাস শুধু কাঁধ ঝাঁকালো এবং বললো, এস মুস সাইন।

টীকা: এস মুস সাইন (es muss sein? জার্মান ভাষায় যার অর্থ, এটা হতেই হবে); টমাসের এই বাক্যের ব্যবহার আসলে কিন্তু পরোক্ষভাবে ভিন্ন একটি ধারণার উল্লেখ মাত্র। বীটহোভেন [২১] এর শেষ কোয়ার্টেটটি [২২] নীচের দুটো মোটিফের [২৩] উপর ভিত্তি করে লেখা:

এই শব্দগুলোর অর্থ অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে বোঝানোর জন্য বীটহোভেন নিজেই এই মুভমেন্টটা (সঙ্গীতের) শুরু করেছিলেন একটি বাক্য দিয়ে , Der schwer gefasste entschulss, যা সাধারণত অনূদিত হয়ে থাকে, ’একটি অত্যন্ত কঠিন সিদ্ধান্ত’ ।

বিটহোভেন এর প্রতি এই পরোক্ষ ইঙ্গিত আসলে টমাসের তেরেজার কাছেই ফিরে যাবার প্রথম পদক্ষেপ, কারণ তেরেজাই তাকে বীটহোভেন এর কোয়ার্ট্রেট আর সোনাটার রেকর্ডগুলো কেনার জন্য আগ্রহী করেছিল একসময়।

এই পরোক্ষ সম্পর্কটা টমাস যতটুকু ভেবেছিল তা আরো বেশী প্রাসঙ্গিক কারণ এই সুইস ডাক্তারটি নিজেই একজন গভীর সঙ্গীতপ্রেমী; শান্তভাবে মুচকি হেসে, বীটহোভেন এর মেলোডির মোটিফের সুরেই জিজ্ঞাসা করেন, মুস এস সাইন (muss es sein? অবশ্যই কি তা করতে হবে?)?

ইয়া, এস মুস সাইন ( হ্যাঁ, অবশ্যই তা করতে হবে) টমাস আরো একবার তা বলে।

[২১] লুদভিগ ভান বীটহোভেন (১৭৭০-১৮২৭) জার্মান সুরস্রষ্টা, সঙ্গীতজ্ঞ, পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব যিনি ক্লাসিকাল ও রোমান্টিক পর্বের উত্তরণের ক্রান্তিকালে কাজ করেছিলেন।
[২২] কোয়ার্ট্রেট: পশ্চিমা ধ্রুপদী সঙ্গীতে কোয়োর্ট্রেট চারজন গায়ক/গায়িকা, যন্ত্র বাজিয়ে দের সমবেত পরিবেশনা, কিংবা এমন কোন সঙ্গীত কম্পোজিশনকে বোঝায়, যা লেখা হয়েছে চারটি বাদ্যযন্ত্র অথবা কণ্ঠের জন্য।
[২৩] মোটিফ, সঙ্গীতে মোটিভ বা মোটিভ হচ্ছে সংক্ষিপ্ত কোন সঙ্গীতের আইডিয়া, যা কোন সামগ্রিক কম্পোজিশনের বৈশিষ্ট্যসূচক অংশটি নির্মাণ করে।

[চলবে...]

আপনার মন্তব্য