ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ১

পশ্চিমবঙ্গের লেখক রাজা সরকারের স্মৃতিচারণমূলক লেখা 'ফিরে দেখা এক জন্ম-কথা', যেখানে ওঠে এসেছে একাত্তর এবং সে সময়কার সমাজ, রাজনীতিচিত্র ও মানুষের দুর্ভোগ এবং ওঠে আসার বিস্তারিত বর্ণনা। দীর্ঘ এ লেখাটি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্যে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে।

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২১ ০০:০৭:২২

 আপডেট: ২০১৬-০১-২৫ ১৫:১৫:৩৩

রাজা সরকার:


১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় যেদিন গণহত্যা শুরু হলো তার পরদিন সকালেও শ্রীমন্তপুরসহ আশে পাশের কোন  গ্রামেরই জীবনযাত্রায় কোন রকম ব্যাঘাত ঘটেনি। কৃষকরা যেমন লাঙল বলদ নিয়ে মাঠে গেছে তেমনি মাছ ধরার জন্যও কেউ কেউ জাল নিয়ে বেরিয়ে গেছে ভোর রাতে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কুল পড়ুয়া ছেলে মেয়েরা কেউ কেউ ঘরের বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে বই স্লেট নিয়ে পড়তে বসে গেছে । ইস্কুল বন্ধ। কিন্তু বাড়িতে পড়তে হবে । গোয়াল খালি করে গরু নিয়ে মাঠে চলে গেছে কেউ কেউ। বৌ ঝিদের নানাবিধ  প্রাত্যহিকতায় মুখর গ্রাম-জীবন। রান্না হবে বলে কেউ কেউ  রান্নাঘরের উনুনে আগুনও দিয়েছে। শোনা যাচ্ছে বাচ্চাকাচ্চাদের সকাল বেলার খাই খাই ঘ্যান ঘ্যান। অর্থাৎ, নিজস্ব নিয়মেই চলেছে জীবন এখানে তখনও।    

কামান বন্দুক বা মেশিনগানের সঙ্গে প্রাণান্ত আর্তনাদের আওয়াজ তখনও এখানে অশ্রুত। কিংবা বজ্রপাতের মত সেই সংবাদও তৎক্ষণাৎ এই গ্রামে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েনি। বরং মন্থর যোগাযোগ ব্যবস্থার কল্যাণে সেই দুঃসংবাদ ক্রমশ গ্রামের মানুষ পেতে শুরু করলো সূক্ষ্ম অথচ তীব্র বেদনার মতো আরো ক'দিন পর থেকে। ততদিনে আবার নানা মুখে নানা স্বরে সেই সব সংবাদের বীভৎসতা বাতাসে পাক খেতে শুরু করলো। যার ফলে দিন কয়েকের মধ্যেই বিমূঢ় মানুষেরা পেতে শুরু করলো এক অচেনা আতঙ্কের স্বাদ। যে স্বাদ ভাতের থালায় বা বিছানার বালিশে বা নিস্তব্ধ রাতে হঠাৎ ঘুম থেকে জেগে উঠে টের পাওয়া যাচ্ছে। আর এই অচেনা আতঙ্কের স্বাদ'এর মধ্য দিয়ে অচিরেই তারা তাদের অজান্তেই সারা দেশের মানুষের সঙ্গে এক কাতারে এসে গেল ।

কিন্তু একটা বিষয় নিয়ে কোন মীমাংসা যেন কেউ খুঁজে পাচ্ছেনা যে কী করে নিজের দেশের মিলিটারিরা নিজের দেশের মানুষদের এই হারে মারতে পারে বা ঘরের মেয়েদের ধরে ধরে নিয়ে যেতে পারে। প্রথম প্রথম এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন ছিল। কিন্তু ক্রমে সব সংবাদের ভয়াবহ সত্যতা প্রকাশ পেতে শুরু করলো। ভাঙ্গা শুরু হলো গ্রাম জীবনের ছন্দ । ঘটনা আরো প্রকাশ হয়ে পড়লো যে হিন্দুরাই নাকি প্রথম টার্গেট। ঢাকা থেকে দ্রুত গতিতে হত্যাযজ্ঞের বৃত্ত পরিধি বাড়তে শুরু করেছে। কবে যে তা শ্রীমন্তপুর এসে পৌঁছে যাবে সেই আশঙ্কা সবার মনেই জায়গা করে নিয়েছে। এই অবস্থায় যমজ ভাইয়ের মতো পাশের মুসলমান প্রধান গ্রাম অমৃতপুর এসে হিন্দু প্রধান গ্রাম শ্রীমন্তপুরের পাশে দাঁড়িয়ে গেল। রাতারাতি দুই গ্রামের জোয়ান ছেলে পুলেরা রাত-পাহারার বন্দোবস্ত করে ফেলল। সশস্ত্র মিলিটারি যখন ঘাতকে পরিণত হয় তখন তার রূপ কি প্রকারের হয়ে থাকে বলাবাহুল্য তার কোন অভিজ্ঞতা এদের কেন, হয়তো এদেশের কারোরই ছিলনা। তবু এই উদ্যোগ সহমর্মিতার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হিসেবেই বয়স্করা দেখলো।

অঞ্চলটা প্রান্তিক এবং অনুন্নত ভাটি অঞ্চল হিসেবে খ্যাত। যোগাযোগ ব্যবস্থা সেই আদিযুগের। যাতায়াত বর্ষায় নৌকা আর খরার সময় নিজের দুই পা। কোন পরিবর্তন নেই। তখনও চাকার ব্যবহার যেন ঠিকঠাক চালু হয়নি। কাছাকাছি রেল ইস্টিশন মোহনগঞ্জ মাইল পাঁচেক দূরে। চাকা গড়ানোর মতো সড়ক পথও তেমনি। মানুষ এসব নিয়ে খুব মাথা ঘামায় বলে মনে হয় না। জীবন এর মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে চলে। ছেলেপুলেদের কাছে ঠিক এখান থেকে ঢাকা অনেকটা রূপকথার মতো মনে হয়। ফলে ঢাকাতে কি হচ্ছে বা হয়েছে তা নিয়ে তারা খুব চিন্তান্বিত নয়। ঘটনার ভয়াবহতা কতদূর তা অনুধাবন করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। ফলে গ্রাম পাহারার ব্যাপারটা এইসব অল্পবয়সীদের কাছে নিস্তরঙ্গ গ্রাম জীবনে একটা অনাস্বাদিত তরঙ্গের বিষয় হয়ে উঠলো। তাদের উৎসাহ অপরিসীম। প্রতি রাতে নিয়ম করে চলছে গ্রাম পাহারার কাজ।

ততদিনে খবর চলাচলের অনেক মুখ তৈরি হয়ে গেছে। প্রতিদিনই নানা মুখে নানা খবর এসে পৌঁছোচ্ছে এই গ্রামাঞ্চলে। সারাদেশেই মিলিটারি ছড়িয়ে পড়েছে। তৈরি হয়েছে তাদের নানা রঙের দোসর। তাদের মিলিত অত্যাচারে আতঙ্কে মানুষ দেশ ছাড়তে শুরু করেছে। সেই মানুষদের মধ্যে হিন্দুরাই বেশি। এই সব খবরের ফলে গ্রাম পাহারায় উৎসাহের জোয়ারে ভাঁটার টান অনুভব করতেও খুব বেশি সময় লাগলো না। দুই গ্রামের বয়স্করা বসে পরামর্শ করে ঠিক করলো যে হিন্দুদের জন্য এই গ্রামে মিলিটারি আসতে পারে। আসলে তারা সব সময় যে ধর্ম বিচার করে মারে তা নয়--এসে গেলে মুসলমানও মারা পড়তে পারে। সুতরাং হিন্দুদের দেশ ছাড়ার পরামর্শ দেয়া হলো। বর্ষা শুরু হয়ে গেছে। নৌকা করে বর্ডারে চলে যাওয়া যেতে পারে। বাড়িঘর সহায়সম্পত্তি নিয়ে কোন চিন্তা করতে বারণ করে দেয়া হলো। অশান্ত দেশ শান্ত হলে সবাই ফিরে আসবে। শেষ খবর মোহনগঞ্জে মিলিটারি ক্যাম্প চালু হয়ে গেছে। পাশাপাশি রাজাকার বাহিনি দোসরের কাজ শুরু করে দিয়েছে। এই খবরটাই শ্রীমন্তপুরের যে টুকু স্বাভাবিকতা ছিল তাও কেড়ে নিল। ঘরে ঘরে দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেল।  


খুঁড়িয়ে চলা একটি পরিবার থেকে চার চার জন মানুষ চলে গেলে বা কমে গেলে পরিবারটি অনেক শোক-কাতরতার মধ্যেও খাওয়া-পরার জায়গাটাতে একটা স্বস্তির বাতাস পায়। এটা কেউ স্বীকার করে না। কিন্তু মাথাটা ক্রমে হালকা বোধ হতে থাকে। ফসল কী হলো--তাতে কতদিন যাবে--ধার কর্জ কত হবে, -এসবের হিসেব নিয়ে আর ততো মাথা না ঘামালেও যেন চলে। আর কপালও এমন যে বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দেখা গেল বিগত অনেক বছরের তুলনায় সব রকমের ফসল যেন এবার বেশ ভালো হয়েছে। জীবনে একটু রস-আস্বাদের এমন নিশ্চিন্ত অনুভব কখনো ঘটেছে বলে রবীন্দ্র বাবু মনে করতে পারছিলেন না। তার জীবন-যাপনের যে রুটিন নিয়ে লোকে আগে নানা কথা বলতো তারা এখন আর তেমন রা কাড়েনা। আসলে একটা গ্রামীণ পরিবারের শীর্ষ ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও খাওয়া পরার চিন্তা--কৃষি ফসল নিয়ে চিন্তা--চাষ বাস খরা বৃষ্টি নিয়ে চিন্তা রবীন্দ্র বাবু কোন কালেই খুব একটা করতেন না। সাধু সঙ্গ, ধর্ম-চিন্তা,নাম কীর্তন-- এসব নিয়েই তার জীবন কাটে। ছেলে পুলে কে কীভাবে মানুষ হবে বা আদৌ হবে কিনা বা বয়স হলে মেয়ে বিয়ের চিন্তা--এসব তাকে স্পর্শ করে বলে মনে হয় না। তার উপর সে বা তার পরিবার বা তার আত্মীয় পরিজন এমন একটি দেশের বাসিন্দা যেখানে তাদের থাকা বা বসবাস করা সে দেশের রাজনীতির কাছে, সরকারের কাছে মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ দ্বি-জাতি তত্ত্বের উপর দাঁড়িয়ে ১৯৪৭ সনে দেশটা ভাগাভাগি হয়ে গেছে। অথচ হিন্দু হিসেবে তিনি বা তার পরিবার বা তার আত্মীয় পরিজন পড়ে গেছেন পাকিস্তান অংশে। এই শ্রীমন্তপুরে। সে নিয়ে সারা দেশে রায়ট বা একতরফা হিন্দু খেদানো বা হত্যা লুঠ ধর্ষণ বা জোর করে ধর্মান্তরকরণ চলেছে। সেইসব খবর তিনি সাত দিনের বাসি খবরের কাগজে কোন সময় পড়েন অথবা পড়েন না। কখনো লোকমুখে শোনেন অথবা কখনো শোনেন না। পরিবারের লোকেদের সঙ্গে এনিয়ে পারত পক্ষে কোনো আলোচনা করেন না। করলে আতংক ছড়াতে পারে । আশা, এসব একদিন ঠিক হয়ে যাবে। আশ্চর্য শ্রীমন্তপুর বা তার সন্নিহিত অঞ্চলে এই জাতীয় আতংকিত হওয়ার মত কোন ঘটনা ঘটেনি । ফলে একদিকে এই আশা, অন্যদিকে সবচেয়ে বড় বল ভরসা তার একমাত্র সঙ্গী মধুবাবু। সংসারে থাকলেও মধুবাবু একজন সাধু । সাধু নামেই তার পরিচিতি। বাড়িতে তার রাধাকৃষ্ণের মন্দির আছে। বাৎসরিক কীর্তন হয় সেখানে। নিরক্ষর মধুবাবুর বাড়িতে রবীন্দ্র বাবু দুবেলা যাতায়াত করেন। উদ্দেশ্য সাধু সঙ্গ। মাঝে মাঝে মধু বাবুকে গীতা পাঠ ও  ব্যাখ্যা করে শোনানো রবীন্দ্রবাবুর একটা মহৎ এবং পছন্দের কাজ। কারণ ধর্ম গ্রন্থের পাঠ বা আলোচনা শোনার মত মানুষ এই ভাগচাষী বা কৃষি নির্ভর ক্ষুদ্র মধ্যসত্ত্বভোগী মানুষের মধ্যে আর তেমন নেই। আশে পাশের গ্রামগঞ্জের মানুষেরা এই কারণে তাদের দুজনকে খুব শ্রদ্ধা ভক্তি করে থাকেন। কারণ ধর্মাচরণে না থাকলেও তাদের ধর্ম-বিশ্বাসে আস্থা অটল।  

এতদঞ্চলে কোন সাম্প্রদায়িক গোলমাল না হলেও আতঙ্ক আর গুজব ভেসে বেড়াতো বাতাসে। হিন্দুদের মধ্যে তাই একধরণের অস্থিরতা ছিলই । শ্রীমন্তপুর তো আর দেশের বাইরের নয়। ঘটনা ঘটতে তো আর সময় লাগেনা। কখন কার কী বিপদ ঘনাবে কে জানে। কিছুদিন আগে রবীন্দ্র বাবুর তিন ছেলে আর তার বৃদ্ধা মা দেশান্তরী হয়েছে। বড় ছেলে অনেক আগেই গেছে। সংসার তাই এখন দুইভাগ হয়ে দুই দেশে। এই ১৯৬৪ সনে তার সংসারে লোক সংখ্যা হ্রাস পেয়ে যা রইলো তার ভার খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। এক ছেলে ও এক মেয়ে এখনও তাদের সঙ্গে রয়ে গেছে। বড় দুই মেয়ের বিয়ে অনেক আগেই হয়ে গেছে। একমাত্র পুত্র হিসেবে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত তার সম্পত্তি খুব একটা ছোট কিছু নয়। তৎসত্ত্বেও তার অভাব আছে নিত্য সঙ্গী হয়ে। এসব অভাব অভিযোগ তাকে স্পর্শ করে না বা করতে পারে না। কারণ তার স্ত্রী। তার স্ত্রী সুপ্রভা বা প্রভা তার ধর্ম চর্চার জন্য এতোটা পরিসর সৃষ্টি করে দিয়েছেন যে সংসারের ভার কী বস্তু তা জানার মন্দ ভাগ্য তার কোনদিনই হয়নি। তাই দেখা যায় সংসারের ভার বইবার তিনি কেউ নন। সে-সব এতোদিন তার স্ত্রী আর তার বৃদ্ধা মায়ের হাতেই ছিল। এখন মা চলে যাওয়াতে সব তার স্ত্রীর উপরই বর্তেছে।

সংসার এভাবে চলতেই পারতো। কিন্তু চলেনি। দেশকাল বলে একটা ব্যাপার আছে। যাকে উপেক্ষা করা যায় না। ঈশ্বরে সমর্পিত মানুষেরা সব যুগেই যাবতীয় ভগবৎ চিন্তার দ্বারা দেশকাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি। কথায় কথায় সব 'ঈশ্বরের ইচ্ছা' বলা সত্ত্বেও বাস্তবে দেখা যায় ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে কিছু হয়না। মানুষের ইচ্ছাতেই সব হয়। সে মানুষ খারাপ ভাল যাই হোক না কেন। তেমনি রবীন্দ্র বাবুর সংসারে ১৯৬৪ পরবর্তী সুখের চলনে তাল ভঙ্গ হতে শুরু হলো ১৯৬৯এ এসে এক গণ-আন্দোলনের কারণে। সরকারের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন সম্পর্কে না চাইলেও এই অতি প্রান্তিক গ্রামে ঢাকা থেকে নানা বাসি খবর এসে পৌঁছোয়। মধু বাবুর বাড়িতে কোনদিন গীতা-পাঠ সরিয়ে রেখে এসবের আলোচনাও হয় বৈকি। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ রবীন্দ্র বাবুর মুখে এসব শুনে মধু বাবু মিটি মিটি হাসেন। জোড়া হাত কপালে ছুঁইয়ে তিনি শুধু বলেন সবই রাধা-মাধবের ইচ্ছা--চিন্তার কি আছে অত। তাতে রবীন্দ্র বাবু একটু আপাত হাফ ছাড়েন। কিন্তু কিছুটা দুশ্চিন্তার বাতাস বুকের আনাচে কানাচে তার রয়েই যায়।

হঠাৎ কী এমন হলো দেশটার--এতো আন্দোলনই বা কেন--এইতো সে দিন, মাত্র বছর ২২ আগে দেশটা ভাগ হলো। ভাগাভাগি--কাটাকাটি--মারামারির রক্তের দাগ এখনো শুকিয়েছে কি? এর মধ্যেই কে কার বিরুদ্ধে নেমেছে? কী নিয়ে ঝগড়া? মিটমাট একটা করে নিলেইত হয়। ঢাকা-কেন্দ্রিক আন্দোলনের তীব্রতা ক্রমে অন্য শহরে ছড়ালেও বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে এখনও তার তেমন প্রভাব নেই। প্রাচীন কাল থেকেই গ্রাম বাংলা কিছুটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। তার উপর নদনদীর বাহুল্য, যোগাযোগের অপ্রতুলতা, ইত্যাদি নিয়ে একটা আন্তঃবিচ্ছিন্নতার মধ্যে পড়ে থাকা ভূখণ্ড টি আজ বড় বেসামাল। রবীন্দ্র বাবুর নিজের মানুষ বলতে আছে এখন তার এক বিবাহিতা মেয়ে নিয়তি, যার বিয়ে হয়েছিল মুক্তাগাছা। এখন সে তিন সন্তানের মা, আরো অনেকের মতো তারাও সপরিবারে এদেশেই থেকে গেছে।

১৯৬৯ এর গণ আন্দোলন, তারপর ভোট-- আওয়ামী লীগের জয়-- তারপর এই ১৯৭১ এ এসে ক্রমে এক ভয়ঙ্কর পরিণতির দিকে মোড় নিল। কেন, রবীন্দ্রবাবুর তা জানার কথা নয়। আর জানলেও, তা উপলব্ধি করা তার পক্ষে ততখানি সম্ভব নয় যতখানি একজন শহর বা শহরাঞ্চলের মানুষ করতে পারে। কিন্তু দুঃসংবাদ এসব গ্রাহ্য করেনা। তার গতি সততই অপ্রতিরুদ্ধ। সেই সময় অর্থাৎ ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ পরবর্তী সময়ে একদিন তার বিবাহিতা মেয়ে নিয়তিই প্রথম পিতৃগৃহে আসার সুত্রে বয়ে নিয়ে আসে দেশের অনেক দুঃসংবাদ। নিজেদেরও অনেক দুঃসংবাদ। তারা  তুলনামূলক ভাবে বড় শহরের নিকটবর্তী হওয়ার দরুন বেশি সংবাদ রাখে। ফলে তার কথা সবাই কিছুটা বিশ্বাসও করে।

কী সেই দুঃসংবাদ? কেনইবা সে এই সময়ে এই সংবাদ বয়ে নিয়ে আসলো? নিয়তির মা সুপ্রভা শিউড়ে উঠলো--রবীন্দ্রবাবু নির্বাক। যা জানা গেল তা হলো ঢাকায় মিলিটারিরা সাধারণ মানুষ মেরে ফেলেছে। তাই নিয়ে বিরাট গোলমাল। এখন নাকি বেছে বেছে হিন্দুদের মারছে। মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তাগাছার যে গ্রামে তার শ্বশুরবাড়ি সেখানে দল বেঁধে চেনা অচেনা লোকজন ঘুরছে, হিন্দুদের ভয় দেখাচ্ছে, বলছে বাঁচতে চাইলে টেহা দেওন লাগবো, মাইয়া দেওন লাগবো। তারা কারা বোঝা যায় না। কেউ কয় রেজাকার, কেউ কয় শান্তিবাহিনী--- আরো কিতা কিতা যেন তারারে কয়। হাতে হাতে তাদের বন্দুক থাকে, তলোয়ার থাকে। অরাজকতা কী বস্তু মানুষ উপলব্ধি করতে শুরু করলো।

[চলবে...]

আপনার মন্তব্য