ফিরে দেখা এক জন্মকথা-২

পশ্চিমবঙ্গের লেখক রাজা সরকারের স্মৃতিচারণমূলক লেখা 'ফিরে দেখা এক জন্ম-কথা', যেখানে ওঠে এসেছে একাত্তর এবং সে সময়কার সমাজ, রাজনীতিচিত্র ও মানুষের দুর্ভোগ এবং ওঠে আসার বিস্তারিত বর্ণনা। দীর্ঘ এ লেখাটি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্যে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২৫ ১৪:৩১:৫৫

 আপডেট: ২০১৬-০১-২৫ ১৫:১৬:৪৩

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

নিয়তির হঠাৎ করে পিতৃগৃহে চলে আসার কারণ যে তার শ্বশুরের ভিটেয় থাকা ক্রমে দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে তা ক্রমে প্রকাশ পেয়ে গেল। মাটি কামড়ে কোন মতে পড়ে থাকতে থাকতে আশা ছিল যে হয়তো অচিরেই এসব থেমে যাবে। কিন্তু না। অরক্ষিত ঘরবাড়িতে এরমধ্যেই একদিন একদল রাজাকার অন্যান্য দিনের মতই তাদের বাড়িতে আসে । কিন্তু এদিন আর টাকা চায় না। বরং সঙ্গে দু'একজন মুরুব্বিগোছের লোকও নিয়ে এসেছে। তাদের দেখে নিয়মমতোই বাড়ির পুরুষেরা গা ঢাকা দিয়েছে। আর তাদের না পেয়ে শেষে মুরুব্বিরা ডাকে নিয়তিকেই। বাইরের উঠোন লাগোয়া ঘরের বারান্দায় তারা নিজেদের বাড়ির মতই চেয়ার টেবিল বের করে জমিয়ে বসে গেছে। হৃদপিণ্ডের কাঁপুনি চেপে রেখে কোলের সন্তানটিকে কোলে নিয়ে নিয়তি অনেকটা বোধশূন্য ভাবেই যেন এগিয়ে গেল। এতদিন দেয়ালে পিঠ ঠেকেছিল, আর আজ যেন সেই দেয়ালটাও সরে গেল । মুরুব্বিদের আদেশে অবশ্য কেউ তাকে স্পর্শ করল না বা কোন কথা বলল না। যা বলার এক মুরুব্বিই বললেন। বক্তব্য খুব সংক্ষিপ্ত।--মাইয়া তুমরা যদি বাঁইচবার চাও তো ধর্ম ছাড়ো। এই কথা বলার জন্যই আমরা আইছি। আইছি এই কারণে যে এই মিত্র বাড়ির ভাত কে না খাইছে--আজ তার বাড়ির মানুষের কোন সর্বনাশ হইলে আমরা যতই শান্তিবাহিনী করি, মানতে পারিনা। পলাইয়া কে কয় দিন বাঁচবো কও। বাড়ির বেডাইন (পুরুষ) রা কি এইভাবে তোমাগোরে বাঁচাইবার পারবো? তাই কই সময় থাকতে কলেমা পইড়া লও । পড়লে আমরা দশজন পাশে আছি। নাইলে কোন অনাচার অইলে আমগোরও খারাপ লাগবো। কিন্তু কিছু করণ যাইবো না। উত্তরে নিয়তি যে বক্তব্য রেখেছিল তা যেন নিয়তি নয়, নিয়তির ভেতর থেকে অন্য কেউ রেখেছিল। তা ছিল অনেকটা এই রকম।– চাচা, মরণ বাঁচন উপরওলার হাতেই ত জানতাম--আইজ কিছুদিন যাবত মরা বাঁচা সমান হইয়া গেছে--বাঁইচা আছি না মইরা গেছি অনেক সময় টের পাইনা। দেশেতো আফনের ধর্ম আমার ধর্ম সবই আছিল। আইজ কী অইলো যে ধর্মডাও ছাড়ন লাগবো--একটা থাকব আর একটা থাকব না-ইবা কেন---দেশেত নানান ধর্মই থাকে--আইচ্ছা আফনে মুরব্বি মানুষ কথাডা কইছেন—মানন লাগব--তয় ধর্ম ছাইড়া প্রাণ বাঁচানোর লোভ নাই চাচা--খালি অবুঝ এই পোলাপানগুলা যদি বাঁচবার পারে--আমারে দুই দিনের সময় দ্যান---ভাইব্যা দেহি।

সময় দিতে অস্ত্রধারীরা রাজি নয়। মুরুব্বিদের কথা আর তারা মান্য করবে না।'বেডি'র কথার প্যাচে তারা পড়তে রাজি নয় মোটে। একজন বন্দুকের নল নিয়তির কণ্ঠার উপর চেপে ধরলো। নিয়তির আঁচল ধরা বাকি দুই ছেলে কোলেরটার সঙ্গে একযোগে ডুকরে কেঁদে উঠলো। সন্তানের কান্না মা নিয়তির কানে প্রবেশ করে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। আর কিছু সে শুনতে পেলনা। নিয়তি যেমন কানে শুনলোনা, তেমনি চোখেও দেখলোনা। শিশুদের কান্না হন্তারকদের কানে কোন প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে না পারে, মায়ের কানেত করবে,কিন্তু কোথায় কি, নিয়তি যেন কানেও শোনেনা চোখেও দেখে না। কণ্ঠায় বন্দুকের নল নিয়ে সে যেন আর তার মধ্যে নেই। মুরুব্বিদের সঙ্গে অস্ত্রধারীদের তর্ক হলো। কণ্ঠায় বন্দুকের নল উপেক্ষা করে নিয়তি কখন যে উঠোনে মাটির উপর বসে পড়েছে সে নিজেও জানেনা। বিগত ক'মাসের মানবেতর জীবন কাটানো মিত্র বাড়ির বড় বউ বাইরের উঠোনে অনেক লোকের সামনে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে বসে থাকাতে বন্দুকের নল এখন তার মাথা তাক করে আছে।

ঠিক এই অবস্থায়ও নিয়তির মৃত্যু হয়নি। কি আশ্চর্য, লক্ষ মৃত্যুর মিছিলে আর একটি মৃত্যু যোগ হলনা--যা নির্ধারিত ছিল একান্ত ভাবেই। বাঁচা মরার মাঝখানে যেখানে আর কোন দেয়াল অবশিষ্ট নেই সেখানে বেঁচে যাওয়ার পরই যেন হাজারটা ভয় মিত্র বাড়ির উঠোনে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ঘাতকের অস্ত্রের স্পর্শ যেন নিয়তির হাড় মজ্জা পর্যন্ত ঢুকে বসে আছে। পালিয়ে থাকা স্বামী সহ গোটা পরিবার নিয়ে নিয়তি তাই একদিন বাড়ি ছাড়লো রাতের অন্ধকারে। বাড়ি ছেড়ে
যাবে কোথায়--সারা দেশ নামক ভূ-খন্ডটিত এখন ঘাতকদের পদানত। তবু আড়াল আবডাল দেখে দেখে শাখা সিঁদুর মুছে চেয়ে আনা একটা বোরখা পরে নিয়তি দিন তিনেকের চেষ্টায় বাপের ভিটে, অর্থাৎ শ্রীমন্তপুরে এসে কোনমতে উঠলো। যখন কথা বলার মতো শক্তি আর তার অবশিষ্ট নেই। ফলে ঘটনাক্রম প্রকাশ পেতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। কিন্তু নিয়তির ঘটনাক্রম শ্রীমন্তপুরের বাতাসে বেশি দূর যেতে পারলোনা। কারণ ইতিমধ্যে শ্রীমন্তপুর নামক হিন্দু প্রধান গ্রামটি জনশূন্য হয়ে পড়েছে। একমাত্র তার বাপের বাড়ির ক'টা মানুষ এখনো আছে। আজন্মের চেনা গ্রামটি এখন ভয়ের বস্তু হয়ে দাঁড়ালো । মানুষ ছাড়া ভূ-খণ্ডের কিবা দিন কিবা রাত। যেদিকে তাকাও শুধু শূন্যস্থান, দু-একটা পাখির ডাক ছাড়া আর কিছু নেই। ভাষাহীন চোখে নিয়তি সেই দিকে তাকিয়ে থাকে। শরীরে তার মাস কয়েকের এক শত্রুর বাস। সার্বিক ভয়ের এই রাজ্যে তার নির্ভয় নড়াচড়া নিয়তি অনুভব করে। কিন্তু চোখে তার জল নেই তাই কাঁদতে সে পারেনা।


দেশছাড়াটা এখন আর নতুন কোন ব্যাপার নয়। ১৯৪৭ থেকেই চলছে ।এদেশ থেকে গণ-নিষ্ক্রমণ আর পাশের দেশ ভারতে গিয়ে এক মানবেতর জীবনের ভেতরে ঢুকে গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা এদেশের হিন্দুদের কাছে অনেকটা ভবিতব্যের মতো হয়ে গেছে। এটা কেউ পারে কেউ পারেনা, এমন কি ভারতের মানবেতর উদ্বাস্তু-ক্যাম্প জীবনের ঘাত সইতে না পেরে অনেকেই ভেসে যায়, আবার অনেকেই পুনরায় ফিরে আসার চেষ্টা করে এদেশেই। এ-সবই ধর্মের দায়। এই উপমহাদেশের বৃহত্তর সমাজের কাছে ধর্ম ছাড়া মনুষ্য-পরিচয়ের আর কোন পরিসর এখনো তৈরি হয়নি। ফলে দেশ রাজনীতি ইত্যাদি যখন ধর্মের এজেন্ডা নিয়ে চলতে চায় তখন সাধারণ মানুষের অবস্থা এর চেয়ে অন্য আর কী হতে পারে।

তাই আবার একবার দেশছাড়ার তাড়াহুড়া। আগেরবারের সঙ্গে এবারের পার্থক্যটা চোখে পড়ার মতো। আগে এদেশ থেকে শুধু হিন্দুরা যেতো। এবার ধর্ম নির্বিশেষে সবাই । কম বেশি সব শ্রেণীর মানুষই দেশ ছাড়ছে।

মধু সাধু সকাল সন্ধ্যে হাততালি সহযোগে মন্ত্র পড়ে ঘুরে বেড়ায় গ্রামের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত। এই করে সে নাকি গ্রামকে বেঁধে রাখছে যাতে কোন অপশক্তি গ্রামে ঢুকতে না পারে। অন্ধকার আর কু-সংস্কারের সৌজন্যে তার এই কর্ম বেশ বিশ্বাসযোগ্যতাও লাভ করে গ্রামবাসীদের কাছে। রবীন্দ্রবাবু এতটা বিশ্বাসী এই মুহূর্তে হতে পারছেননা। কারণ ঘরে তার সদ্য আগত কন্যা নিয়তির কথায় তার মাথায় ভয় বাসা বেঁধে আছে। তবু বন্ধু মানুষের এ হেন উদ্যোগের প্রতি প্রকাশ্যে অনাস্থা বা অবিশ্বাস জানানোর মত অকৃতজ্ঞ বা সংস্কারমুক্ত তিনি নন। তা ছাড়া তারা এখন খুব বেশি পরস্পর নির্ভর।সারা গ্রাম খাঁ খাঁ করছে--কেউ নেই। শুধু এক প্রান্তে মধু সাধু অন্য প্রান্তে রবীন্দ্রবাবু। অমৃতপুরের মুরুব্বি মানুষেরা তাদের এই সাহসিকতার কোন অর্থ ধরতে পারছেন না। সাধারণ বুদ্ধিতে ধরা যায় যে মধু সাধুর বাড়িতে কোন যুবতী কন্যা সন্তান নেই । বয়স্ক ক-জনাই শুধু রাধা মাধবের সেবার জন্য বাড়িতে থাকছে। ফলে তারা যদি নিজেদের জীবনের পরোয়া না করেন তবে তাদেরকে অকুতোভয় বলা যায়ই। কিন্তু রবীন্দ্রবাবু--তারও কি তাই? না, ঠিক তা নয়। রবীন্দ্রবাবুর ঘরে এক কিশোরী কন্যা আছে, আছে তার সদ্য পালিয়ে আসা কন্যা নিয়তি, যে কিনা মাস সাতেকের পোয়াতি। ফলে দেখা যাচ্ছে যে তাদের দু-জনারই, যত বিপদই আসুক এই মুহূর্তে দেশ ছাড়া সম্ভব হচ্ছেনা। ফলে জনশূন্য গ্রামে এই কয় বাড়িতেই সন্ধ্যেয় প্রদীপ জ্বলতে দেখা যায় এখনও। তবে তা কিছুক্ষণের জন্য। কারণ সামান্য আলোর শিখাও রাত বিরেতে বিপদ ডেকে আনতে পারে।

অমৃতপুরের মানুষেরা এসব জানে। দিনে রাতে তারা এই দুই পরিবারের খোঁজ খবর নেয় । নিরস্ত্র নিষ্ক্রিয় হলেও মানুষেরা জানে আসল বিপদ, অর্থাৎ মিলিটারি, যদি এসে পড়ে তবে কোন সম্পর্কই কাউকে বাঁচাতে পারবেনা। গত কিছুদিন যাবত হঠাৎ হঠাৎ শোনা যাচ্ছে গুলির আওয়াজ। দিনে রাতে যখন তখন। আর শোনা মাত্রই বাড়ির পেছনের জঙ্গল হয়ে উঠছে সবার আশ্রয়। সেটা যে কোন অবস্থায় থাকা হলেও। সুপ্রভার কোমরে বাঁধা থাকে সামান্য স্বর্ণালংকার আর কিছু নগদ টাকা। তিনি নিজেত বটেই, টানা এই আতংকের কারণে বাড়ির সবার মধ্যে একটা আতঙ্কের চিহ্ন যেন ফুটে উঠছে। কথাবার্তায় আচারে ব্যবহারে একটা স্পষ্ট আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ছোট মেয়েটি পুকুর ঘাটে একদিন স্নান করতে গিয়ে দিনে দুপুরে শুনশান পুকুর ঘাটে ভয় পেয়ে দৌড়ে বাড়ি ফিরে আসলো । এসে কাঁপতে শুরু করলো। কী হয়েছে প্রশ্নের কোন উত্তর নেই তার কাছে। বাড়ির পেছনে আমগাছ তলায় গিয়ে বসে থাকে নিয়তি। কারও ডাকে সাড়া দ্যায় না। তার বাচ্চাকাচ্চাগুলোও খুব নীরব হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে সব চেয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন সুপ্রভা। সকালে ঘুম থেকে উঠেই তার মন ও শরীর পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তার মধ্যেই তার টানতে হয় সংসার। সংসারের উপরি কাঠামো ভেঙ্গে গেছে সেই কবেই। যখন গ্রাম শুদ্ধ একে একে সবাই দেশ ছাড়লো। ফলে এখন আর সমাজ বলে কোন বস্তু নেই। আছে শুধু সংসারের আর্ত প্রাণটুকু। আছে যখন তখন তাকেই বাঁচাতেও হয়। সারাদিন উৎকর্ণ হয়ে থাকতে থাকতে আর সংসারের চাকা ঘোরাতে হয়।

বর্ষার ক'মাস হয়ে গেল। খাল বিল হাওর অধ্যুষিত এই ভাটি অঞ্চলে মিলিটারিরা খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করেনি। শোনা গেছে মোহনগঞ্জ থেকে তারা তাদের পরিধি এদিকে বিশেষ বিস্তৃত করতে পারেনি। আর এই শ্রীমন্তপুরত আরো অগম্য। এখানে শুধু জল নয় রয়েছে বেশ জঙ্গলও। পায়ে হেঁটে এসে হত্যাকাণ্ড চালানোর ঝুঁকি বোধ হয় তারা নিতে চায়নি। তার উপর ভয় আছে মুক্তিযোদ্ধাদের। তাই তারা বোধ হয় অপেক্ষা করছে বর্ষা শেষের। রবীন্দ্র বাবু এর মধ্যেও সাধুর বাড়িতে যান।সকালের দিকে এক পাক ঘুরে আসেন। কেউ যেন আর ঠিক নেই।
                                                                                                             

[চলবে...]

আপনার মন্তব্য