বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ৪-৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২৫ ১৫:৩৫:৫৩

 আপডেট: ২০১৬-০১-২৯ ০০:২২:১৪

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]


তেরেজার তার মায়ের মতই হয়েছিল, এবং সেটা শুধুমাত্র দেখতেই নয়। আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে, তেরেজার সমস্ত জীবনটাই হয়তো ছিল তার মায়ের জীবনের ধারাবাহিকতা মাত্র; বিলিয়ার্ড টেবিলে কোনো বলের গতিপথ যেমন শুধুমাত্র খেলোয়াড়ের বাহুর সুনির্দিষ্ট অবস্থান পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা, অনেকটাই সেরকম।

কোথায় এবং কখন এটি শুরু হয়েছিল, যে গতিময়তা একসময় রূপান্তরিত হয় তেরেজার জীবনে?

হয়তো সেই সময়ে,যখন সবাইকে শোনানোর জন্য তেরেজার নানা, প্রাহার একজন ব্যবসায়ী,তার কন্যা, তেরেজার মায়ের সৌন্দর্য নিয়ে একটু বেশী মাত্রায় প্রশংসা করতে শুরু করেছিলেন ।তখন তার বয়স তিন অথবা চার, বাবা হয়তো তাকে বলতেন তার চেহারা রাফায়েলের ম্যাডোনার মত। তেরেজার চার বছর বয়সী মা বিষয়টি কোনদিনও ভুলতে পারেননি। কৈশোরে স্কুলে তার ডেস্কে বসে সে শিক্ষকদের কোনো কথাই শুনতো না; বরং সে ভাবতো কোন চিত্রকর্মের মত দেখতে তার চেহারা।

তারপর একসময় যখন তার বিয়ে করার সময় এলো, তেরেজার মায়ের পাণিপ্রার্থী ছিলেন মোট নয়জন।তারা সবাই তার চারপাশে নতজানু হয়ে তাকে বৃত্তাকারে ঘিরে থাকতো, মাঝখানে রাজকুমারী মত দাড়িয়ে তেরেজার মা, সে জানতো না এদের মধ্যে কাকে সে বেছে নেবে। একজন সবচেয়ে সুন্দর, অন্য একজন হয়তো সবচেয়ে বুদ্ধিমান, তৃতীয় একজন হয়তো ছিলো সবচেয়ে ধনী, চতুর্থ জন হয়তোবা সবচেয়ে ভালো খেলোয়াড়, পঞ্চম জন হয়তো বিখ্যাত কোনো পরিবারে ছেলে, ষষ্ঠ জন ভালো আবৃত্তিকার, সপ্তম জন অনেক দেশ ঘুরে বেরিয়েছে, অষ্টম জন বেহালা বাজাতে জানে, নবম জন ছিলো সবচেয়ে পুরুষালী। কিন্তু তারা সবাই একভাবে তার জন্য নতজানু হয়ে অপেক্ষা করেছে,তাদের হাঁটুতে সবারই ঠিক একই জায়গায় শক্ত হয়ে গিয়েছিল চামড়া।

এবং অবশেষে নবম জনকে যে কারণে তিনি নির্বাচন করেছিলেন, তার কারণ কিন্তু এমন কিছু নয় যে, সবার মধ্যে সে ছিল সবচেয়ে পুরুষালি বরং যখন তেরেজার মা তাদের সঙ্গমের সময় কানে কানে বার বার বলেছিলেন, ’সাবধানে, খুব সাবধানে’, সে উদ্দেশ্যমুলকভাবেই অসাবধানী আচরণ করেছিল এবং অবশেষে যখন কোনো চিকিৎসককে খুঁজে পাওয়া গেল না, যে কিনা গর্ভপাত করাতে রাজী আছে, তেরেজার মা তখন তাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সুতরাং তেরেজারও জন্ম হয়েছিল। অগণিত আত্মীয় স্বজন যখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে এসে তার বিছানার চারপাশে জড়ো হয়ে ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখে আহ্লাদিত শিশুদের মত স্বরে কথা বলছিল; তেরেজার মার মনে কিন্তু  কোনো আনন্দই ছিল না, তার স্বরে কোনো আহ্লাদ ছিল না। তেরেজার মা শুধু বাকী আট জন সম্ভাব্য প্রার্থীর কথাই ভাবছিলেন, যাদের সবাই হয়তো বা তার নবম পছন্দের চেয়ে আরো বেশী উত্তম হতে পারতো।

তার মেয়ের মতই, তেরেজার মাও প্রায়শই আয়নার দিকে তাকাতো। একদিন এভাবে অকস্মাৎ তার চোখের নীচে চামড়ার কুঁচকানো ভাজ নজরে পড়েছিল তার এবং তখনই সিদ্ধান্ত নেন, তার বিয়ের আসলেই কোনো অর্থ হয়না। এই সময়টাতে তেরেজার মায়ের সাথে পরিচয় হয় অপুরুষালি এক পুরুয়ের সাথে, যে ইতিমধ্যে বেশ কিছু প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে, এছাড়া দুটো ব্যর্থ বিবাহ তো আছেই। তখন তেরেজার মার ঘৃণার বিষয় ছিল হাঁটুর চামড়া শক্ত হয়ে যাওয়া সেই সব প্রাক্তন পানি প্রার্থীরা। তার তখন তীব্র আবেগময় বাসনা  একটাই, অন্যদের পরিবর্তে এবার না হয় নিজের নতজানু হওয়াই জরুরী। সে যথারীতি নতজানু হয়েছিল তার এই প্রতারক বন্ধুর কাছে এবং স্বামী এবং তেরেজাকে ফেলে সে তার সংসার ত্যাগ করে এই লোকটি হাত ধরে।

সব পুরুষের মধ্যে সবচেয়ে পুরুষালি তার সেই পরিত্যক্ত স্বামী খু্বই মর্মাহত হন। তিনি  এতই মর্মাহত হন যে তার কাছে কোনকিছুরই অর্থ আর আগের মত ছিল না। সুতরাং কোনকিছুকে পরোয়া না করে, তার মনে যখনই যা আসতো তাই তিনি বলতে শুরু করেন। এবং কমিউনিস্ট পুলিশরা, তার মন্তব্য করার দুঃসাহস দেখে বিস্মিত হয়ে প্রথামত তাকে গ্রেফতার করে, বিচার করা হয় এবং বেশ লম্বা সময়ের কারাদণ্ডে তাকে দণ্ডিতও করা হয়। কমিউনিস্ট পুলিশ তার ফ্ল্যাটটি দখলে নেয় এবং শিশু তেরেজাকে তার মায়ের কাছে পাঠানো হয় থাকবার জন্য।

এই বিষন্নতম মানুষটি কিছুদিন কারাগারে থাকার পর হঠাৎ করেই মারা যান এবং তেরেজা ও তার মা এরপর একটি পাহাড়ী  ছোট শহরে সেই প্রতারক বন্ধুর সাথে বসবাস করা শুরু করেন। এই লোকটি একটা অফিসে চাকরী নেয় প্রথম, এবং তার মা জোগাড় করে একটি দোকানের চাকরী । তেরেজার মা আরো তিনটি সন্তান প্রসব করেন। তারপর আবার তেরেজার মা আয়নায় নিজেকে আবার লক্ষ্য করে দেখেছিলেন, তবে এবার তিনি আবিষ্কার করেন তিনি বৃদ্ধ এবং কুৎসিত।


তেরেজার মা যখন উপলব্ধি করেতে পারেন যে সবকিছুই তিনি হারিয়েছেন, তার নিজের সেই সর্বনাশের জন্য দায়ী একজন দোষীকে খোজার প্রক্রিয়াটা তিনি শুরু করেছিলেন। যে কেউই সেটা হতে পারে: তার প্রথম স্বামী, পুরুষালী তবে ভালোবাসা বঞ্চিত, যে তার ফিস ফিস করে বলা সাবধানবানী একদিন উপেক্ষা করেছিল; তার দ্বিতীয় স্বামী, অপুরুষালী এবং যথেষ্ট ভালোবাসায় সিক্ত, যে তাকে প্রাহা থেকে টেনে নিয়ে এসেছে এই ছোট মফস্বল শহরে এবং তাকে একটি অবিচ্ছিন্ন স্থায়ী ঈর্ষা পীড়িত অবস্থার মধ্যে রেখেছে একটার পর একটা রমণী সাথে সম্পর্ক গড়ে যাবার মাধ্যমে। কিন্তু  এদের দুজনের বিরুদ্ধেই সে শক্তিহীন। যে একটি মাত্র মানুষ সম্পূর্ণ তার এবং যার কোন পালাবার উপায়ই নেই, তার যে বন্দী এই অপরাধীদের জন্য প্রায়শ্চিত্ত করতে পারবে, সে ছিল তার তেরেজা।

আসলেই, তার মায়ের নিয়তি  নির্ধারণে তেরেজা কি প্রধান আসামী ছিল না? তেরেজা, যে কিনা সবচেয়ে পুরুষালি পুরুষের শুক্রাণু  এবং সবচেয়ে সুন্দরী নারীর ডিম্বাণুর সেই অদ্ভুত সাক্ষাৎ? হ্যাঁ, সেই নিয়তি নির্ধারক সেকেন্ডে, যার নামকরণ করা হয়েছিল তেরেজা, সেই খারাপভাবে নিষ্পন্ন হওয়া দূর পাল্লার দৌড়, তার মায়ের জীবনের সূচনা হয়েছিল।

তেরেজা মা কখনোই তাকে মনে করিয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকেননি যে একজন মা হওয়া মানে সবকিছুকে বিসর্জন দেয়া। তার শব্দগুলোয় সত্যের প্রতিধ্বনি আছে, যার সাক্ষ্য প্রমাণ হিসাবে ছিল একটি নারীর অভিজ্ঞতা যে তার সবকিছু হারিয়েছিল তার সন্তানের জন্য। তেরেজা তার মায়ের কথা শুনতো এবং বিশ্বাস করতো যে মা হওয়া - জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছুকে অর্জন করা এবং মা হওয়া মানে অনেক মহান একটি আত্মত্যাগ। যদি একজন মা আত্মত্যাগের মূর্তপ্রতীক হয়ে থাকে, তাহলে একজন কন্য হচ্ছে অপরাধ, যা সংশোধন করার কোনো সম্ভাবনাই নেই।

[চলবে...]

আপনার মন্তব্য