বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ৬-৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-২৯ ০০:২৮:২৪

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]


অবশ্যই, তেরেজার জানা ছিল না সেই রাতের কাহিনী, যখন তার মা তার বাবার কানে ফিসফিস করে বলেছিল, ’সাবধানে; তেরেজার অপরাধী বিবেক তাই আদি পাপের [২] মতই অস্পষ্ট। কিন্তু এর থেকে তার মুক্তি পাবার জন্য যা কিছু করার দরকার সে তা করেছে। পনেরো বছর বয়সেই তার মা তাকে স্কুল ছাড়িয়েছিল এবং ওয়েট্রেস হিসাবে কাজ শুরু করতে হয় তখন থেকেই, তার আয়ের সবটুকু সে তার মার হাতে তুলে দিতে হয়েছে। তার মায়ের ভালোবাসা পাবার জন্য যা করার দরকার সবকিছু করার জন্য প্রস্তুত ছিল সে। পুরো সংসারের দেখাশোনা করেছে,তার ভাইবোনের যত্ন নিয়েছে, প্রতি রবিবার সারাটা দিন সে পার করেছে ঘর পরিষ্কার করে আর সবার কাপড় ধুয়ে।খুবই দুঃখজনক বিষয়, কারণ তার ক্লাসে সে ছিল সবচেয়ে মেধাবী। আরো বেশী কিছু হবার ইচ্ছা ছিল তেরেজার, কিন্তু সেই ছোট্ট শহরে তার জন্য এর চেয়ে বেশী কিছু ছিল না। যখনই সে কাপড় ধুতে যেত,  টাবের পাশে একটি বই রাখতো সে, যখন সে পাতা উল্টাতো, কাপড় ধোয়ার পানি উপচে পড়ে প্রায়ই সেই বই ভিজিয়ে দিত।

তেরেজাদের বাসায়, লজ্জা বলে এমন কোনো কিছুরই অস্তিত্ব ছিলনা। ছোট ফ্ল্যাটে তার মা অন্তর্বাস পরেই হাটা চলা করতেন, কখনো ব্রা ছাড়া, কিংবা কখনো খু্ব গরমের দিনে,পুরোপুরি নগ্ন হয়ে। তার সৎ বাবা অবশ্যই নগ্ন হয়ে ঘুরতেন না, কিন্তু যখনই তেরেজা গোছল করতে ঢুকতো, সেও প্রতিবার বাথরুমে ঢুকত। একবার তেরেজা বাথরুমের দরজা লাগিয়ে ছিল শুধু এবং তার মা খুবই রেগে যায়, ‘তুমি নিজে কি মনে করছো, শুনি? মনে করেছো তোমার সৌন্দর্য সে কামড় দিয়ে খেয়ে নেবে?’

(এই বাদানুবাদ স্পষ্টতই প্রমাণ করে মেয়ের প্রতি তার ঘৃণা আসলেই তার স্বামীর প্রতি সন্দেহ থেকে অনেক বেশী। তার কন্যার অপরাধ অসীম এবং তার স্বামীর অবিশ্বস্ততাগুলোও তার অংশ। তেরেজার নিজেকে মুক্ত করার ইচ্ছা, তার অধিকারের প্রতি জোর দাবী – যেমন গোছল করার সময় দরজা বন্ধ করার অধিকার – তেরেজার মার কাছে অনেক বেশী অগ্রহণযোগ্য  ছিল, এমনকি তার স্বামীর তেরেজার প্রতি বিকৃত কামবাসনায় আগ্রহী হয়ে ওঠার সম্ভাবনার চেয়েও বেশী)।

একবার তেরেজার মা, শীতকালে, ঘরে যখন আলো জ্বলছে, তখন নগ্ন হয়ে থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তেরেজা দৌড়ে গিয়ে খুব দ্রুত জানালার সব পর্দা টেনে দিয়েছিল, যেন রাস্তা থেকে কেউ কিছু না দেখতে পারে। এ কাজ করার সময়ই সে তার মায়ের অট্টহাসি শুনতে পায়। পরের দিন যখন তার মায়ের কয়েকজন বন্ধু বেড়াতে এসেছিল: একজন প্রতিবেশী, একজন মহিলা যার সাথে তার মা কাজ করে, একজন স্থানীয় স্কুল শিক্ষিকা, এছাড়া আরো দু তিন জন মহিলা,যারা প্রায়ই একসাথে জড়ো হতো। তেরেজা এবং তাদের কোনো একজনের ষোল বছরের ছেলে একটি পর্যায়ে যখন সেই ঘরে ঢুকেছিল তাদের সম্ভাষণ জানাতে, তার মা বন্ধুদের উপস্থিতিতে  সাথেই সাথেই সুযোগ নেয় বর্ণনা করতে কেমন করে তেরেজা তার সম্ভ্রম রক্ষা করার চেষ্টা করেছিল সেদিন; তার মা হাসছিল, এবং অন্য মহিলারাও তার সেই হাসিতে যোগ দেয়।  তার মা অভিযোগ করে বলে,তেরেজা কিছুতেই মানতে পারেনা,যে মানুষের শরীর প্রস্রাব করে, বায়ু ত্যাগ করে। লজ্জায় লাল হয়ে যায় তেরেজা, কিন্তু তার মা থামে না, ‘এতে এত লজ্জা পাবার কি আছে?  নিজের করা এই প্রশ্নের উত্তরেই যেন তার মা শব্দ করে বায়ুত্যাগ করে। সব মহিলারা আবারো একসাথে হেসে উঠে।


তেরেজার মা বেশ শব্দ করেই তার নাক পরিষ্কার করতো, তার নিজের যৌন জীবন নিয়ে খোলামেলা ভাবে কথা বলতো সবার সাথে, এবং সে তার বাধানো নকল দাঁত খুলে সবাইকে দেখাতেও  দারুণ পছন্দ করতো এবং জিভ দিয়ে সেই বাধানো দাঁতগুলো আলগা করার ব্যাপারে তার ছিল দারুণ দক্ষতা। এবং সাধারণত হাসির মাঝখানে সে উপরের দাঁতের পাটিটিকে নিচের পাটির সাথে এমন ভাবে ফেলতে পারতো যে তার চেহারায় ফুটে উঠতো ভয়ঙ্কর অশুভ একটি অভিব্যক্তি।

তেরেজার মায়ের এই আচরণগুলো মূলত একটি একক ইঙ্গিতের প্রকাশ, সৌন্দর্য আর যৌবনকে পরিত্যাগ করা। সেই দিনগুলোয় যখন নয়জন প্রেমিক তাকে বৃত্তাকারে ঘিরে নতজানু হয়ে প্রেম ভিক্ষা করতো, তখন সে তার নগ্নতাকে আতঙ্কের সাথেই পাহারা দিত, যেন সে তার দেহের মূল্যকে প্রকাশ করার চেষ্টা করছে এর প্রতি প্রদর্শিত তার নম্রতা বা লজ্জার মানদণ্ডে। এখন ভদ্রতা বা লজ্জাবোধই সে শুধু হারিয়েই ফেলেনি, যেন চুড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘোষণা করেছে তাদের সাথে এবং আনুষ্ঠানিকতার সাথে সে তার নতুন এই নির্লজ্জতাকে ব্যবহার করেছে জীবনে নতুন একটি বিচ্ছেদরেখা অংকন করার জন্য এবং ঘোষণা করেছে যে যৌবন এবং সৌন্দর্য  আসলে মূল্যহীন, যাকে অতিমুল্যায়ন করা হয়।

আমার কাছে তেরেজাকে মনে হয়, তার মায়ের এই মানসিকতারই একটি ধারাবাহিকতা, যার মাধ্যমে তার মা একজন যুবতী সুন্দরী হিসাবে তার জীবনকে পরিত্যাগ করেছে,অনেক দুর অতীতেই যা সে ফেলে এসেছে ।

(এবং যদি তেরেজার কোন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বা ইতস্তত আচরণ চোখে পড়ে,তার অন্যান্য আচরণ যদি সহজ সৌন্দর্যের কোন অভাব থেকে থাকে, আমরা যেন অবশ্যই অবাক না হই। তার মায়ের বড় দাগের, উন্মত্ত , আত্মবিনাশী আচরণ তেরেজার উপর অমোচনীয় একটি প্রভাবের চিহ্ন রেখে গেছে।)

টিকা:
[২] অরিজিনাল সিন বা অ্যানসেস্ট্রাল সিন একটি খ্রিস্টীয় মতবাদ। যার সারকথা সমস্ত মানবতা পাপী হয়েই জন্ম নেয়, আর এই পাপটির সূচনা স্বর্গে আদমের ঈশ্বরের কথা অমান্য করে যখন জ্ঞান বৃক্ষের ফল খেয়েছিল।

(চলবে..)

আপনার মন্তব্য