ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ৩

পশ্চিমবঙ্গের লেখক রাজা সরকারের স্মৃতিচারণমূলক লেখা 'ফিরে দেখা এক জন্ম-কথা', যেখানে ওঠে এসেছে একাত্তর এবং সে সময়কার সমাজ, রাজনীতিচিত্র ও মানুষের দুর্ভোগ এবং ওঠে আসার বিস্তারিত বর্ণনা। দীর্ঘ এ লেখাটি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্যে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-৩১ ১২:০০:২৫

 আপডেট: ২০১৬-০১-৩১ ১২:২৫:১৫

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

নিয়তি মাঝে মাঝে ভাবে সে কি ভেতরে ভেতরে পাথর হয়ে যাচ্ছে। মাথা তার কেমন খালি খালি লাগে। গুলির শব্দ শোনা মাত্র সে মন্ত্র-চালিতের মতো উঠে পালায়। সবসময় যে স্বামী বা বাচ্চাগুলোর খোঁজ করে তাও না। ভারি পেট নিয়ে পালাতে যাওয়ার সময় কেউ তাকে সাবধানও করে না। যদিও কথা সবারই কমে গেছে, তবুও তো তার মা--, সুপ্রভা তার সঙ্গে কেন কথা বলেন না !এর আগে কতবার সে পিতৃগৃহে এসেছে মনে নেই। বিবাহিত কন্যা মায়ের কাছে আসলে সবচেয়ে সুখের ব্যাপার হয় মায়ের। কত সুখ দুঃখের কথা থাকে তাদের। একটু ভাল মন্দ খাওয়ানো। মেয়েকে ভারি কাজ করতে না-দেয়া। পুকুর থেকে স্নান করে এলে কাপড়টা পর্যন্ত শুকোতে দেয়ার কাজটাও মা করে দিতে চান। বাচ্চাকাচ্চাদের ঝক্কি ঝামেলা সব সামলানোও যেন মা'র হাতে। যে কটা দিন মায়ের কাছে থাকবে আদরে সুখে থাকবে--এটাই মায়ের ইচ্ছে। সব মাতৃ-হৃদয়ে বোধ হয় এই জায়গাটা মেয়েদের জন্য থাকে। শত পুরুষতান্ত্রিকতার মধ্যে মা তার হৃদয়ের এই জায়গাটা বাঁচিয়ে রাখতে চান। অন্তত যতদিন পারেন। কিন্তু মায়ের এই তেমন কথা না-বলাটা এই বারই নিয়তি লক্ষ্য করেছে। এতো বিপদ ডিঙ্গিয়ে মেয়ের আসা,তার উপর সে পোয়াতি,তারপরও মায়ের এই নির্লিপ্ততা কেমন যেন খটকা লাগে নিয়তির। কিন্তু এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে যে দু-দণ্ড বসে কথা বলবে তার ফুরসৎ কোথায়। বাড়িতে থাকলেও যে সবাইত দৌড়ের উপরই আছে।

নিয়তির স্বামী দিবাকর যে সারা দিনমান কোথায় থাকে, কোথায় সময় কাটায় সব সময় বোঝা যায় না। এমনিতে সে অনেকটা আড়াল নিবাসী মানুষ। লাজুক,ভীতু ,স্ত্রী-নির্ভর,-তায় আবার শ্বশুর বাড়িতে আপাত আশ্রিত। দেশে গোলমাল শুরু হওয়ার সময় সে টানা দু'তিন সপ্তাহ টাইফয়েডে ভোগে এখন আরো যেন আড়ালে চলে গেছে। কথা বলতে না হলে যার ভাললাগে, তার এই রকম বাড়ির পরিবেশে বেশ সুবিধেই হলো মনে হয়। রাতে তাদের আলাদা শোয়ারও পাট নেই। হন্যমান মানুষদের যেন একঘরে একসাথে শোয়ারই কথা। গোটা-তিনেক তক্তপোষের উপর ভাগাভাগি করে তাই তারা সবাই একঘরে থাকে। নিয়তির এই স্বামীটিকে নিয়ে কোন সমস্যা নেই বটে, কিন্তু এইরকম বিপদের দিনে একজন পুরুষ মানুষের অনেক কর্তব্য থাকে। কিন্তু দিবাকরের উপর কোন ব্যাপারেই ভরসা করা যায় না। সেই সময় মুক্তাগাছা থাকার দিনগুলোতো শরীরে জ্বর নিয়ে তাকে পালিয়ে পালিয়েই থাকতে হয়েছে। এখনও তার শরীরের যা অবস্থা তাতে কোন ভারি কাজও তার পক্ষে সম্ভব নয়। নিয়তি তাই ভাবে যে তার স্বামী তেমন ভরসা-যোগ্য হলে এই বাপের ভিটেতে এসে আশ্রয় না নিয়ে অন্যদের মত বর্ডারের দিকেই হয়তো চলে যেতো। নিয়তি আক্ষেপ করে মনে মনে যে চাইলেই কি আর দেশছাড়া যায়। তার উপর তার নিজের শরীরের এই অবস্থা।

এদিকে দিনের পর দিন নিয়তি লক্ষ্য করে যাচ্ছে রান্না ঘরে মায়ের নিঃশব্দ কান্না। অথচ মা কিছুই বলেন না। কিছু জিজ্ঞেস করলে সেই কান্না ফোঁপানিতে রূপান্তরিত হয়। যদিও এই অবস্থাটা বেশিদিন চললনা। কারণটা একদিন প্রকাশ পেয়ে গেল। আর সেটা তার বাবার সঙ্গে মায়ের কথা কাটাকাটিতে। তাতে পরিষ্কার হয়ে গেল তার মা'র এমত আচরণের কারণ আসলে গ্রামের অন্যান্যদের সঙ্গে বর্ডারের দিকে তাদের একসঙ্গে যেতে না পারা। এই যেতে না-পারাটা যে তার কাছে কতটুকু হতাশার সেটা এ-জগতের আর কেউ অনুভব করতে পারবে না। দেশের এই অবস্থা শুরুর কিছুদিন পরেই যখন সবাই বুঝে গেল যে না এটা কোন সাধারণ গোলমাল নয়, এটা সহজে মিটে যাবে এমনও নয়, এই গোলমালে দেশজুড়ে মানুষের মৃত্যু-মিছিল শুরু হয়েছে, তাতে তাদেরও হয়তো একদিন সামিল হতে হবে, তখন একটা বাঁচার চেষ্টাতো করতে হবে। কিন্তু বাঁচার চেষ্টাটা কোথায়? সারা জীবন ধরে যে মানুষটির সঙ্গে সে ঘর করছে তার কথা আর কী বলবে--সে কি কোনদিন বুঝবে বড়গুলোর সঙ্গে ছোট ছেলে দুটোকেও হাত ধরে যেদিন দেশছাড়ার জন্য ছেড়ে দিতে হয়েছিল অনিশ্চিত এক জীবনের দিকে, তাদের মুখ না দেখে একজন মা কীভাবে মরে! সেদিনও তো ঐ কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল নিরাপত্তার কথা ভেবেই। আর আজও তো নিরাপত্তাই একটা বড় কারণ। নিরাপত্তার ছায়া থাকলে আমিই কি আর এতো উতলা হয়ে পড়তাম! এখন দেশজুড়ে সবাই মার খাচ্ছে--একসময় তো হিন্দু বলে শুধু আমরাই  মার খেতাম। সংসারটাও তো এই ভয়-ভীতি নিরাপত্তার অভাব থেকেই ভাঙলও। কিন্তু সংসারের কর্তার সে-দিকে চোখ কই। এখন এই অবস্থায়ও কেমন যেন নির্বিকার। সব শরিকসহ গ্রামের সবাই যখন গ্রাম শূন্য করে চলে গেল তখন আমরা কার ভরসায়, কীসের ভরসার রয়ে গেলাম?

বিপদ মাথায় নিয়ে যেদিন নিয়তি এ বাড়িতে এসে পৌঁছুল সেদিন নিয়তি লক্ষ্য করেনি যে তার বাবা মা'র তখন এ বাড়িতে থাকার কথা নয়। তাদেরও বর্ডারের দিকে চলে যাওয়ার কথা। তারা চলে গেলে নিয়তির বড় কোন বিপদ হতেই পারতো। মাত্র দুদিন আগে গ্রাম খালি হয়েছে। সুপ্রভা তখনো হাল ছেড়ে দেননি। স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা তখনও নানা ভাবে করে যাচ্ছেন। আর ঠিক এই সময়ই স্বামী সন্তানসহ নিয়তির এ বাড়িতে আসা। আর এ আসা যে কী, কত বিপদের ভেতর দিয়ে আসা--সুপ্রভা শুনে শিউড়ে উঠলেও নিয়তির জন্য তার সেই অনুভূতি কোথায়--এই মা কি সেই মা নয়? এভাবে এখানে চলে আসাটা কি তা হলে ভুল হয়েছে? ভারি শরীর নিয়ে নিয়তি যখন এসব ভাবতে বসে তখন যেন তার খরখরে চোখ একটু জলের জন্য হাহাকার করে। দিনের বেলা যতটা সম্ভব বেশি সময় সে বাড়ির পেছনের জঙ্গলের কাছাকাছিই সে বসে থাকে। এ যেন ভুত-প্রেতের জীবন শুরু হয়েছে তাদের।


নিয়তির দুই পা'য়ে জল আসছে। গর্ভাবস্থার এই পর্যায়ে নাকি এমনটা হতে পারে। এই সময় প্রসূতির জন্য অনেক কিছু দরকার। সুস্থ পরিবেশ, ভালো খাওয়াদাওয়া, বিশ্রাম--ইত্যাদি। কিন্তু বঙ্গদেশের নিম্ন কোটির মায়েদের কাছে এগুলো বিলাসিতা। তার উপর বর্তমান অবস্থায় এগুলো নিয়ে কেউ ভাবে না। নিয়তিও ভাবেনা। অর্থাৎ ভাবার সময় কোথায়-- নিজের প্রাণ বাঁচলে তো গর্ভস্থ সন্তানের প্রাণ নিয়ে ভাববে। কিন্তু শরীর, শরীরের অভ্যন্তরে যে অন্য এক শরীরের সাড়া। তাকে কে অস্বীকার করতে পারে ! সে কি টের পাচ্ছে তার গর্ভধারিণীর অবস্থা--সারা দেশ জুড়ে অসংখ্য মা বাবা ভাইবোনদের মতো তার মা'ও তাকে পেটে নিয়ে পলায়নপর এক জীবন বেছে নিয়েছে? নিয়তি অস্বস্তি গোপন করেই চলে। মনের ঝড় থেকে শরীরকে আলাদা করে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা সে চালিয়ে যায়। জানেনা একদিন বা একমুহুর্ত পরের পরিণতি কী হবে। তবু এরমধ্যেই রিনরিন করে বেঁচে থাকার স্বাদটা সে মাঝে মাঝে উপলব্ধি করে। মুক্তাগাছা থেকে খুন অথবা ধর্ষণ এড়িয়ে যে সে এই পর্যন্ত আসতে পেরেছে এটাই কি কম কথা! শোনা যায় সারা দেশজুড়ে এখন শুধু খুন আর নারী ধর্ষণ। এক-দেশ মানুষের বিমূঢ় হাহাকার শুধু বাতাসে।  

খুব কম কথার মানুষ বাবাকে একদিন নিয়তি জিজ্ঞেস করে বসলো যে কেন তারা অন্যান্যদের সঙ্গে চলে গেলেন না- মা এত কান্নাকাটি করছে--চলে গেলেই ত ভালো হতো। বাবা প্রশ্ন শুনে কিছু বলার জন্য যেন কিছুটা সময় নিলেন।--সবার লগে যাই নাই কথাটা ঠিকই---সবটা ত আর আমার ইচ্ছায় হয় না--তাঁর(ঈশ্বর) ইচ্ছা ছাড়া কি কিছু করণ যায়?--তা না হইলে এই সময় তর আওনের কথা না থাকলেতো তর আইতে হইলো--আর এখন তরে এই অবস্থায় কোথায় রাইখ্যা যাই। নাকি যাওয়া সম্ভব। নিয়তি পাল্টা বলার মত বলতেই পারতো--কিন্তু বাবার কথার পিঠে কথা বলার মত স্বভাব তাদের কারোরই নেই। কারণ এইটুকু কথা বলতে বলতে বাবার যে অসহায়তা ধরা পড়লো তাতে আর ইচ্ছাও করলো না। চুপচাপই বাবার সামনে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। তবে নিয়তি মনে মনে ভাবতে লাগলো বাবা তাদের না-যাওটাকে আমার হঠাৎ করে চলে আসাটাকে দিয়ে ঢাকতে চাইছেন--এটা যেন অনেকটা খড়কুটো ধরে বাঁচার চেষ্টা। বাবার অসহায়তাটা অনুভব করে মনে মনে নিয়তি ভাবতে লাগলো বাবাকে তাঁর এই অপরাধবোধ থেকে বাঁচাতে কিছু একটা তাকেই করতে হবে।

বর্ষা শেষের দিকে। শরতের আবহাওয়া চারদিকে। কিন্তু এই অঞ্চলের মানুষের মনে নতুন করে আবার যেন বিপদের মেঘ ঘনিয়ে আসছে। শোনা যাচ্ছে চারদিকে খাল বিল হাওরের জলে টান পড়লেই মিলিটারিরা তাদের আক্রমণ আরো ছড়িয়ে দেবে। এখন পর্যন্ত যে-সব জায়গায় যাওয়া হয়নি সে-সব জায়গার হিসেব বুঝে নেবে। বর্ষার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে অনেক জায়গাতেই তারা পেরে উঠেনি। সেটা এবার পুষিয়ে নেবে। এতদিন জলই যেন এই অঞ্চলের রক্ষক ছিল। জল সরে গেলেই যেন এখানকার এতদিনের নিরাপত্তায়ও টান পড়বে। নিয়তির দুশ্চিন্তার আর শেষ নেই।

অধীর মাঝি অনেক দিনের চেনা মানুষ। এ বাড়ির সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রায় আজন্ম। এই সময় সে অনেককেই বর্ডার পর্যন্ত পার করে দিয়ে এসেছে। এই অঞ্চলের জলপথ তার হাতের তালুর মতো চেনা। ইদানীং আবার মিলিটারি বা তাদের দোসরদের গতিবিধি সম্বন্ধেও তার একটা ধারনা তৈরি হয়েছে। এখন পর্যন্ত সেই কারণেই হয়তো কোন বড় বিপদ তার হয়নি। মুখে কিছুটা অবিন্যস্ত দাড়ি রেখে সে তার বেশবাসও কিছু পরিবর্তন করে নিয়েছে। সহকারী হিসেবে নিয়েছে পুত্রসম হানিফকে। তার কাছ থেকেই শুনে শুনে মুখস্থ করে নিয়েছে কলেমার কয়েক লাইন। ফলে এই অঞ্চলে তার মতো নির্ভরযোগ্য মাঝি আর নেই। নিয়তি তার সেই অধীর কাকার সঙ্গে একদিন দেখা করে কিছু কথা বার্তা বলে এলো। ভারি হয়ে আসা পা দুটো নিয়ে তার বেশি হাঁটাও প্রায় অসম্ভব। তবু সে গিয়েছিল অধীর কাকুর বাড়িতে। এই গ্রাম ও তার সন্নিহিত অঞ্চল তার আজন্ম চেনা। তবু আজকাল বাড়ির বাইরে বেরোতে ভয় ভয় লাগে। অধীর কাকু বারণ করে দিয়েছে যে তার এভাবে আর আসার দরকার নেই। এরমধ্যে রাতের দিকে একদিন সে তাদের বাড়িতে গিয়ে সব শুনে বন্দোবস্ত করে আসবে। এই কথা শুনে মুখে কিছু না বললেও নিয়তি মনে মনে প্রমাদ গুনলো । কারণ অধীরকাকু বাড়িতে গেলেই তার পরিকল্পনা প্রকাশ হয়ে পড়বে। কিন্তু কিছু করার নেই। কারোর অলক্ষ্যে বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়াতো আর সম্ভব নয়।


মিলিটারি আসবে, মিলিটারি আসবে---করেই দিন কাটে। নিয়তির একদম কোলের ছেলেটার মুখে 'মেলেটারি' শুনেও কেউ আর এখন হাসেনা। দিনের বেলায় ঘরে থাকার অভ্যাসটা ক্রমে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবু রান্নাতো করতে হয়। আর সেটা ঘরেই করতে হয়। তাই সুপ্রভা যখন রাঁধেন বাইরে পাহারা দেয় নিয়তি। ঘরের পেছনে জঙ্গল লাগোয়া একটা জায়গা ঠিক করা আছে। সেখানে সে তার ভারী পা আর পেট নিয়ে দিনের অনেকটা সময় কাটায়। সামনে বাচ্চারা খেলে। বাচ্চারা যথাসম্ভব কম চেঁচামিচি করতে শিখে গেছে। এভাবে দিন কি কাটে—কাটেনা। নিয়তি ক্রমেই আরো উদাসীন হয়ে পড়ছে। সারাদিন দিবাকর কোথায় থাকে তার খোঁজ পর্যন্ত সে আর রাখেনা। বাপের ভিটেতে আসার পর সে যেন নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত হয়ে পড়েছে।

এই রকম সময় একটি দিনের সকাল শুরু হয় একটু অন্য ভাবে। গ্রামের সরকারি রাস্তায় সকাল থেকেই মানুষের জটলা। কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে সকালের আলস্যভাব যেন সকলেই খুব দ্রুত ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে। আর ঝেড়ে ফেলে সকলেই রাতে গুলির শব্দ শুনে ভয় পেয়ে নিজের ভেতর আরো সেঁধিয়ে যাওয়ার চেষ্টার স্মৃতিও মুছে ফেলতে চাইছে। তবে খুব দ্রুতই সাব্যস্ত হয়ে গেল যে রাতে ওটা গুলির শব্দই ছিল আর গ্রামের পেছন দিকে পরে থাকা চারটে লাশের গায়ে গুলির চিহ্নগুলোর সঙ্গে রাতের ঐ শব্দের সম্পর্ক আছে। ভাল কি খারাপ বোঝা যাচ্ছেনা যে ওই চারটি লাশের কেউ এই গ্রামের নয়। একজন পাশের গ্রামের সনাক্ত করা গেলেও বাকি তিনজন একদম অচেনা।

বিগত ক’মাসের অস্বাভাবিক জীবন যাপনের ফল মানুষের চিন্তাশক্তিতেও প্রভাব ফেলেছে। একটা বিষয় নিয়ে কেউ বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না। কেউ বেশিক্ষণ ভাবতে চাইলে বা প্রশ্নাদি করতে থাকলে তাকে থামানোর উপায় এখন একটাই-- হালার বান্দির পুত, চুতমারানি-- ইত্যাদি বিশেষণ প্রয়োগ করা।  তাতে ইদানীং কেউ আর তেমন রাগও করছে না। গ্রামের সামনের রাস্তা জুড়ে গ্রামেরই মানুষ। গ্রামের পেছন দিকের ক্ষেতের মধ্যে পড়ে থাকা লাশ কেউ দেখতে যাচ্ছে,কেউ দেখে এসে এটা সেটা বলছে। সবই যার যার উপলব্ধি। তার মধ্যে ভিন্ন পাড়ার কারোর বয়ান শুনে  আসার নামে নানা রকম গুজবও আমদানি হচ্ছে। ওদিকে লাশের কাছে ভিড়টা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ হালকা হয়ে আসছে। লাশ দেখে ফেরত আসা মানুষদের মধ্যে একসময় দেখা গেল গ্রামেরই দুই মুরুব্বী। তারাও লাশ দেখে ফিরছেন। তারা নিশ্চয়ই কোন মন্তব্য করবেন। তাদের কথার দাম আছে। তা শোনার আশায় রাস্তার ভিড় যেন একটু জমাট হয়ে গেল। কিন্তু মুরুব্বীরা মন্তব্যের বদলে যেতে যেতে সবাইকে রাস্তা থেকে সরে যেতে বললো। বললো এই বিপদের সময় রাস্তায় ভিড় করে থাকা ঠিক না,কখন মিলিটারি আসে--। বলে তারা নিজেদের বাড়ির পথেই চলে গেল । ভিড়ের মুখে যেন চুন পড়লো। দুপুর নাগাদ স্থানীয় থানার চারজন পুলিশ সঙ্গে সাদা পোশাকের আরো চারজন এসে লাশ চারটা একটা গরুর গাড়ীতে চাপিয়ে নিয়ে চলে গেল।পাশের গ্রামের মুখ চেনা লাশটার বাবা মা ভোর থেকে ঠায় বসে থেকে থেকে এখন শেষমেশ গরুর গাড়ির পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করলো। এখন আর তারা কাঁদছেনা। তবে মাঝে মাঝে বুক থেকে হু হু করে একটা আওয়াজ বের হচ্ছে যেতে যেতে। তাতে পুলিশেরা বিরক্ত হলেও ধমক দিচ্ছে না।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য