ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ৪

পশ্চিমবঙ্গের লেখক রাজা সরকারের স্মৃতিচারণমূলক লেখা 'ফিরে দেখা এক জন্ম-কথা', যেখানে ওঠে এসেছে একাত্তর এবং সে সময়কার সমাজ, রাজনীতিচিত্র ও মানুষের দুর্ভোগ এবং ওঠে আসার বিস্তারিত বর্ণনা। দীর্ঘ এ লেখাটি সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম পাঠকদের জন্যে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০১ ২০:০৬:০৭

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

রবীন্দ্রবাবুর বাড়িতে সকালের ভাত খাওয়া হয়নি। কারণ রান্না হয়নি আজ। যেহেতু তাদের বাড়িটা গ্রামের শেষ বাড়ি, তাই ভোর থেকেই মানুষের আনাগোনা চলছে তাদের বাড়ি ঘেঁষে। বাড়ির পেছন দিকের ক্ষেতে পড়ে থাকা লাশ দেখতে যাওয়া-আসার এটাই সহজ পথ। আজ সকালে যে খাওয়া হয়নি তার পটভূমি গত রাতেই তৈরি হয়েছিল গুলির শব্দ শোনার মধ্য দিয়ে। অভ্যাসমত গুলির শব্দ শোনা মাত্রই তারা ঘরের পেছনে জঙ্গলে আশ্রয় নিতে যায়। কিন্তু  গুলির শব্দ থেমে যাওয়ার পর কোন জন-মানুষের আওয়াজ পাওয়া গেলনা অনেকক্ষণ। তারা কি ভুল শুনেছে! একে রাতের বেলা, তায় এত কাছে গুলির শব্দ--তারপরও নিস্তব্ধ গ্রাম--মানুষ-জন কি এতই ঘুম-কাতর যে শুনতে পায়নি--।

একসময় ঘরে এসে আবার শোয়ার চেষ্টা। বাচ্চাকটি ঘুমোলেও বড়রা সব নির্ঘুম। কথাহীন শুধু ভারি নিশ্বাসের শব্দ। রাত পার হয় অতি-ধীর গতিতে। কান খাড়া করে জন্তুর মত নিয়তি শুধু মাঝে মাঝে কঁকিয়ে ওঠে। এ ছাড়া সারা রাত আর কোন শব্দ নেই।

খুব সকালে উঠে রবীন্দ্রবাবু ও দিবাকর দুজনেই লাশ দেখে এসেছে। দুজনের কারো মুখেই কথা নেই। এই সংবাদ শোনার পর থেকে বাড়িটা নিস্তব্ধ। তার মধ্যে মধু সাধু একবার এসে ঘুরে গেছেন। রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে কথা বলে গেছেন । কী কথা বলে গেছেন তা অন্য কেউ জানে না। শ্রীমন্তপুর গ্রামে এখন সাকুল্যে তিনটি হিন্দু পরিবার থাকে। সারাদিন শুনশান থাকে । তাদের চার শরিকের পুকুর ঘাট সারাদিন খা খা করে। একা যেতে ভয় ভয় লাগে।

রবীন্দ্রবাবুর বাড়ির কাছাকাছি কেউ নেই। শুধু রাতের দিকে অমৃতপুরের কয়েকজন মুসলমান যুবক তাদের পাশের এক শরিকের বাড়িতে শুতে আসে। এটাও এই হিন্দু পরিবারটিকে রাতে ভরসা দেয়ার জন্য। কিন্তু এভাবে আর কতদিন।  

মা সুপ্রভার সঙ্গে মেয়ে নিয়তির সম্পর্কটা এখন তলানিতে এসে ঠেকেছে। মায়ের এই রূপ নিয়তির কাছে অচেনা। দুজন দুই যুগের মা হলেও  উভয়েই সন্তান অন্ত  প্রাণ। অথচ এখনকার এই চরম বিপদের দিনে মা কেন যে তার দেশছাড়তে না পারার জন্য নিয়তির হঠাৎ উপস্থিতিকেই দায়ী করে বসলো তা নিয়তি ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। এখনে আসার পর থেকে মায়ের এই রূপ নিয়তি ধীরে ধীরে উপলব্ধি করেছে।  বোঝা যাচ্ছে যে মায়ের মনে বয়ে চলা ঝড়ের কোন বিরাম নেই। সেই ঝড়ে নিয়তি ঠিক কোথায়, কোন অবস্থানে বুঝতে অসুবিধে হলেও মাকে দেখলেই নিয়তির বুক ঠেলে কান্না আসে। মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে জিজ্ঞেস করতে মা তুমি এমন কেন হয়ে যাচ্ছ। তুমি কি আমার উপর খুব রাগ করেছো। আমিত কতবার বললাম আমি থাকছি বাড়িতে--তোমরা যাও--কপালে আমার যা আছে তাই হবে--ভগবান রক্ষা করলে বেঁচে থাকবো, না হলে থাকবো না--এর জন্য তোমরা তোমাদের যাওয়া আটকাও কেন--। সারাদিন মনে মনে এ জাতীয় ভাবনা ভাবতে ভাবতে নিয়তির দিন কাটে।

বিকেলের দিকে লাশ নিয়ে চলে যাওয়ার পর রাস্তাঘাটের ভিড়ও কমে। এই সুযোগে কোনমতে পুকুরে একটা ডুব দিয়ে এসে সুপ্রভা উনুন ধরিয়ে চাল ডালে একসঙ্গে বসিয়ে দেয়। সারাদিন না খাওয়া বাচ্চাগুলোকে কিছুটা খাইয়ে বাকিটা শোয়ার ঘরে নিয়ে চলে যায়। সন্ধ্যে পার হতে না হতেই আশপাশ একেবারে শুনশান। রবীন্দ্র বাবু দিবাকরও ঘরে এসে গেলেন। অবেলায় খেয়ে বাচ্চাগুলো এরমধ্যেই ঘুমে কাদা। নির্ঘুম জেগে থাকার মধ্যে শুধু শ্বশুর জামাই সুপ্রভা আর নিয়তি। তাদের ঘুম ইচ্ছের বিরুদ্ধে অজান্তে কখনও আসলে আসতে পারে। একসময় নিঃশব্দে চারজন খেয়ে নিল কিছুটা। নিভিয়ে দিল বাতিও। ঘরদোরে রাত্তিরে বাতি রাখা এখন অশুভ অমঙ্গল প্রাণঘাতী। জীবনের ব্যাকরণের এই নিঃশব্দ বদল সকলেই নিঃশব্দে মেনে নেয়।

দমবদ্ধ ঘরের গুমোটে কিছুক্ষণ কাটিয়ে  দিবাকর বাইরে বারান্দায় আসে। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেতো বাইরে আসতেই  হয়। কিন্তু দিবাকর ইচ্ছে করেই আজ আসে। শ্বশুরের সামনে বিড়ি খাওয়া যায় না বলে সকলেই ধরে নেয় সে বাইরে বিড়ি খেতেই গেছে। বাইরে আজ রাতের প্রহর যেন অন্যরকম। আজ রাতের অন্ধকারও অন্যরকম। আজ বাস্তবে এক রকম মৃত্যুকে দেখা গেছে। আমাদের জন্য হয়তো অপেক্ষা অন্য রকম। বিড়িটা জ্বালিয়ে হাতের মুঠোয়  নিয়ে টানছে দিবাকর। সামান্য আলোর ফুলকি যেন কারোর চোখে না পড়ে। সাহসী সে কোনকালেই ছিল না। এখন সাহস ভীতি এগুলো তার কাছে অর্থহীন হয়ে গেছে। শরীর খুব দুর্বল হলেও তার অনুমান শক্তি এখন আরো প্রখর। বিগত এক মাসের শ্রীমন্তপুর বসবাসে এদিকওদিক ঘোরাঘুরিতে সে বুঝে গেছে জায়গাটা আপাত নিরাপদ মনে হলেও বিপদ একটা আসতে পারে। উঠোনের এককোণে একবার পেচ্ছাব করে দিবাকর আবার উঠে আসে বারান্দায়। বারান্দার একদিকে ঢেঁকিঘর, সে তার মধ্যে ঢুকে পড়ে দ্বিতীয় বিড়িটা ধরায়। ভাবনায় রয়ে গেছে সেই বিপদের কথাটা। সৈয়দ আকবর আলী হতে পারে সেই বিপদের কারণ। আর সেটা ঘটতে পারে জব্বারের জন্য।
 

সময় কাটানোর জন্য অনেক সময় দিবাকর অমৃতপুর তথা আমিত্তিপুরের শেষ দিকে আকবর আলী সাহেবের বারান্দায় গিয়ে বসে। বসার জন্য সেখানে দু একটা টুল থাকে সব সময় । তবে এখন আর বিশেষ কেউ আসে না। প্রায় নির্জন ছায়াঘেরা বাড়িটির বারান্দায় একটি অতিপুরনো ইজিচেয়ারে প্রায় আধশোয়া অবস্থায় মানুষটি ঠিক সকাল সন্ধ্যে বসে থাকে। মানুষটি   সৈয়দ আকবর আলী, বি এ, কমলপুর গ্রামের জুনিয়র হাইস্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক। অশীতিপর। ছোট সংসার ছিল তার । স্বামী স্ত্রী এক কন্যা এক পুত্র। কন্যাটি বিয়ে দেয়া হয়েছে অনেক আগে। বর্তমানে স্বামী সন্তান নিয়ে সে জাপানে থাকে। পুত্রটি ছোট--সে বর্তমান সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল। গত ২৫ শে মার্চের পর  থেকে তার কোন খোঁজ নেই। এখন বাড়িতে তারা বৃদ্ধ বৃদ্ধা থাকেন। শিক্ষিত মানুষ হওয়ার কারণে গ্রামে তার সুনাম প্রভাব দুটোই ছিল । ধীরে ধীরে বয়সের সাথে সাথে সে সবে ভাটার টান।  রবীন্দ্রবাবুর জামাই হিসেবে দিবাকরকে তিনি স্নেহ করেন। এবার তিনি তার কাছ থেকে মুক্তাগাছার খবরাখবর নিয়েছেন। গল্পতো একদিনে শেষ হয়না। তাই দিবাকর  আকবর আলীর কাছে তার মেয়ে জামাইয়ের কাছ থেকে পাওয়া জাপান মেড রেডিওর কী খবর আছে শুনতে যায়। নিজের ছেলের বিষয়ে তিনি যেমন কিছু বলেন না তেমনি কেউ বলুক তা চানও না। দিবাকর তাই এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞাসা করে না। তবে আকবর আলী মাঝে মাঝে রবীন্দ্রবাবুর বর্ডারের দিকে চলে না যাওয়ার জন্য বলেন এটা একটা সাবাসী কাজ বুজলা। যার চার চাইড্ডা পুলা ইন্ডিয়ায় হেয় কিনা এই সময়ে দেশে রইয়া গেল। একদিন সন্ধ্যেবেলায় আকবর  আলীর বাসা ফেরত দিবাকরকে রাস্তায় ধরে জব্বার।

--এই মিয়া হুনেন। ভিন জায়গার মানুষ আফনে--এইহানের ধরণ ধারন বুঝেন কেমন জানি না--তয় একটা কথা কই ওনার ছ্যাড়া (ছেলে) লতিফ্যা হুনি মুক্তি হইছে। মুক্তির বাড়িত যাওন আওন ভালা ততদিনই যতদিন হে ধরা না পড়ছে। ধরা পড়লে---আফনের ভালার জন্য কই--হিন্দু মানুষ--গেরামের জামাই --না যাওনইত ভালা না হি কন! চোখে না পড়ার মত ছেলেটি রাতারাতি কত এলেমদার হয়ে উঠেছে--দিবাকরকেও সাবধান কইরা দিল। জব্বারের কথার পিঠে কথা না বলাতে জব্বার আর কিছু না বলে বলে খাইন একখান সিরেট খাইন--বলে সে একটা সিগারেট বের করে দিল দিবাকরের হাতে। বিনাবাক্যে দিবাকর সিগারেটও নিল এবং ধরিয়েও নিল। নির্বাক দিবাকরের সামনে জব্বার মুখ বন্ধ না করে কথা বলেই যাচ্ছে।---বুঝলাইন দেশের ভাব গতিক ভালা ঠেহে না। আফনেরার সাহস আছে কই। এহনও আছেন। তয় এদিকটায় হেরার নজর এহনও নেই---কবে অয় আল্লায় মালুম---আরে আমিই খালি কইয়া যাইতাছি--আফনে কিছু কন--কই যেন আফনেরার বাড়ি আছিল--হেইয়ানের খবর কইন--।

শুনতে শুনতে দিবাকর সিগারেটটা প্রায় শেষ করে এনেছিল। যাওয়ার আগে শুধু বলল-- ভালা পাইলাম আফনের কথাত--অহন যাই রাইত অইতাছে--বলে দিবাকর আর দাঁড়ায় নাই। দিবাকর জব্বারের গায়ে এমন একটা গন্ধ পেল যা সে মুক্তাগাছায় প্রায়ই পেত। শ্রীমন্তপুরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে ঘুমিয়ে থাকা তার ষষ্ট ইন্দ্রিয়টা গা ঝারা দিয়ে জেগে উঠলো এই সন্ধ্যারাতে।

কী আশ্চর্য, দুটোদিনও পার হয়নি, তার মধ্যেই লাশ পড়ে যাওয়ার ঘটনা! খুনোখুনির জন্য বেছে নেয়া স্থল এইখানেই বেছে নিতে হলো!। দিবাকর সারাটা দিন আজ জব্বারের মুখ মনে মনে দেখেছে। সে আদতে ভীতু মানুষ। খুন হওয়া বা খুন দেখা--এ দুটোর থেকে পালাতেইতো সে এতদূর এলো--তবু এসব তার পেছন ছাড়লোনা! তা হলে আর কতদূর যাবে সে! মৃত্যু-ভয়ের সঙ্গে এই ক'মাস ঘর করতে করতে যখন প্রায়  যখন গা সওয়া হয়ে যাচ্ছিলো মৃত্যু-ভয় এর সঙ্গে ঠিক তখনই তার দেখা! সাধারণত এই সব অসহায়তা নিয়ে আলোচনা সে একদম ভালবাসেনা। নিজের ভেতরেই সব রেখে দিতে চায়, যাতে অন্য কেউ আবার ভয়ের সংক্রমণে আক্রান্ত না হয়ে পড়ে। কিন্তু আজ তার কেন জানি নিয়তির সঙ্গে একান্তে একটু কথা বলার জন্য ব্যাকুলতা বোধ করছে। সে কি ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে পড়ছে?    

১০
ঢেঁকি ঘরে বসে আজও দিবাকর সেদিনের মত সামান্য হলেও যেন গন্ধটা পাচ্ছে। ভুলে যাওয়া গন্ধটা কেন এভাবে ফিরে ফিরে আসছে বুঝেও বুঝতে পারছেনা দিবাকর । সন্ধ্যেরাতের গাঢ় অন্ধকার এখন কি একটু ফিকে হয়ে আসছে। ঢেঁকিঘরের দরজা দিয়ে পূবের অনেকটা অংশই এখন দেখা যাচ্ছে। নিয়তিদের এই বাড়িটাই এই গ্রামের শেষ বাড়ি। তারপর দুচারটে সবজি ক্ষেত আর তারপরই শুরু হলো জঙ্গল। খুব গভীর জঙ্গল। অথচ আশ্চর্য রাতের স্বাভাবিক শিয়ালের ডাক পর্যন্ত এখন আর শোনা যায় না। কুকুরও কি নেই! দিনে একটা দুটো দেখা গেলেও রাতে সেই কবে থেকেই নেই এদিকে। তৃতীয় বিড়িটা ধরানোর আগে হঠাৎ দিবাকর কান খাড়া করে শুনতে পেল মানুষের গলা। কিছুটা ভয় পেলেও বিড়িটা আড়াল করে ধরিয়ে নিল। ভাবলো পাশের বাড়িতে আমিত্তিপুরের কটা ছেলে  শুতে আসে--বোধ হয় ওরা আসছে। কিন্তু ওরাত এতজন থাকেনা। এত দেখি বেশ কজন। ইতিমধ্যে তারা উঠোনেও ঢুকে পড়েছে। আবছা অন্ধকারে ভিড়টা কিছুটা কাছে আসতেই দেখা গেল আমিত্তিপুরের সালাউদ্দিন চাচা। সঙ্গে আরো কয়েকজন। দেখে বুক থেকে একটা পাথর নেমে যাওয়ার অনুভূতি টের পেল দিবাকর। যেখানে আজ অন্তত রাজাকার বা শান্তিবাহিনির দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল অনেকটাই।  

সালাউদ্দিন চাচা এখন এই দুই গ্রামের সকলের চাচা। আসলে তিনি রবীন্দ্রবাবুর বাল্যবন্ধু। একসঙ্গে গ্রামের স্কুলে পড়েছেন একসময়। চাচা এখন এই বাল্যবন্ধুকে নিয়েই পড়েছেন বিপদে। গ্রামের সবাই যখন আমিত্তিপুরের মুরুব্বীদের পরামর্শ শুনে নৌকা ভাসালো বর্ডারের দিকে তখন তিনি নড়লেন না। এখনত শুনি শ্বশুর বাড়ি থেকে বাচ্চাকাচ্চাসহ তার মেয়ে জামাইও এসে গেছে। এখন তার দেখাশোনার একটা দায়িত্ব তিনি আর কীকরে ভুলতে পারেন। আজ সারাদিন নানা উপদ্রবের মধ্যে কাটলেও সন্ধ্যেবেলা মনে হলো যে যাই দেখে আসি কেমন আছে। উঠোনে দাঁড়িয়েই তিনি হাঁক দিলেন--কই রবীন্দ্র ঘুমায়া পড়ছ নাহি। আমি সালু। সালাউদ্দিনের ডাকের মধ্যেই ঢেঁকি ঘর থেকে আবছা অন্ধকারে বেরিয়ে আসলো দিবাকর।-কেডা? শোনার আগেই দিবাকর বলে উঠল চাচা আমি দিবাকর। দিবাকর নামটা চাচার মনে না থাকলেও আন্দাজ করে নিলেন যে জামাইই হবে। --অ তা তুমি আন্ধারের ভিত্রে খারোয়া আছো ক্যান?   

এরমধ্যেই দরজার একটা কপাট ফাঁকা করে রবীন্দ্রবাবু দেখে নিলেন বন্ধুকে। বল্লেন--অ আওনের সময় পাইলা! আইও বও। কিন্তু সালাউদ্দিন বসার জন্য আসেনি। বললো--রাইত হইতাছে অহন বইতামনা--কাইল বিয়ানে আইবাম--আর  হুনো এই কয়ডা ছেড়া পাশেই মদনের ঘরে থাকবো--ভয় পাইলে হাকডাক কইরো। রাইতে ভয়ের কিছু নাই। খোঁজ খবর লইছি-বুজছো। অন্ধকারে দুই বন্ধু হাত ধরে একটু দূরে গিয়ে কিছু পরামর্শ করলো। তারপর সালাউদ্দিন চলে গেল। পাশের বাড়ির দিকে ছেলেরাও হাঁটা দিল। হঠাৎ দম আটকানো নিস্তব্ধতা ঘেরা এই প্রান্তিক বাড়ির উঠোনে যেন প্রাণের সঞ্চার হয়েছিল। সবাই চলে যাওয়ার পর অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালা থেকে সেই নিস্তব্ধতা আবার লাফ দিয়ে নেমে এল উঠোনে। দিবাকরের এরপর আরো কিছুক্ষণ ঢেঁকিঘরে সময় কাটানোর ইচ্ছে ছিল। কিন্তু নিজের মন আর সাড়া দিল না।

১১
ভয় নেই--সালাউদ্দিন বলে গেছে। এই খবর ঘরের ভেতর কী প্রতিক্রিয়া  তৈরি করলো বোঝা মুষ্কিল। মনে মনে সকলে আশ্বস্থ হলো ঠিকই কিন্তু প্রকাশ পেল না। প্রকাশ করতে গেলে কথা বলতে হয়। কথা সকলেরই সন্ধ্যে থেকে বন্ধ আছে।   রবীন্দ্রবাবু ঘরে ঢুকে নিজের জায়গায় শুয়ে এক দুবার ভগবানের নাম নিলেন। দিবাকর এবার আর বাইরে না থেকে সেও গিয়ে অন্ধকারের মধ্যেই একজায়গায় শুয়ে পড়লো। দিবাকর 'ভয় নেই'--কথাটা মনে মনে দুবার আওড়ে দেখলো কী অসাধারণ তার শক্তি আর ব্যঞ্জনা। অসংখ্য ভয়ের মধ্যে সালাউদ্দিন চাচার কথাটা কেমন গুন গুন করতে করতে ভয় তাড়াচ্ছে। তাড়াচ্ছে সেই গন্ধটা যা সে জব্বারএর শরীর থেকে পেয়েছিল বা কিছু আগে তাদের বারান্দায় বসে বসেও পাচ্ছিলো। এই রাতে আর ঘুম আসবে না। কারণ এত খাড়া কান নিয়ে ঘুম কীভাবে হয়। একটা পতঙ্গ ওড়ার শব্দও যেন ভীষণ জোরে শোনা যায়। কান যেন শব্দ শোনার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। বিনিদ্র রাত স্বভাবতই দীর্ঘ হয়। যত দীর্ঘই হউক তার শেষ আছে। রাত হলেই এখনকার মানুষ সকালের প্রত্যাশা করে। এখন রাত কেউ ভালবাসে না। দিবাকর আগামী কাল সকালে উঠে কী করবে বা কী করা উচিত ভাবতে লাগলো।

আওয়াজটা প্রচন্ড জোরেই হলো। এত জোরে যে দম বন্ধ হওয়ার মত। একটা হৈচৈও যেন কানে আসছে। কে যেন হেঁড়ে গলায় বলছে --কাট শালার মালাউনের বাচ্চা বেকটিরে কাট---। পাশে বসে নিয়তির বড় ছেলেটা--অ বাবা কী  কর কী কর--বলে বাবাকে ধাক্কা দিতে লাগলো। সকাল হয়ে গেছে কিছু আগেই। উঠেও গেছে সকলে। ছেলের ধাক্কায় ধড়ফড় করে উঠে বসলো দিবাকর। সারা গা ঘামে ভেজা। ছেলেটা অবাক চোখে বাবাকে দেখছে। দিবাকর গামছাটা টেনে মুখ মুছতে শুরু করলো। মুছতে মুছতে ছেলেটার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বললো--তুই উটছ নাই অহনও--যা ঘাটে গিয়ে মুখ ধুইয়া আয়। ছেলে বিছানা থেকে নড়েনা। গোল গোল চোখ করে বাবাকে আবার বলল--বাবা কী অইছিল তুমার--গো গো করতাছিলা ক্যান। দিবাকর উত্তর না দিয়ে হাসে। বলে--ও কিছুনা স্বপ্ন দেখতাছিলাম। ল যাই মুখ ধুইয়া আসিগা--। বলতে বলতে বাপ ছেলে উঠে পড়লো। রান্নাঘরে গিয়ে কিছুটা ছাই নিয়ে বাপ বেটা দু জনেই দাঁত মাজতে মাজতে পুকুর ঘাটের দিকে হাঁটা দিল। গ্রামের রাত যেমন আগে আগে হয়, সকালও তেমনি আগেই হয়। দিবাকরের উঠতে আজ বেলাই হয়ে গেছে। বেশ সময় নিয়ে আজ বাপ বেটা দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে পুকুরঘাট থেকে ফিরে দেখলো বাড়ির বাচ্চারা রান্নাঘরে সারি দিয়ে খেতে বসে গেছে। ফেনা ভাত, যাকে ভাটির দেশে বলে মাওড়া ভাত, সঙ্গে একদলা করে আলু সিদ্ধ মাখা। তা দিয়ে সবাই হাপুস হুপুস করে খাচ্ছে। তাদের বাপ বেটারও খাওয়ার ডাক পড়ে গেল।  

বাড়িতে রবীন্দ্রবাবুকে দেখা যাচ্ছেনা। কিন্তু বারান্দায় একটা জলচৌকিতে বসে আছে অধীর মাঝি, নিয়তির অধীর কাকু। কাছাকাছি মাটিতে পিঁড়ি পেতে বসে নিয়তি। ফ্যাকাসে মুখ। কিছু কথা বোধ করি হচ্ছে। ঐদিকের কথায় কান না দিয়ে বাপ বেটা রান্নাঘরের ঢুকে গেল। সুপ্রভা নিঃশব্দে তাদের দুজনকে ভাত বেড়ে দিল। খেতে খেতে দিবাকরের আবার সকাল বেলা ঘুমের ভেতর দেখা স্বপ্নটার কথা মনে পড়লো। মনে পড়লো অধীর মাঝির কাছে আগে একদিন নিয়তি গিয়েছিল। কীসের জন্য সেটা দিবাকর জানে। নিয়তিকে সে যতটুকু চেনে তাতে জানে যে নিয়তি খুব জেদি হলেও মাথাটা খুব পরিষ্কার। ভরসা করা যায়। শরীরের এই অবস্থায় সে নিশ্চই এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা আর ভাবছে না। কিন্তু তার মনে একটা অন্য আশংকাও দেখা যাচ্ছে যে তার অগোচরে তাদের মা মেয়ের মধ্যে কোন কথা হয়ে গেছে কিনা। এসব ব্যাপারে আগাম কিছু জানার মত অবস্থান দিবাকরের তার নিজের বাড়িতেও ছিলনা, এখানেও নেই। কিন্তু মানুষের চিন্তার মধ্যে অনেক অপ্রত্যাশিত বাঁক থাকে। সবসময় হিসাবের বাইরে থাকা দিবাকর খেতে খেতে তেমনই একটা অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসলো। শাশুরির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো--মা আফনেরা আর সময় নষ্ট না কইরা এইবার রওনা  দিয়া দেন। আমরা আছি বাড়িতে---। কপালে যা আছে সবার তাই হইব । শাশুরি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন--হ  বাবা, আমার কথায় কি আর অইব--তুমার শ্বশুররে কও।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য