বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ৮-৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৩ ০৩:১২:৩৩

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

তেরেজার মা ন্যায়বিচার দাবী করেছিলেন। তিনি চেয়েছিল অপরাধী যেন শাস্তি পায়। সে কারণেই মেয়েকে তারই সাথে তার নির্লজ্জতার জগতে থাকতে বাধ্য করেছিলেন, যেখানে যৌবন আর সৌন্দর্য অর্থহীন, যেখানে পৃথিবী একই রকম দেখতে অগণিত শরীরের বিশাল বন্দীশালা ছাড়া আর কিছুই না, যেখানে আত্মারা অদৃশ্য।

আমরা এখন ভালো করে বুঝতে পারবো, তেরেজার গোপন অভ্যাসটি, আয়নার দিকে তার দীর্ঘ দৃষ্টি বা দ্রুত চাহনির অর্থ আসলে কি। এটি মায়ের সাথে তার একটি যুদ্ধ। অন্য সব শরীর থেকে পৃথক অনন্য একটি শরীর হয়ে উঠবার তীব্র কামনা। তার মুখের প্রতিফলিত প্রতিচ্ছবিতে ভিতরে খুব গভীর থেকে উপরে উঠে আসা আত্মার উপস্থিতির অনুসন্ধান। খুব সহজ  কিন্তু না সে কাজটি, কারণ তার বিষণ্ণ, নিরীহ, আত্মপ্রচার বিমুখ আত্মাটি – তার শরীরের অনেক গভীরে লুকিয়ে ছিল এবং নিজেকে প্রকাশ করতে যে লজ্জা পায়।

সুতরাং যেদিন টমাসের তার প্রথমবার দেখা হয়েছিল, হোটেলটির রেস্টুরেন্টের মদ্যপ লোকগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে পরিবেশন করার সময়, ট্রে ভরা বিয়ারের বোতলের ভারে ক্লান্ত শরীরে তার আত্মা আসলে ছিল পাকস্থলী বা অগ্নাশয় স্তরে। তারপর টমাস তাকে ডেকেছিল, সেই ডাকটি তার কাছে ছিল অনেক অর্থবহ, কারণ এই ডাকটি এসেছে এমন কারো কাছ থেকে যে তার মাকে চেনে না বা এমন কোনো মাতালের কাছ থেকেও না, যারা  প্রতিদিনই অশ্লীল মন্তব্য করে। টমাসের বহিরাগত পরিচয়টি তাকে সবার চেয়ে পৃথক অন্য একটি উচ্চ স্তরে নিয়ে গিয়েছিল।

তেরেজার চোখে, অন্য কিছু, টমাসকে তার পরিচিত সবার চেয়ে আরো উপরের স্তরে নিয়ে গিয়েছিল: টমাসের সামনেই টেবিলে উপর একটা খোলা বই ছিল। সেই রেস্টুরেন্টের ভিতর এর আগে কেউই কোনদিনও বই খোলেনি এর আগে। তেরেজার চোখে বই হচ্ছে গোপন একটি ভ্রাতৃত্বের পরিচয় চিহ্ন। কারণ তাকে ঘিরে থাকা বাস্তব সেই স্থূল ও অশ্লীল পৃথিবীর বিরুদ্ধে  তেরেজার একটাই অস্ত্র ছিল: মিউনিসিপ্যাল লাইব্রেরী থেকে ধার করা বই এবং বিশেষ করে উপন্যাস। যে কোন উপন্যাসই সে সাগ্রহে পড়তো,ফিল্ডিং থেকে টমাস মান। তারা তাকে শুধুমাত্র  স্বস্তিহীন অপূর্ণ একটি জীবন থেকে কাল্পনিক একটি মুক্তির পথের সম্ভাবনাই দেখায়নি,  স্পর্শ করা যায় এমন কোনো বস্তু হিসাবেও তার কাছে বইয়ের অর্থ ছিল খানিকটা ভিন্ন: রাস্তায় বগলের নীচে বই নিয়ে হাটতে ভালোবাসতো তেরেজা। এক শতাব্দী আগে ফ্যাশনদুরস্ত কারো কাছে অভিজাত ছড়ির যেমন অবস্থান ছিল, তেরেজার কাছে বইও একই অর্থ বহন করতো। সবার কাছ থেকে যা আলাদা করতো তেরেজাকে।

(বইএর সাথে অতীতের ফ্যাশন দুরস্ত কারো হাতের অভিজাত ছড়ির তুলনা করার পুরোপুরি সঠিক না। অতীতের ফ্যাশনপ্রিয় কারো জন্য অভিজাত ছড়ি তাকে সবার থেকে আলাদা করা ছাড়াও তাকে আধুনিক বা ‍হাল ফ্যাশনের মানুষেও রূপান্তরিত করতো। বইও তেরেজাকে ভিন্ন করতো সবার চেয়ে, কিন্তু অতীতমুখী ফ্যাশনের চিহ্ন হিসাবে। অবশ্যই তার বয়স এতো অল্প ছিল যে, সে বুঝতেই পারেনি অন্যদের চোখে সে আসলে কত পুরনো ফ্যাশনের একজন ছিল। তরুণরা, যারা কানের মধ্যে একটি ট্রানজিস্টর রেডিও চেপে ঘুরে বেড়াতো, তেরেজার কাছে  এসব খুবই ছেলেমানুষি মনে হত, তার কাছে কখনো মনে হয়নি তারা আসলে হাল ফ্যাশনের ধারাতেই আছে।)

সুতরাং যে মানুষটা তাকে সেদিন তার টেবিলে খাবারে অর্ডার দিতে ডেকেছিল, সে ছিল একই সাথে আগন্তুক এবং গোপন ভ্রাতৃত্বের একজন সদস্য। বেশ দয়ালু কণ্ঠস্বরে টমাস তাকে ডেকেছিল এবং তেরেজা অনুভব করেছিল তার রক্তনালী এবং চামড়ার অদৃশ্য অগণিত ছিদ্র দিয়ে যেন তাড়াহুড়া করে দ্রুত বেরিয়ে আসছিল তার আত্মা এই আগন্তুকটিকে নিজেকে দেখানো জন্য।


জুরিখ থেকে প্রাহাতে ফিরে আসার পর, তেরেজার সাথে তার দেখা হবার ঘটনাটি যে ছয়টি প্রায় অসম্ভব দৈবক্রমে ঘটা ঘটনার ফলাফল, টমাসকে সেই ভাবনাটি বেশ অস্বস্তিতে রেখেছিল। কিন্তু কোনো একটি ঘটনা কি আসলেই আরো বেশী গুরুত্বপূর্ণ এবং উল্লেখযোগ্য  হয়ে ওঠে না, যখন তা ঘটানোর জন্য অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক বেশী সংখ্যক দৈব ঘটনার প্রয়োজন হয়?

দৈবাৎ এবং শুধুমাত্র আকস্মিক দৈবক্রমে ঘটা ঘটনাগুলোই আমাদের জন্য কোনো বার্তা বহন করে। সবকিছুই যা ঘটে প্রয়োজনের খাতিরে, যা সবকিছু আমরা জানি ঘটতে যাচ্ছে, প্রতিনিয়ত যাদের পুনরাবৃত্তি হয়, তারা নির্বাক। শুধু দৈবাৎ ঘটা ঘটনাগুলোই আমাদের সাথে কথা বলতে পারে। আমরা এর বার্তাটা পড়ি অনেকটাই যেমন করে কোন জিপসি কফি কাপের নীচে পড়ে থাকা কফির গুড়ার নক্সা পড়ে।

হোটেলের রেস্টুরেন্টে তেরেজার সামনে টমাসের আবির্ভাব হয়েছিল চূড়ান্তভাবে অদৃষ্টক্রমে ঘটা একটি ঘটনা রূপে। সেখানে সে বসেছিল, সামনে খোলা একটা বইয়ের দিকে তাকিয়ে সে তখন পড়ছে, যখন হঠাৎ করেই টমাস বই থেকে চোখ সরিয়ে তেরেজার দিকে তাকায়, এবং হেসে বলে, ‘দয়া করে একটা কনিয়াক’।

সেই মুহূর্তে ঘটনাক্রমে রেডিওতেও বাজছিল সঙ্গীত, কাউন্টারের পেছনে কনিয়াক ঢালতে যাবার পথে তেরেজা রেডিওর আওয়াজটা বাড়িয়ে দিয়েছিল, সে চিনতে পারে, এটা বীটহোভেনের সঙ্গীত। তার চেনার কারণ, সেই ছোট শহরে একবার  প্রাহা থেকে বেড়াতে আসা একটি স্ট্রিং কোয়ার্টেট দলের বাজানো এই সঙ্গীতটি সে আগেও শুনেছিল। তেরেজা (আমরা জানি, সবসময় সে কামনা করতো মহৎ কোনো কিছুর) তাদের কনসার্টে গিয়েছিল; হল ছিল প্রায় পুরো খালি। বাকী দর্শকের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় একজন ফার্মাসিস্ট এবং তার স্ত্রী। এবং যদিও কোয়ার্টেট এর সদস্যরা নীচে বসা মাত্র তিনজন দর্শক পেয়েছিলেন, তাসত্ত্বেও তারা যথেষ্ট দয়াশীলতার পরিচয় দিয়েছিল কনসার্টটি বাতিল না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে।  এবং তারা বীটহোভেন এর শেষ তিনটি কোয়ার্টট  এই তিন শ্রোতাকে বাজিয়ে শোনান।

এরপর ফার্মাসিস্ট কোয়ার্টট এর সদস্যদের ডিনারের  নিমন্ত্রণ দেন, তারা এই তরুণী শ্রোতাকেও তাদের সাথে যোগ দিতে অনুরোধ করেছিলেন। তখন থেকেই বীটহোভেন তার কাছে, অন্যদিকের সেই পৃথিবীর প্রতীকে রূপান্তরিত হয়, যে পৃথিবীর জন্য ছিল তার তীব্র বাসনা। টমাসের জন্য কনিয়াক নিয়ে কাউন্টার ঘুরে আসতে আসতে, তেরেজা অদৃষ্টক্রমে ঘটা এই ঘটনা দুটির দেয়া বার্তাটি পড়ার চেষ্টা করে। কেমন করে সম্ভব হলো ঘটনাগুলো: ঠিক সেই মুহূর্তে সে একজন আগন্তুকের কাছে তার চাহিদার কনিয়াক নিয়ে যাচ্ছে, যাকে তার খুবই আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে; আর ঠিক সেই মুহূর্তেই  সে বীটহোভেন শুনলো?

প্রয়োজন কোনো যাদুর সূত্র জানে না - সবকিছু  দৈবক্রমে ঘটা ঘটনার সম্ভাবনার উপর অর্পিত। যদি কোনো ভালোবাসাকে অবিস্মরণীয় হতে হয়, সুযোগ আর দৈবাৎ ঘটনাগুলোকে অবশই তাড়াতাড়ি এর উপর অস্থিরভাবে নেমে আসতে হবে, অ্যাসিসির সেন্ট ফ্রান্সিসের কাঁধে ডানা ঝাপটিয়ে নেমে আসা পাখীগুলোর মত।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য