ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৪ ২০:১৪:১৫

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
১২
ভাদ্রমাস শেষ। সকাল থেকে আকাশের দিকে তাকানো যাচ্ছে না তার স্বচ্ছতার জন্য। ঝকঝকে নীল আকাশ। রোদের তেজে যেন আরো নীল। খুব একটা গরম না হলেও রোদ বাঁচিয়ে চলতে হয়। বাড়ির বাইরের অংশে গোয়ালঘরটা। বেশ বড়। অথচ একটা মাত্র গাই আর বাছুর ছিল সম্বল। এখন নেই । চাষ বাসের জন্য একসময় নাকি অনেক বলদ গরু ছিল। এখন সে সব নেই। সব জমি আধিয়ারের হাতে। দেশে গোলমাল শুরু হওয়ার পর যখন যে যার মত পালাচ্ছে তখন কেউ গরু বিক্রি করেছে,কেউ পাশের আমিত্তিপুরের চেনা মানুষদের কাছে রাখতে দিয়েছে। তাই শ্রীমন্তপুরের সব গোয়ালই ফাঁকা। এই বাড়ির গাই বাছুরও ঐ সময় তাদের আধিয়ার মিরাজ আলির কাছে দিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন এই  ফাঁকা গোয়ালে সকালে খাওয়া দাওয়ার পর বাচ্চাকাচ্চারা এসে খেলাধূলা করে। দিবাকর বর্ষা বাদলের দিনে গোয়ালের  বারান্দায় বাঁশের মাচাটার উপর বসে বিড়ি খেত আর সাত পাঁচ ভাবতো। তখন শরীর খুব দুর্বল ছিল। এখন কিছুটা সামলে ওঠার পর সেও সকালে খাওয়ার পর এদিক সেদিক ঘুরে পুকুর পারের দিকে যায়। সেখানে বড় কিছু আম কাঁঠাল গাছ  আছে। ছায়া আছে। তারই কোন একটার নিচে বসে সময় কাটায়, আর কান খাড়া রাখে গুলির শব্দ শোনার জন্য।

মাঝে মাঝে গুলির শব্দ শোনাও যায়। সে সব মানুষ মারার জন্য না ভয় দেখানোর জন্য বোঝা যায় না। সময়ের নিয়মে আতংকও একসময় যখন গা সওয়া হতে শুরু করেছিল ঠিক তখনি ওই গত কালের ঘটনা । ঐ চারটা লাশ। আবার সব আশঙ্কা পূর্ববৎ ফিরে এসে চেপে বসলো সবার চিন্তায়। তবু এই সময়  দিবাকর আতঙ্কের কথা মনে রাখতে চায় না। আয়েস করে একটা বিড়ি ধরিয়ে সে পুকুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। খানসেনা নেই এমন একটা পৃথিবীর কথা ভাবতে ভাবতে  হঠাৎ মনে পড়লো অনেক দিন মাছ খাওয়া হয়না। অথচ এই পুকুরে কত মাছ। এখন নাকি লোক না থাকার সুযোগে রাতে রাতে মাছ চুরি হচ্ছে। আগে শ্বশুর বাড়ি এলে এক সময় বড়শি দিয়ে দিবাকরও মাছ ধরতো। সে-সব কী দিন ছিল। এই জীবনেই ছিল কি!ভাবতে ভাবতে দিবাকরে চোখ লেগে আসছিল।   

বাবা বাবা ---ডাকে সম্বিত ফিরলো দিবাকরের। দেখলো তার বড় ছেলেটা দৌড়ে আসছে। কাছে এসে শুধু 'বাড়িত যাও--তুমারে মায় ডাকে' বলে আবার এক গতিতেই সে ফিরেও গেল। দ্বিতীয় বিড়িটা টানতে টানতেই দিবাকর বাড়ির দিকে হাঁটা দিল। রান্না ঘরের সামনেই নিয়তির দেখা।--থাহ কই--এইদিকে খুইজ্জা মরি--চিন্তা নাই ভাবনা নাই--বড় ঘরে যাও। অনেকদিন পর যেন নিয়তি কথা বললো। গালি হঊক আর অনুযোগই হোক দিবাকরের ভালই লাগলো। স্বভাব অনুযায়ী কথার উত্তর না দিয়ে সে বড় ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো । ঢুকে কিছুটা অবাকই হলো । শ্বশুর শাশুরি অধীর  মাঝি, তিন জনই তিন জায়গায় বসা। দিবাকর ঘরে  ঢুকতেই শ্বশুর বলে উঠলেন--নিয়তিত আজই চইলা যাইতে চায়। তোমার কী মত। এই অবস্থায় ---। শুনে একটু ক্ষণ মাথা নিচু করে দিবাকর বসে থাকলো। একসময় বলল--আফনেরা? কথাটার উত্তর রবীন্দ্রবাবুর বদলে সুপ্রভা দিলেন।---দেখ বাবা বাড়িত বইসাও মরণ, বাইরে গেলেও মরণ--তা বাঁচনের চেষ্টা করার জন্য বাইরে যদি যাইতে হয় তয় যাওনই কাম--ঘরের দুয়ারে বিপদ নিয়া আর কতদিন--।  শাশুরির যুক্তির কাছে দিবাকরের কিইবা বলার আছে। এতো অনেকটা--মরা ঠিক হয়ে আছে--কে কীভাবে মরবা এখন ঠিক করো, আর সেই মতো কাজ করো। কথাবার্তার মধ্যে নিয়তি নীরবে ঘরে ঢুকে একপাশে বসে পড়লো। সে জানে তারা না সরলে মা বাবাও সরবেনা শ্রীমন্তপুর ছেড়ে। তারা ভাবে পোয়াতী মেয়েরে একলা এই শূন্যপুরীতে রেখে যাওয়াও অসম্ভব। তারচে নিজের গ্রামে গিয়ে--। আর এখানেই অস্পষ্টতা--দিবাকরও এখানে এসেই আর ভাবতে পারছে না। ঘর বাড়ি সব সেখানে পড়ে থাকলেও এখন কি অবস্থা সেখানে--কোন সংবাদ না নিয়ে নিয়তি এই রকম ঝুঁকি কেন নিচ্ছে সেখানে যাওয়ার!  

দিবাকর একটা জিনিষ বুঝে গেল যে তার আসার আগে এখানে অনেক কথাই হয়ে গেছে। সিদ্ধান্তও হয়ে গেছে। শুধু আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানোর জন্য তাকে ডাকা। দিবাকরতো এখানেই থাকতে চেয়েছিল। চাইকি যদি মরতেও হয়, তো    এখানেই মরবে। কী যে মা মেয়ের মধ্যে হলো--কে জানে। নিয়তি পরিষ্কার করে কিছু বলেওনা। তার শরীরের এই অবস্থা--কোথায় যাব-- কী করবো--ভাবতে ভাবতে দিবাকর হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল --আফনেরা যা কইবেন সেইমতই হইবো---আমার আর কী মত--। বলতে বলতে সে বাইরে পা রাখলো। পেছনে শুনলো,নিয়তি বলছে--অহন আর দূরে যাইয়োনা--কাম আছে--বান্দাছান্দা করন লাগবো। দিবাকর আবার পুকুর ঘাটের দিকেই চেয়েছিল যেতে। কিন্তু নিয়তির কথা শুনে মুখ ঘুরিয়ে ঘরের পেছনে জঙ্গলের আস্তানাটায় গিয়ে একটা বিড়ি ধরালো। বাঁশের একটা নিচু মাচা মতন করে দেয়া হয়েছিল নিয়তির বসার জন্য--এখন সেটার উপরই সে বসলো। দেশের গোলমাল শুরু হওয়ার পর যখন সব কিছুই বেসামাল হয়ে পড়ছিল তখন থেকেই দিবাকর তার বাবার অভাব বোধ করে আসছে। আর আজ আরো বেশি করে মনে পড়ছে। বাবা মারা যাওয়ার সময় তার এই আদরের বড় ছেলে সংসার বলতে কিছুই জানতোনা। এখনো জানে না। নিয়তি সুস্থ থাকলে চিন্তা ছিলনা। সংসার নিয়তিই দেখে । সব সেইই জানে। এখনও হয়তো সেইই দেখবে । কিন্তু সে সাত/আট মাসের গর্ভবতী। শুনশান জঙ্গলে বসে দিবাকরের চোখ ছলছল করে উঠলো।

১৩
আজ সকালে রবীন্দ্রবাবু কিছুক্ষণের জন্য আমিত্তিপুরে গিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন মানে তাকে ডেকে পাঠানো হয়েছিল। ডেকেছিলেন বন্ধু সালাউদ্দিন। সেখানে এক নিভৃত স্থানে বসে দুই বন্ধুতে অনেক পরামর্শ হলো। সালাউদ্দিনের বক্তব্য এবার বাড়ি ছাড়। আরত ভরসা পাই না। চারটে লাশ পাওয়ার প্রতিক্রিয়া এখনও শুরু না হলেও অচিরেই যে শুরু হবে বোঝা যাচ্ছে। শুধু একটু জল কমার অপেক্ষা। মধু সাধু বা আর এক বাড়ির একমাত্র বৃদ্ধা বিধবা;সাবিত্রীর মাকে নিয়ে চিন্তা নেই--আমিত্তিপুর করেও না তা--কিন্তু সজ্জন সম্মানীয় রবীন্দ্রবাবু--যার এমনিতেই ইন্ডিয়ার যোগাযোগ আছে--যার চার চারটে ছেলে সেখানে আগেই পার হয়ে গেছে--তারা এখন সেখানকার নাগরিকও বটে--তার পক্ষে রেহাই পাওয়া মুষ্কিল। বন্ধু মধু সাধুর কথায় আর তার ভরসা করা ঠিক হবে না।     

বিচক্ষণ সালুর যুক্তির কাছে রবীন্দ্রবাবু আর কথা খুঁজে পেলেন না। একসময় মেনেও নিলেন। কিন্তু একটা ভাবনা তার মাথায় নতুন করে বাসা বাঁধলো যে সালুর কথার সঙ্গে নিয়তি বা সুপ্রভার কথার খুব তফাৎ দেখা যাচ্ছে না। যদিও তা নিয়ে বেশি ভাবার সময় তখন নেই। বাড়ি ফিরে দেখেন বারান্দায় বসা অধীর । সকালের খাওয়ার পর খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়ে যায় বড় ঘরে বসে।

দিবাকর বের হওয়ার পরপরই সুপ্রভাও উঠে পড়লেন। রান্না বসাতে হবে। ঘরে অধীর মাঝির কাছ থেকে রবীন্দ্রবাবু জলপথটা সম্পর্কে জেনে নিচ্ছেন। বর্ষা কিছুটা স্তিমিত।তবু জল এখনও সর্বত্র। খাল বিল হাওড় বাওড় নদী নালা ধরে ধরে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত যেতে বাধা নেই। বাধা শুধু রাজাকার আর শান্তি বাহিনির--এই পথে মিলিটারির দেখা পেতে পেতে সেই  ময়মনসিং। সেখানে গিয়ে অবস্থা বুঝে কাজ করতে হবে। সেরকম নিরাপদ ঘাট পেলে তবেই তাদের নামিয়ে দিয়ে অধীর ফিরে আসবে। 'পোয়াতি রুগী হাসপাতাল যায়'--এটাই সব জায়গায় বলতে হবে। ময়মনসিং এ নেমে তেমন মনে হলে হাসপাতালে একবার যাবে। ফোলা পা এর জন্য অষুদ নিতে। খুব জটিল কিছু না হলে পোয়াতিদের এখনও হাসপাতালে যাওয়ার রেওয়াজ তৈরি হয়নি। সব খুটিয়ে খুটিয়ে জেনে নেওয়া এবং কিছু পরামর্শ দেওয়া সবই রবীন্দ্রবাবু করলেন। কিন্তু মনের ভেতর স্বস্থি কোথায়! ঈশ্বরে আস্থাবান মানুষও কেমন যেন আস্থা রাখতে পারছেন না। পাঁচ টাকা অগ্রিম নিয়ে অধীর মাঝি চলে গেল। পরিবেশটা বুঝে ফেলার কারণেই বোধ হয় যাওয়ার সময় রবীন্দ্রবাবুকে বলে গেল--দাদা অধীরের উফরে ভরসা রাইখেন--ভাইবেন না--পোয়াতি মায়েরে লইয়া যাইয়াম--এইডা অনেক বড় কথা--অধীরের জান ধরা রইলো। বহুদিনের পুরনো মাঝি। কতদিনের সম্পর্ক এবাড়ির সঙ্গে। বর্ষায় বিপদে আপদে একমাত্র  ভরসা। নৌকাই তার মূল জীবিকা । তবে খরার দিনে সে মাছও বিক্রি করে। জল বা জলজীবী মানুষের প্রকৃতি তার জানা। রবীন্দ্র বাবু পুরনো কথা মনে করে নিজের ভেতরে ভরসার জায়গাটা একটু শক্ত করলেন যেন।   

সন্ধ্যার আগে আগে দিবাকর বার দুয়েক নৌকাঘাটে গেল এলো। রেখে এলো মালপত্র। রেখে এলো তোলা উনুন,কিছু কিছু চাল ডাল তেল লবন আরো কিছু টুকিটাকি। বড়ছেলেটা যাবে না। দাদু দিদার কাছে থেকে যাবে । এই সময় থেকে যাওয়া মানে ছেলের ভাগ্যও তার দাদু দিদার সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া। পেছনে একটা আবছা পরিকল্পনার কথাও শোনা গেছে যে অধীর ঠিক মত নিয়তিদের পৌঁছে দিতে পারলে পরের বার অধীরের নৌকাতেই তারাও ভেসে পড়তে পারে। দাদু দিদা ভেসে পড়লে নিয়তির বড় ছেলেও যাবে তাদের সঙ্গে, বাদ পড়বেনা নিশ্চই। এখানে কি নিয়তি তার মায়ের একটি দৃষ্টান্ত অনুসরন করলো যা ঘটেছিল আরো ক'বছর আগে?

১৪
নিস্তব্ধ বাড়িটা সন্ধ্যে উতরোনোর সঙ্গে সঙ্গেই যেন একটু চঞ্চল হয়ে উঠলো। আধো অন্ধকারে সবাই উঠোনে নেমে এলো ঘর থেকে। নিচু স্বরে কথা আর ফোঁপানো কান্নাও যেন যুগপৎ শোনা যাচ্ছে। বেশি সময় না নিয়ে ভিড়টা দুভাগে ভাগ হয়ে গেল । এক ভাগ উঠোনের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়লো। আর এগোল না। বাকি একভাগ চলতে শুরু করলো। চলন্ত ভাগটা সরকারী রাস্তায় ওঠার পর আবছা আলোয় বোঝা গেল সামনে রবীন্দ্রবাবু,পেছনে দুটো ছোট বাচ্চার সঙ্গে নিয়তি আর সবার পেছনে দিবাকর,তার হাতে একটা বোঁচকা।  সন্ধ্যা অতিক্রান্ত শ্রীমন্তপুর আমিত্তিপুরের পথ বেশ সুনশান। হঠাৎ দু একজন দেখা যায়। নীরবেই চলছিল সকলে। কিন্তু আমিত্তিপুরের ঘাটের কাছাকাছি হতেই হঠাৎ শোনা গেল--- দাদা নাহি? মফিজ মিঞা কাছাকাছি হতেই রবীন্দ্রবাবু চিনতে পারলেন। --রওনা হইলেন নাহি? এই সময় রওনা হওয়ার একটাই অর্থ হিন্দু হলে দেশছাড়া হওয়া।---না এই মাইয়া যাইবো  শ্বশুর বাড়ি--নাওয়ে তুইল্যা দিয়া আসি--রাইতে ছাড়াত অহন আর যাওন যায় না।---হ দেশের যা অবস্থা-- সাবধানে যাইওগো মা--উফরওলার ভরসা রাইখো। সজ্জন মফিজ সন্ধ্যের নামাজ অন্তে এই সময় রাস্তায় পায়াচারি করেন। রবীন্দ্রবাবু পার হতে হতে বললেন--সাবধানত থাহে হগলেই—অহন উপরওলার দয়া--। --হ হ দোয়া করি --আল্লার ইচ্ছায় মাইয়া নিরাপদেই পওছাবো--চিন্তা কইরেন না।  

ঘাটে অধীর একদম প্রস্তুত। তার সময় জ্ঞান আছে। কখন রওনা হলে কখন গিয়ে কোন জায়গায় পৌঁছাবে সব তার জানা। এমনি দেখলে এখন তারে চেনা মুষ্কিল। একটা ময়লা ফতুয়া আর লুঙ্গিতে তার চেহারা এখন অন্য মানুষের। মাথায় বাঁধা গামছা। বাবাকে প্রণাম করতে গিয়ে নিয়তি টের পেল বাবা অঝোরে কাঁদছে। বাবা এই কমাসে সম্পূর্ণ বদলে যাওয়া একজন। পরিবেশের চাপে মানুষের পরিবর্তন এখন কারো চোখে আলাদা ভাবে চিহ্নিত হওয়ার উপায় নেই যদিও,কারণ সবারই এক অবস্থা, তবু এক ঝলক দেখে নিয়তি ভেবে নিতে পারলো যে বাবা খুব অসহায়।নিজে কিছুটা জলে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে হাত ধরে পরম স্নেহে বাবা তাকে নৌকোর পাটাতনে তুলে দিয়ে মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করলেন। যেন এই মুহূর্তে এক আকাশ নক্ষত্র সাক্ষী রেখে তিনি সব বিপদ বাঁধা নিজের দিকে টেনে নিয়ে মেয়ের যাত্রা নিরাপদ করে দিলেন। অধীর মাঝি--দাদা এইবার বাড়ির বর রওনা দ্যান--বলে লগিতে জোরে একটা চাপ দিয়ে নৌকাটাকে খালের মাঝাবরাবর নিয়ে গেল। সরিষার খাল নামে খ্যাত এই খালটি আমিত্তিপুরের কাছেই বাঁক নিয়ে দক্ষিণ পশ্চিমের দিকে চলে গেছে। জল থেকে উঠে রবীন্দ্রবাবু বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হওয়া পর্যন্ত নৌকাটিকে লক্ষ্য রাখলেন। নৌকায় বাতি জ্বালানো নিষেধ বলে অন্ধকারে কাউকে আর ঠাহর করা গেল না। শরৎকালের শান্ত খালের জলে নৌকাটির চলে যাওয়ার চিহ্ন কিছুক্ষণ থেকে মিলিয়েও গেল। বুকটা বেশ শূন্য বোধ হলো।

খুব আনমনে রবীন্দ্রবাবু বাড়ির পথ ধরলেন। এইদেশেই তার জন্মকর্ম বিবাহ সংসার সব কিছু। কেন যেন মনে হল এত অনিত্যতা মানুষের কি মানায়? এত দীর্ঘকাল ধরে একটা দুর্যোগ চলতে পারে! ইতিহাসে থাকলেও, রবীন্দ্রবাবুর জানা নেই। অনেকের মতো এই  মাটিতেই তার নাড়ী পোঁতা আছে। আক্ষরিক অর্থেই যেন এই নাড়ীর টান তার আছে। কত মানুষকেইত চোখের সামনে দিয়ে চলে যেতে দেখেছেন সেই টান ছিন্ন করে । কিন্তু নিজের চলে যাওয়ার কথা কখনো ভাবতে পারেন নি। এটাই এখন তার দোষ হিসেবে সবাই দেখে। পরিস্থিতির চাপে নিজেও নিজেকে কখনো দোষী ভাবেন বৈকি। কিন্তু সেটা সাময়িক। আজ এই সন্ধ্যে রাতে কেন জানি নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করছে। মেয়েটাকে এভাবে পাঠানো কি ঠিক হলো—এই অবস্থায়—অন্য কিছু কি ভাবা যেত না--জলেই ভাসিয়ে দিয়ে এলাম!--চোখের জলের আর বাঁধ নেই এখন। নির্জন এই আবছা অন্ধকার তাকে ক্রমশঃ টেনে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে, নাকি আরো কোন অন্ধকারের দিকে, যা  জানে না সে।    

১৫
সম্ভবত ১৯৩৩ সালে সুপ্রভার বিয়ে হয় রবীন্দ্রবাবুর সঙ্গে। পিতৃগৃহ ছিল বারহাট্টা অঞ্চলের দশাল নামক গ্রামে। শুকনোর দিনে বিয়ে  হয়েছিল। বিয়ের পর পালকি করে একটা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল স্বামীর ঘরে আসার জন্য। আর তাতে সারা শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছিল, মনে আছে সুপ্রভার। ঐ একবারই পালকিতে চড়া। পরে নিজের মেয়েদের বিয়েতে পালকি লাগলেও যাত্রা পথ তাদের বেশি   ছিলনা। বাড়ি থেকে মোহনগঞ্জ রেল ইস্টিশন। ৪ মাইল রাস্তা। তারপর রেলগাড়ি করে যাওয়া। পালকি দেখলে এখনও সুপ্রভার শরীর ব্যাথা হওয়ার কথা পড়ে। আরো মনে পড়ে যে গোধূলী বেলায় শ্রীমন্তপুরের বাড়ির সামনে যখন পালকি থামলো তখন নতুন বউ দেখার জন্য কত ভিড়,কত আগ্রহ বউ ঝিদের । কিন্তু স্বপ্ন ভঙ্গ হতে দেরি হয়নি। মুখের কাপড় সরিয়ে ঠোঁট-কাটা কেউ হয়তো মন্তব্যটা করে থাকবে যে—অ মা—এই দু দেহি কড়াইয়ের লাহান কালা রঙ। সুপ্রভার হুশ ফিরেছিল যে তার গায়ের রঙ কালো। তবে তার অতি ফর্সা  শাশুরি বলেছিলেন গা’ এর রঙ দিয়া কি অইবো—আমি বংশ দেইখ্যা বউ আনছি। সুপ্রভা সেদিনই জানলো যে তাদের বংশ উঁচু বংশ ছিল। কিন্তু গাত্র বর্ণ বংশ --এসব নিয়ে ভাবার সময় সুপ্রভা বেশি পাননি। বৌ-ভাতের দিন তার স্বামী হঠাৎ করে অজ্ঞান হয়ে গেলেন।  খবরটা কানে যেতেই বুকটা তার কেমন শূন্য বোধ হলেও সামলে নিলেন কোন ভাবে।মাথায় জল, ডাক্তার কবিরাজ—বাড়িশুদ্ধ হুলুস্থুলের মধ্যে ঘোমটার আড়াল থেকে সুপ্রভা একঝলক দেখে নিলেন স্বামীকে। বারান্দায় শায়িত সাদা মোমের মত গা’এর রঙ এর ক্ষীণ স্বাস্থ্যের এক যুবক। বিয়ে বাড়ির হৈচৈ ধকল বোধ হয় সহ্য হয়নি। জ্ঞান ফিরলেও তারপর সারারাত ঘুমন্ত এক স্বামীকে নিয়ে ঠায় বসে কাটে তার ফুলশয্যার রাত।

নতুন বৌকে অনেক নিন্দে-মন্দ শুনতে হয়। যেমন গা’এর রঙ শ্যামলা হলে সেটা হবে কড়াইয়ের মত কালো। সুপ্রভার স্বাস্থ্য ভাল,  সুগঠিত—সেটা শুনতে হয়েছে--অ—রোগা পাতলা ছেরা ভয়েই আগে আগে ফিট অইয়া গেছেগা—কীবায় কী ঘর সংসার করবো—ভগমান  জানে। তখনকার দিনের আন্দাজে সুপ্রভার বিয়ে একটু বয়স হয়েই হয়েছিল। বিয়ের সময় সে ছিল অষ্টাদশী। এসব নিয়েও প্রতিবেশীদের খোঁচানো কম ছিল না। কিন্তু সেই অজ্ঞান হওয়ার ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েই তার সংসার জীবন শুরু হয়। রুগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে অসম্ভব খিটখিটে বদরাগী এক স্বামী তার প্রাপ্য হয়। প্রায় লেখাপড়া না-জানা সুপ্রভা তার বুদ্ধির প্রখরতা দিয়ে কিছুদিনের মধ্যেই সংসারে হাল ধরে নেয়। যৌথ সংসার থেকে তাদের যখন আলাদা করে  দেয়া হয় তখন তাদের সংসার ছোট। বিধবা সৎ শাশুরি  আর তাদের ছোট ছোট  দুটি বাচ্চা। বড়টি মেয়ে পরেরটি ছেলে। কৃষি নির্ভর পরিবার, ফলে বেশ কিছু কামলাও তাদের ভাগে পড়লো। এরপর আর নিন্দে মন্দ শোনার জন্য সুপ্রভার পেছনে তাকানোর সময় হয়নি। পরিবারের সকল ভার তার উপর। রান্নাবান্না,জামা কাপড় ধোয়া, মাটির ভিটে  মাটিরই সব কিছু—তার লেপাপোছা,ধান শুকোনো,ধান সিদ্ধ করা, অতঃপর ঢেঁকি ঘরে ধান ভেনে চাল বের করা---এক কথায়  গ্রাম্য সংসারের যাবতীয় কাজ বাড়ির বউকেই করতে হয়। যে ঠিক মত করতে পারবে সে টিঁকে যাবে। টিঁকে সহজে অনেকেই যায় না। অনেকেই রোগে ভোগে অকালে বিদায়ও নেয়। সুপ্রভা টিঁকেছিল। কারণ তার শরীরে সামর্থ্য ছিল। সামর্থ্য ছিল অন্তত দু তিন বছর অন্তর অন্তর সন্তানের জন্ম দেয়ারও। ফলবতী স্ত্রীলোক ছাড়া গ্রাম সমাজে স্ত্রীসত্ত্বার কোন মূল্য নেই। একে একে দশটি সন্তানের মা হলেন সুপ্রভা।  

ঐ সময়ের এক অতি প্রান্তিক বাংলার গ্রামে যে যুগ চলছে তাকে প্রাক আধুনিক যুগ বলা যায়। দু একজন শিক্ষিত মানুষ থাকলেও অধিকাংশের ছিটেফোঁটা পড়াশোনা অথবা নিপাট নিরক্ষর। দৃশমান কুসংস্কারের আড়ালে অদৃশ্য রোগ জীবানুর মত অসংখ্য কুসংস্কারে ঘেরা গ্রাম জীবন। মাথার উপর ধর্মের সার্বিক আবরণ। সঙ্গে অশিক্ষিত এক পুরুষতন্ত্র। নারীর অবস্থান যেখানে যৌনতা আর শ্রমের নিষ্পেষনে ঘেরা। এরমধ্যেই সুপ্রভার জীবনের চাকা গড়াতে শুরু করলো। সব কিছু ভবিতব্যের হাতে ছেড়ে দেয়ার মানুষ ছিলেন না সুপ্রভা। নিজের লক্ষ্য নিজে নিজেই স্থির করে নিলেন। এ বিষয়ে বিশ্বস্থ এক সাহায্যের হাত পেয়েছিলেন, যেটা তার শাশুরির হাত। একটা  জিনিষ তারা শুরুতেই ঠিক করে ফেলেছিলেন যে অন্তত ছেলে সন্তানগুলোকে মুর্খ রাখা চলবে না।কৃষি জমি নির্ভরতার অবসান ঘটাতে হবে। তাই যে ভাবেই হউক তাদের লেখা পড়া শেখাতে হবে। মেয়েদের হয়তো ততটা সম্ভব না । এই প্রান্তিক অঞ্চলেত নয়ই। তবে প্রাইমারী শিক্ষা যদি পেতে পারে, যদিও খুব কঠিন কাজ সেটা--। তাছাড়া মেয়েদের শিক্ষা সম্পর্কে তাদের উভয়েরই কোন পূর্ব ধারণা নেই। এতদঞ্চলে বর্তমান সময় পরিসরে একটি শিক্ষিত মেয়ের অবস্থান কী হতে পারে সেই ভাবনাটা ভাবতে তারা অক্ষম হয়ে পড়ে। যদিও সবটাই তাদের টিঁকে থাকার প্রশ্নে ভাবা।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য