বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ১২-১৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৮ ১২:৫৯:০৫

কাজী মাহবুব হাসান:

[পুর্ব প্রকাশের পর...]
১২
কাঁধের উপর ডানা ঝাঁপটানো দৈবাৎ ঘটনার পাখীগুলোর অস্থিরতায় বাধ্য হয়ে তেরেজা এক সপ্তাহের ছুটি নেয় এবং তার মাকে কিছু না বলেই প্রাহা অভিমুখে একটি ট্রেনে উঠে বসে। সারাটা পথে তাকে বার বার টয়লেটে যেতে হয়েছিল, আয়নায় নিজেকে দেখতে এবং তার আত্মার কাছে প্রার্থনা করতে তার শরীরের উপর থেকে যেন তারা প্রস্থান না করে, বিশেষ করে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এমন একটা দিনে। এরকম কোনো একবার আয়নার সামনে দাড়িয়ে সে খানিকটা ভীত হয়ে পড়ে: কারণ গলায় হালকা অস্বস্তির একটি অনুভূতি সে টের পায়, এই গুরুত্বপূর্ণ দিনে কি তার কোনো অসুখ করে বসলো?

কিন্তু ফিরে যাবার আর উপায় নেই তার। সুতরাং প্রাহাতে পৌঁছে সে টমাসকে স্টেশন থেকে ফোন করে, এবং যেই মুহূর্তে টমাস তার ফ্ল্যাটের দরজা খোলে, তার পেটের মধ্যে অস্বস্তিকর একটি গুঢ় গুঢ় শব্দ শুরু হয় বেশ জোরে শোরে। ভীষণ বিব্রত হয়েছিল তেরেজা। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন তার মাকে পেটের মধ্যে বহন করে এনেছে এবং এটা তার মায়ের সেই তিক্ত হাসির শব্দ, যেন টমাসের সাথে এই দেখা হওয়ার মুহূর্তগুলো নষ্ট হয়।

প্রথম কয়েক সেকেন্ডে তার ভয় হচ্ছিল সে হয়ত বমি করে তার মাকে পেটের ভিতর থেকে বের করে দেবে এই ক্রমাগত স্থূল শব্দ করার জন্য, কিন্তু তখনই টমাস এগিয়ে এসে তাকে আলিঙ্গন করে। তেরেজা কৃতজ্ঞতা বোধ করে তার পেটের শব্দগুলোকে উপেক্ষা করার জন্য এবং তীব্র আবেগের সাথে সে টমাসকে চুমু খায়, তার চোখ তখন অশ্রুতে ভেজা। এক মিনিট শেষ না হতেই তারা সঙ্গম শুরু করে, মিলনের সময় তেরেজা চিৎকার করছিল, ততক্ষণে তার গায়ে জ্বর এসে গেছে, তাকে ততক্ষণে আক্রমণ করেছে ফ্লু। তার জমাট আর লাল হয়ে যাওয়া ফুসফুসে তার শরীরের বাইরের নলের মুখ অক্সিজেন সরবরাহ করছিল।

দ্বিতীয়বার যখন সে প্রাহাতে আসে, তার সাথে তখন ভারী একটি সুটকেস ছিল।  সমস্ত জিনিস সে গুছিয়ে নিয়ে এসেছিল সেটাতে করে, সেই ছোট শহরে আর কোনদিনও ফিরে না যাবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় টমাস তাকে তার বাসায় নিমন্ত্রণ করে; প্রথম রাতটা সে কাটিয়েছিল একটা সস্তা হোটেলে। সকাল বেলা সে তার ভারী সুটকেসটা নিয়ে যায় স্টেশনে, সেখানেই রেখে আসে। বাহুর নীচে ‘আনা কারেনিনা’ নিয়ে সে সারাদিন প্রাহার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিল। এমনকি যখন টমাসের দরজায় ঘণ্টি বাজায়,  টমাস দরজা খোলে, তখনও বইটাকে সে তার কাছ থেকে আলাদা করেনা। যেন টমাসে জগতে ঢোকার জন্য সেটি একটি টিকেট। সে বুঝতে পারে যে, এই হতভাগা টিকিটটা ছাড়া তার আর কিছুই নেই।এবং সেই ভাবনাটা তার চোখে প্রায় অশ্রু নিয়ে আসে। যেন কাঁদতে না হয়, সে বেশী এবং জোরে জোরে কথা বলে, এবং আবারও টমাস তাকে আলিঙ্গন করে বুকে টেনে নেয় এবং প্রায় সাথে সাথেই তারা মিলিত হয়।  সে এমন একটা কুয়াশার মধ্যে প্রবেশ করেছিল যেখানে কিছুই দেখা যায় না, শুধু তার চিৎকার এর শব্দ শোনা যায়।

১৩
না দীর্ঘশ্বাস, না গোঙ্গানি, আসলে সেটা তীব্র চিৎকার ছিল। এত জোরে তেরেজা চিৎকার করছিল, যে টমাস তার মুখের কাছ থেকে মাথা সরিয়ে ফেলেছিল; ভয় পেয়েছিল তার কানের এত কাছে তেরেজার কণ্ঠস্বর, যেন  কানের পর্দা না ছিঁড়ে যায়। এই চিৎকার তার ইন্দ্রিয় সুখানুভূতির প্রকাশ নয়। কারণ ইন্দ্রিয় সুখানুভূতির হচ্ছে সব ইন্দ্রিয়গুলোর একই সাথে অংশগ্রহণ: কেউ তার সঙ্গীকে লক্ষ্য করে গভীর মনোযোগে, প্রতিটি শব্দ শোনার তীব্র প্রচেষ্টায়। কিন্তু তার চিৎকারের লক্ষ্য যেন সব বোধকে অসাড় করে দেয়া, যা সব দেখা আর শোনাকে প্রতিহত করে। তেরেজার এই চিৎকারটা আসলে, তার ভালোবাসার অবোধ আদর্শবাদীতার সকল দ্বন্দ্বকে নির্বাসন দেবার একটি প্রচেষ্টা, শরীর এবং আত্মার দ্বৈততাকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা, হয়তো এমনকি সময়কেও মুছে ফেলার চেষ্টা।

তেরেজার চোখ কি বন্ধ ছিল এসময়? না, কিন্তু সেগুলো বিশেষ কোনো দিকে তাকিয়েও ছিল না। মাথার উপর ছাদের একটা শূন্যতায় তার দৃষ্টি স্থির হয়ে ছিল। মাঝে মাঝে সে তার মাথা জোরে জোরে এপাশ ওপাশ নাড়িয়েছে শুধু।
যখন চিৎকার কমে যায়, সে টমাসের হাত ধরে তার পাশে ঘুমিয়ে পড়ে, সারা রাত তেরেজা টমাসের হাত ধরেই রাখে।

এমনকি তার আট বছর বয়সেও, সে একহাত অন্যহাতের মধ্যে জোর করে চেপে ধরে ঘুমাতো, যে মানুষটাকে ভালোবাসে যেন তার হাত ধরে আছে সে, এই বিশ্বাসে, তার জীবনের সেই পুরুষ। সুতরাং ঘুমের মধ্যেও কেন তেরেজা এত জোরে টমাসের হাত ধরে রাখতো, তার কারণটা আমরা বুঝতে পারি: ছোটবেলা থেকেই সে এর প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য