বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ১৪-১৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১১ ০৩:৪৯:৪৩

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
১৪
আরে বড় কোনো কিছু অনুসরণ করার সুযোগ দেবার বদলে একজন তরুণী, যাকে কিনা বাধ্য করা হয়েছিল মাতালদের মদ আর ভাইবোনদের পরিষ্কার অন্তর্বাস সরবরাহ নিশ্চিত রাখার জন্য, প্রাণশক্তির বিশাল একটি মজুত সে গড়ে তুলেছিল, যে প্রাণ শক্তি বইয়ের উপর হাই তোলা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারা কখনো স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারবে না। তেরেজা তাদের চেয়ে অনেক বেশী পরিমাণে পড়াশুনা করেছে, এবং জীবন সম্বন্ধে শিখেছে তাদের চেয়ে অনেক বেশী, কিন্তু কোনদিনও তেরেজা ব্যাপারটি অনুধাবন করতে পারেনি। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক আর স্বশিক্ষিত কারোর মধ্যে পার্থক্য, তাদের জ্ঞানের পরিধিতে ততটা বেশী নয়, যতটা তাদের প্রাণশক্তি এবং আত্মবিশ্বাসের পরিমাণে। যে প্রাণশক্তি নিয়ে তেরেজা প্রাহায় তার নতুন জীবন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তা একই সাথে উন্মত্ত আর বিপজ্জনক। মনে হয় যেন সে প্রত্যাশা করেছিল, হয়ত কেউ যে কোনো একদিন তার দিকে এগিয়ে এসে বলবে, ‘তুমি এখানে কি করছো? যেখান থেকে এসেছো সেখানে ফিরে যাও’! শুধুমাত্র একটি সুতোয় যেন ঝুলছিল তার জীবনের সব আকাঙ্ক্ষা: টমাসে গলার স্বর। কারণ টমাসে গলার স্বরই তার লাজুক আত্মাকে তার অন্ত্রের গভীরে লুকোনো জায়গা থেকে প্ররোচিত করে বের করে এনেছিল।

ফটোগ্রাফি ডার্ক রুমে তেরেজা কাজ পেয়েছিল, কিন্তু সেটা তার জন্য যথেষ্ট ছিল না।  সে ছবি তুলতে চাইতো, তাদের ডেভোলপ করতে না। টমাসের বন্ধু সাবিনা তিন চারটি বিখ্যাত ফটোগ্রাফারের মনোগ্রাফের বই তাকে ধার দিয়েছিল, তারপর একদিন একটি ক্যাফেতে, এই বইগুলো খুলে সে তেরেজাকে প্রত্যেকটা ছবি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়েছিল, কোন বিষয়গুলো সাধারণ অন্য যে কোন ফটোগ্রাফের তুলনায় এদের ব্যতিক্রম করেছে। তেরেজা নীরব এবং গভীর মনোযোগের সাথে সাবিনার কথাগুলো শুনেছিল, যে মনোযোগ খুব কম শিক্ষকই তাদের শিক্ষার্থীদের চোখে মুখে দেখে থাকেন।

সাবিনার কল্যাণে, ফটোগ্রাফি আর পেইন্টিং এর মধ্যে যোগসূত্রটা সে বুঝতে সক্ষম হয়েছিল এবং টমাসকে সে বাধ্য করেছিল প্রাহায় অনুষ্ঠিত হওয়া সব প্রদর্শনীগুলোয় তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এর কিছু দিনের মধ্যে তেরেজার নিজের তোলা ছবি যে পত্রিকায় সে কাজ করতো, তার পাতায় আসতে শুরু করে। এবং অবশেষে ডার্করুম ছেড়ে সে পেশাজীবী ফটোগ্রাফার স্টাফদের দলে যোগ দেয়।

সেই দিন সন্ধ্যায়, সে আর টমাস, তাদের কয়েকজন বন্ধুদের সাথে একটি বারে যায়, তার পদোন্নতির বিষয়টি উদযাপন করার জন্য। সবাই সেখানে নেচেছিল। শুধু টমাস বিষণ্ণ হয়ে পড়তে শুরু করেছিল; এরপর বাসায় ফিরে, তেরেজার বেশ কিছুক্ষণ জেরার মুখে, সে স্বীকার করে, তার এক সহকর্মীর সাথে তাকে নাচতে দেখে তার ঈর্ষা হয়েছিল।

‘তুমি বলতে চাচ্ছো আসলেই তোমার হিংসা হচ্ছিল’? তেরেজা তাকে প্রায় দশবার বা আরো বেশী অবিশ্বাসের সাথে জিজ্ঞাসা করেছিল, যেন ঠিক সেই মুহূর্তে তাকে কেউ সংবাদ দিয়েছে যে, সে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছে।

তারপর টমাসের কোমর হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে, তেরেজা সারা রুম জুড়ে নাচতে শুরু করে; বারে যেভাবে সে নেচেছিল ঠিক সেভাবে না, এবার অনেকটা গ্রামের পোলকা নাচের মতো, যেখানে উন্মত্ততা আছে, শূন্যে তার পা উঠছে, সারা ঘর জুড়ে তার শরীর লাফাচ্ছে, তার সাথে আটকে আছে টমাস।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে অল্প কিছু দিনের মধ্যে তেরেজা নিজেই ঈর্ষার শিকার হতে শুরু করে এবং টমাসের কাছে তার ঈর্ষা নোবেল প্রাইজের মত মনে হয়নি, বরং একটা বোঝার মত মনে হয়েছিল, যে বোঝার ভার তাকে বহন করতে হয়েছে প্রায় তার মৃত্যু অবধি।

১৫
স্বপ্নে যখন নগ্ন তেরেজা সুইমিং পুলের চারপাশে নগ্ন নারীদের একটা দলের সাথে মার্চ করছিল, টমাস এই পুলের উপরের গম্বুজের মত ছাদ থেকে ঝোলানো একটা ঝুড়িতে দাড়িয়ে তাদের তদারকি বরছিল এবং তাদের চিৎকার করে তাদেরকে গান গাইতে নির্দেশ দিচ্ছিল এবং হাঁটু ভাজ করে অনুশীলন করার জন্য বাধ্য করছিল; যে মুহূর্তে তাদের একজন হাঁটু ভাঙ্গার অনুশীলনে সামান্য ভুল করছিল, সে তাকে গুলি করছিল।

তেরেজার দেখা সেই স্বপ্নটাতে আমাকে ফিরে আসার অনুমতি দেয়া হোক। স্বপ্নটির বিভীষিকা কিন্তু টমাসের পিস্তল থেকে ছোড়া প্রথম গুলি থেকে শুরু হয়নি; তেরেজার জন্য একেবারে শুরু থকে এটা ভীতিকর। নগ্ন হয়ে একদল নগ্ন রমণীদের সাথে এভাবে মার্চ করাটা তেরেজার জন্য আতঙ্কের একটি অবধারিত প্রতিচ্ছবি। যখন সে তার নিজের বাসায় ছিল, তার মায়ের নিষেধ ছিল বাথরুমের দরজা বন্ধ করতে; এই নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তার মা যা বোঝাতে চাইতো, তা হলো: তোমার শরীর আর অন্য সব শরীরের মতই, আলাদা কিছু নেই, লজ্জা পাবার কোন অধিকার তোমার নেই; তোমার কোনো কারণই নেই এমন কিছু লুকিয়ে রাখা যার অসংখ্য লক্ষ লক্ষ হুবহু প্রতিলিপির অস্তিত্ব আছে। তার মার জগতে সব শরীরই এক, একে অপরের পেছনে মার্চ করে যাচ্ছে। ছোটবেলা থেকেই তেরেজা তার নগ্নতাকে দেখেছে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের সমরূপীতার চিহ্ন হিসাবে, অপমানের চিহ্ন হিসাবে।

তেরেজার জন্য এই স্বপ্নের শুরুতে আরো একটা আতঙ্কের ব্যাপার ছিল: নারীদের সবাইকে গান গাইতে হবে, শুধু যে তাদের শরীর একে অপরের হুবহু প্রতিলিপি তাই নয়, একই ভাবেই তারা মূল্যহীন, কিংবা শুধু যে তাদের শরীর আত্মা বিবর্জিত শূন্য কোনো যন্ত্র মাত্রই নয় –  স্বপ্নের সেই নারীদের দল এর জন্য উল্লসিত! আত্মাহীনদের এক আনন্দময় সৌহার্দময় একতায়।  এই নারীরা যেন সন্তুষ্ট - তাদের আত্মার বোঝাটা ঝেড়ে ফেলে দিতে পারার জন্য – সেই হাস্যকর অহংকার, সেই স্বকীয়তার একটি বিভ্রম –কাছের নারীটির মতাই হয়ে ওঠার জন্য। আরো একজন। তেরেজা তাদের সাথে গান গেয়েছিল, কিন্তু সে তাদের মত আনন্দিত হতে ব্যর্থ হয়েছিল। তার গান গাইবার কারণ ছিল, তার ভয়, যদি সে গান না গায়, অন্য রমণীরা তাকে হত্যা করতে দ্বিধা করবেনা।

তাহলে এই স্বপ্নে টমাসের গুলি চালিয়ে তাদের একে একে হত্যা করা এবং সুইমিং পুলের পানির ছুড়ে ফেলার ব্যাপারটা তাহলে কি অর্থ বহন করছে?  

রমণীরা তাদের সমরূপীতায় তীব্রভাবে আনন্দিত, বৈচিত্র্যহীন, আসলেই তারা তাদের আসন্ন মৃত্যুকে উদযাপন করছে , যা তাদের সমরূপীতাকে সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত একটি রূপ দেবে। সুতরাং টমাসের গুলি চালানোটা তাদের এই ভয়ঙ্কর মার্চের আনন্দময় একটা চূড়ান্ত অবস্থা। তার পিস্তলের প্রতিটি গুলির শব্দে তারা চিৎকার করে হেসে উঠছে এবং যখন তাদের মৃতদেহ পানি নীচে ডুবে যাচ্ছে তখন তারা আরো জোরে গান গেয়ে উঠছে।

কিন্তু টমাসই বা কেন গুলি করছে? কেন বাকীদের মত সে তেরেজাকেও খুঁজছে গুলি করার জন্য।

কারণ সে নিজেই তেরেজাকে এই রমণীদের দলে যোগ দেবার জন্য পাঠিয়েছে। টমাসকে এই স্বপ্নটা সেটাই বলতে চাইছে, তেরেজা যা নিজে বলতে পারে না। সে তার মায়ের পৃথিবী থেকে পালিয়ে তার কাছে এসেছে, যে মায়ের পৃথিবীতে সব শরীরই এক, সমরূপী। সে টমাসের কাছে এসেছে তার শরীরকে অনন্য করে তুলতে, যা অপ্রতিস্থাপনযোগ্য। কিন্তু টমাস, সেও, তার এবং বাকী সবার শরীরের মাঝখানে একটা সমান সমান চিহ্ন বসিয়ে দিয়েছে: সে সবাইকে একই ভাবে চুমো খায়, একই ভাবে আদর করে, এবং অন্য কোন শরীরের সাথে তেরেজার শরীরের একেবারে কোন ধরনের পার্থক্যই সে করে না। যে জগতটা থেকে সে পালিয়ে এসেছিল, টমাস তাকে আবার সেই জগতেই ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে, অন্য নগ্ন রমণীদের মত নগ্ন হয়ে মার্চ করতে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য