ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৩ ২১:৪২:৫৯

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২৫
নৌকা লগি দিয়ে ঠেলে মাঝ গাঙে নেয়ার পর অধীর  বৈঠা নিয়ে বসে। জল বেশি। এবার সঙ্গী হিসেবে সে হানিফ ছাড়াও গ্রামের আর একজন ছেলেকে নিয়েছে। তার আসল নাম পরাণ। পরাণ অধীরেরই ছেলে । কিন্তু এটা বলা যাবে না নিরাপত্তার খাতিরে। তারা দুজনেই  মুসলমান পরিচয়ে যাচ্ছে। বুদ্ধি কাজে লাগবে কিনা কেউ জানে না। তবু বিপদে একজনের পরিচয় ফাঁস হলে দুজনেই যাতে বিপদে না পড়ে। বাঁচার জন্য কত কি করতে হয়। এখন তার নাম দেয়া হয়েছে মোতালেব। ডাক নাম মৈত্যা। সে তার বাবার মতই দক্ষ মাঝি। সওয়ারি বওয়ায় কাজ সে করে না। সে মালামাল আনা নেয়া করে। হানিফের কাজ টুকটাক। প্রয়োজনে বৈঠাও ধরে। তবে এই সময় অধীর আর মৈত্যা দুজনের হাতেই বৈঠা। মাঝ রাত্তিরটায় তাদের ইচ্ছা রাজাখালি খাল শেষ করে তারা হাঁসকুরি বিল পার হবে। বর্ষায়  এসব বিল হাওরে পরিনত হয়। চারদিকে শুধু জল আর জল। দিক ঠিক রাখা মুষ্কিল। তবে এ-সব জল-পথ অধীরের হাতের তালুর মত  চেনা। ঘন্টা দুয়েক চলার পর অধীর তার নিজের জায়গায় মৈত্যাকে বসিয়ে একটু তামাক নিয়ে বসলো। হানিফ জোরাজুরি করছিল বৈঠা ধরার জন্য। তাকে বৈঠা দেয়া হলো বটে,কিন্তু সাবধান করে দেয়া হলো যে জলের শব্দ যেন বেশি না হয়। অন্য সময় হলে এই পরিস্থিতিতে গুন গুন করে গলায় গান আসার কথা । কিন্তু আজ তা সম্ভব নয়। শুধু আজ কেন, মাঝিদের গলা থেকে গান ক’মাস হলো মুছে গেছে।

নৌকা ভেসে চলার তাল শরীরে প্রবাহিত হতে না হতেই বাচ্চাদুটো ঘুমিয়ে পড়লো। ভাদ্র-আশ্বিনের ভেজা গরম উধাও। খাল, যা এখন অনেকটা নদীর মতো— শরীর জুড়ানো হাল্কা বাতাস দিচ্ছে। নিয়তিরও চোখ বুজে বুজে আসছে, আবার পরক্ষণেই জেগে উঠছে। নৌকার ছইয়ের ভেতরটা খারাপ না—তাদের একটা পরিবারের পক্ষে চলে যায়। দুই দিকেই ঢাকা আছে। এইরকম নৌকা করে ছোটবেলা নিয়তিরা কত গেছে। ভাটির দেশের মানুষের কথাই আছে “ বর্ষায় নাও, হেমন্তে পাও”। ঘুম নেই দিবাকরের। ঠায় বসে সে । নৌকার সামনের দিকে ছইয়ের বাইরে । বিগত ক’মাসে দিবাকর চুল দাড়ি কিছুই কাটেনি। লুঙ্গি আর গেঞ্জিতে তাকে এখন আবহমানের এক নৌকাজীবী বলেই মনে হবে। মাঝে মাঝে খুব আড়াল করে বিড়ি ধরাচ্ছে আর টানছে। আদিগন্ত জল আর রাত্রির ফুরফুরে বাতাস তাকে কখনো আনমনা করতে পারছে না। মাথায় চিন্তা কীভাবে পৌঁছোবে গন্তব্যে। দুপাশের ঘুমন্ত জনপদ থেকে এখন আর আলোর ছিটেফোঁটা দেখা যাচ্ছেনা। অর্থাৎ রাত হয়েছে।

বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় সবাই যাহোক কিছু খেয়ে এসেছে। এখন প্রায় মধ্য রাত। তার মধ্যে মাঝিদের টানা পরিশ্রম চলছে, ক্ষিদে লাগার কথা। ছইয়ের ভেতর থেকে শুধু জলের ছলাৎ ছলাৎ শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ বা কথা শোনা যাচ্ছে না। একটু আগেই নিয়তি জেগে উঠে বসেছে। পাশে কখন এসে দিবাকর শুয়ে পড়েছে টের পায় নি। সন্ধ্যে রাতের জমাটি অন্ধকার এখন বেশ ফিকে হয়েছে। মেঘ মুক্ত আকাশের এই আলোই যেন তাদের দরকার। নৌকার পেছন দিক ঢাকার কাপড় সরিয়ে নিয়তি দেখলো পরাণ আর হানিফ পাটাতনের উপর ঘুমিয়ে আছে। একলা অধীর কাকা বৈঠা বেয়ে চলেছে। নিয়তি বলল—কাহা কিছু খাইবাইন—চিড়া মুড়ি গুড় আছে—দিয়াম ?---হ মা খাওন ত কিছু লাগেই—আইচ্ছা রও আর একটু বাইয়া লই।

অধীর আরো কিছুটা বেয়ে একটা জায়গায় গিয়ে নৌকাটা লাগালো। যেদিকে লাগালো সেদিকটায় ফসলের ক্ষেত—কাছাকাছি ঘরবাড়ি নেই । নদীর অন্যদিকটায় আঁচ করা যায় গ্রাম আছে। সামনে তাকালেই চোখে পড়ে বিশাল জলরাশি। ঐটাই হাঁসকুরি বিল । এখন   হাওরের  রূপ তার। পাড়ের দিকে লগি পুঁতে নৌকাটাকে বেঁধে ছেলে দু জনকে ডেকে তুললো অধীর। নিয়তির উদ্দেশ্যে বলল—লও মা  অহন চাইলে তুমি পাড়ে লামতে পারবা—পরিষ্কার জাগা—জামাইরে লইয়া লামতে পার। কথা বার্তার মধ্যে দিবাকর উঠে পড়লো। একটা বালতি আর মগ নিয়ে সে আর নিয়তি আস্তে আস্তে মাটিতে পা রাখলো। দিবাকর আর নিয়তি নামার পর একসময় বাচ্চা দুটো উঠে পড়ে। অধীর দাদুকে তারা চেনে, কিন্তু মা বাবাকে না দেখে তারা অবাক চোখে চারদিকে খুঁজছে। ছইয়ের বাইরে এসে তারা দুই ভাই দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একজন আস্তে আস্তে অধীরকে জিজ্ঞেস করলো--দাদু মায় কই গেছে। অধীর সমস্যাটা বুঝে গিয়ে বললো –মায় আইতাছে—অহনি আইয়া পড়বো —তুমরা মুতবা ভাই—তাইলে এইহান থাইক্কাই ছাইরা দেওছে দেহি। বলতেই তারা দুই ভাই মজা এবং লজ্জা মিশিয়ে কিছুটা হেসে নিল। যথারীতি তারা নৌকাতে দাঁড়িয়েই পেচ্ছাব করে নিল। নিয়তি ফিরতে ফিরতে অধীর ব্যাপারটা সামলে নিল।

একসময় সকলেই  নৌকায় এসে বসলো। নিয়তি টিন খুলে চিড়ে মুড়ি আর গুড় দিল সবাইকে। বাড়ি থেকে আনা খাওয়ার জল এখনও চলবে। পরে বিলের মাঝামাঝি থেকে খাওয়ার জল নেয়া হবে। কিছুটা বিরতি, কিছুটা বিশ্রাম শেষে তারা আবার রওনা হলো। এই বিল, যা বর্তমানে হাওড়ে রূপান্তরিত ভোরের আগেই পাড়ি দিতে হবে। আকাশ পরিষ্কার, বাতাস তীব্র নয়---এটাই হাওড় পার হওয়ার আদর্শ পরিবেশ। এই ভাটি অঞ্চলে জল-পথে রাত বিরেতে তেমন বিপদের কথা জানা নেই। তবে এখন দিনকাল আলাদা। অধীরের ইচ্ছা এই বিলটা পার হয়ে পরের বিলে পড়ার আগে জায়গা বুঝে থামতে হবে অথবা চলতে হবে। তারপর আছে রান্না খাওয়ার সামান্য ব্যবস্থা করা। দিনের আলোতে এলাকার অবস্থা আঁচ করা যাবে। এখন নৌকা বাইছে হানিফ আর মৈত্যা। অধীরের ঘুম পাচ্ছে, তবে সে ঘুমোচ্ছেনা। বিলের মাঝ বরাবর এলে নৌকার মুখ কোনদিকে যাবে দেখিয়ে সে একটু ঘুমোবে।

২৬
ভোর হতে না হতেই মানুষজনের কথায় ঘুম ভেঙ্গে গেল সবার। অনেক কথার মধ্যে একটা চড়া গলা শোনা গেল বলছে—নাউ কার—যায় কই—এই বেডা হুনছ না জিগাইতাছি। একবিল থেকে আর এক বিলে গিয়ে পড়ার পথ এই সরু খাল। দু পাশেই ঘর বাড়ি। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। প্রশ্ন-কর্তার দিকে তাকিয়ে অধীরের সন্দেহ হলো এরা শান্তিবাহিনির লোক। নৌকা করে টহল দিচ্ছে। হাতে কয়েকজনের বন্দুক আছে। নিজে উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্নকর্তাকে সালাম জানিয়ে গত কয়েকবারের অভিজ্ঞতা দিয়ে অধীর বিষয়টা সামলে নিল। ‘পোয়াতী মাইয়া’ আর ‘হাসপাতাল’ শুনে তাদের আপসে যেতে দিল। একটা বাঁধা পাড় হওয়া গেল।

ইচ্ছে ছিল একটু ছায়া দেখে নৌকা ভিড়িয়ে সকালের দিকেই রান্না খাওয়ার কাজটা সেরে নেবে। হলো না। সামনেই গাইলা বিল। মাছ  ধরার নাউ দেখা যায় অনেক। ছায়ার প্রশ্ন নেই। বেলা বাড়তে বাড়তে বাচ্চাদের খিদেও বাড়বে। বড়োরাও বাদ যাবে না। বিল শান্ত দেখে চলন্ত নৌকাতেই নিয়তি দেরি না করে তোলা উনুন জ্বালিয়ে এক হাঁড়ি ভাত বসিয়ে দিল। হানিফ সাহায্য করছে। করিৎকর্মা হানিফের কথা  এইসব রান্না সে-ই রাঁধতে পারে। তার কথা চাচির শরীলডা বালা না—চাচি শুয়ে থাকুক, সে-ই রান্না করে ফেলবে। কিন্তু কথা শুনে নিয়তি হাসলেও তার হাতে পুরোটা সে ছেড়ে দেয়নি। চাল ডাল ধোয়া, আলু কাটা, জল এগিয়ে দেয়া এসব টুকটাক সে করে দিচ্ছে আর এইসব বিলের গল্প সে চাচির সঙ্গে করে যাচ্ছে। তার ধারণা চাচির এসব অচেনা। একসময় সে বললো সকলে চাইলে সে এখানে মাছও ধরে দিতে পারে। তার কাছে ছোট একটা জাল আছে । আর বড়শিও আছে। এই বিলে নাকি অনেক মাছ। কিন্তু চাচি মাছের ব্যাপারে অরাজি। রান্নার নানা ঝামেলা। এই শরীর নিয়ে সে কোনমতে এইটুকুই করতে পারছে। নৌকায় এই লম্বা সময় বসে বসে তার পায়ের অবস্থা ভাল না।  

বর্ষায় বিল উপচানো জল যেখানে রয়েছে সেখানে গভীরতা কম। এগুলো আসলে ছিল ফসলের ক্ষেত। বর্ষার ক’মাস ডুবে থাকে।  কাছাকাছি জলের ভেতর জেগে ওঠা একটু ডাঙ্গা অংশ দেখে সেখানে  লগি পুঁতে নৌকা বাঁধা হয়েছিল। উদ্দেশ্য খাওয়ার দাওয়া । রান্না  হয়ে গেছে। ভাত, মুসুরির ডাল আর আলু ভাজা। হানিফের মতে ‘জব্বর খানা’একখান পাকানো হইছে। কেউ কেউ খাওয়ার আগে স্নানটানও করে নিল । সমস্যা হলো নিয়তির। প্রাকৃতিক কাজ তথা স্নানাদির জন্য তার একটু আড়াল লাগে। সবার স্নানাদি হওয়ার পর দিবাকর নিয়তিকে নিয়ে সাবধানে নেমে পড়লো জলে। জল খুব বেশি না । তবে কিছুটা জল ভেঙ্গে গিয়ে মাটিতে পা রাখতে হয়। বালতি ঘটি সহ নিয়তি একটু  তফাতে গিয়ে কোনমতে স্নানাদি সেরে নিল। শরীর জলের স্পর্শ পেতেই একটু সতেজ হলো মনে হচ্ছে। বদলে  নিল কাপড়ও। দিবাকর নিয়তি কেউ এতক্ষণ খেয়াল করে নি একটি ছিপ নৌকা প্রায় তাদের নৌকার গা ঘেঁসে এসে থেমে রয়েছে। নৌকায় বেশ ক’জন মানুষও আছে। শোনা যাচ্ছে অধীর মাঝির গলা। হঠাৎ চোখে পড়তেই দিবাকরের শরীর প্রায় ঠান্ডা হয়ে গেল।  চোখে পড়লো তারা নাউ এর পাটাতন তুলে তুলে দেখছে। এক সময় দূর থেকে তারা নিয়তি আর দিবাকরকেও ভালো করে লক্ষ্য করলো।  অধীর বা তার ছেলেরা কেউ তাদের দিকে তাকিয়ে কোন ইশারা করছে না। তবু তারা ধীরে ধীরে জল ভেঙ্গে নৌকার দিকে এগোতে লাগলো। ততক্ষণে অবশ্য আগত নৌকাটি আবার চলতে শুরু করে দিয়েছে। দিবাকর সন্দিগ্ধ চোখে সেদিকে মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে লাগলো। তা হলে এটা কি সেই মৃত্যুযাত্রার সূচনা?

নৌকায় ওঠে খাওয়া দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর  পাশাপাশা শুয়ে দিবাকর নিয়তির কাছ থেকে টুকরো টুকরো করে  এই মুক্তাগাছা ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কী ভাবে জন্মালো তার সবটাই শুনে নিয়েছিল।  শোনার পর থেকেই তার অনুভূতির স্তরে একটা অব্যক্ত যন্ত্রণার জন্ম হয়েছে। এখনকার এই তল্লাসির ঘটনা সেই যন্ত্রণাকেই যেন খানিকটা খুঁচিয়ে দিল। যা তাকে বয়ে নিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ জীবিত থাকবে। বহিরঙ্গে যতই তারা হিন্দু পরিচয় মুছে ফেলুক, একটু চেপে ধরলেই তা প্রকাশ হয়ে যাবে। সঙ্গে আনা বোরখা আর সুন্নতি টুপি কতক্ষণ বাঁচাতে পারবে।

খাওয়া দাওয়ার পর একসময় মৈত্যা আর হানিফের হাতে বৈঠা দিয়ে অধীর সামনের দিকে এলো। ছৈএর বাইরে দিয়ে আসাতে নৌকা কিছুটা এক পাশে হেলে গেল। অনভ্যস্ত নিয়তি ও দিবাকর তাতে চমকে গিয়ে উঠে বসলো। একটু তন্দ্রা মত এসে গিয়েছিল।–জামাই বাবা কি ঘুমাইছেন --। গলা শুনে বুঝতে পারলো অধীর এ পাশে এসেছে। দিবাকর আব্রু ঠেলে বাইরে এসে বসলো। বললো---না ঘুম আর আহে কই। দিবাকরের দেয়া একটা বিড়ি ধরিয়ে অধীর বলতে শুরু করলো। বোঝা গেল সে কথা বলতেই এসেছে। তার বক্তব্য হলো পথের পরিস্থিতি ভাল ঠেকছে না। কতদূর যাওন যাইব বলা মুষ্কিল। যাইতে পারলে আশা করা যায় সন্ধ্যে নাগাদ ধরের খালে গিয়ে পড়বো। কথা শুনে নিয়তিও আব্রু সরিয়ে মুখ বার করলো। তা দেখে অধীর আবার বললো –হুনছত মা সবই—অহন একটা মত দাও, এরপর কিতা করণ।

সময় মতই তাদের নাও ধরের খালের মুখে পৌঁছে গেছে। কিন্তু  সেখানে বেজায় ভিড় নানা ধরণের নৌকার। একটু ফাঁক মত জায়গা পেয়ে তারা তাদের নৌকা ভিড়িয়ে দিল। অধিকাংশ নৌকাতেই রান্নার আয়োজন। অধীর আর হানিফ পাড়ে গেল খাওয়ার জল জোগাড় করতে। এখানে অধিকাংশ নৌকা মাল বোঝাই। দু একটায় সওয়ারী আছে। সবাই  এখানে আটকা পড়েছে না বিশ্রামের জন্য থেমেছে বোঝা যাচ্ছে না। দিবাকরকে দেখে পাশের নৌকা থেকে একজন জিজ্ঞেস করলো—মিয়া যাইবাইন কুয়ানে? উত্তরে ‘নেত্রকোণা’ শুনে একজন খুব আশঙ্কিত হয়ে পড়লো। আর একজন রসিকতা করে বললো—ক্যারে মেলেটারিরা দাওয়াত দিছে নি আফনেরারে--।  

ইতিমধ্যে আরো দু একজন নতুন নৌকার অতিথিদের ব্যাপারে আগ্রহী হইয়ে উঠলো।----কইত্থন  আইছুইন—যাইবাইন কই—কেরে যাইতাছুইন—ইত্যাদি নানা প্রশ্নে একটা জিনিষ সাব্যস্ত হয়ে গেল যে কাজটা দিবাকররা মোটে ভাল  করে নাই—অসুখ বিসুখে এখন ঘরে পইড়া মরণ বালা—আর নেত্রকোনায় এখন লোক কই, যা আছে সব রাজাকার , শান্তি আর মিলিটারি। সব পলাইছে। হিন্দুত একঘরও  নাই—আওয়ামী করা মুসলমান নেতা কর্মী কেউ নাই--। আর রাত হলেই শুধু খুনাখুনি গোলাগুলি । মগরা নদীতে রাতে যাওয়া মানে যমের হাতে পড়া। তবু হাসপাতালে যেতে হলে দিনে যাওয়াই ভালো।

জায়গাটা অধীরের বিশেষ চেনা। যাতায়াতে বহুবার থেমেছে। জল কোথায় পাওয়া যায় জানে। এখান থেকে মাইল দুয়েক উত্তরে গেলে সেই ঠাকরোকোনার রেলব্রীজ। কিন্তু এখন সন্ধ্যার অন্ধকারে কেমন যেন ভুতুড়ে লাগছে। খুব টিমটিমে আলো নিয়ে দু একটা দোকান । লোকজন বেশ কম। নদীর পাড়ে যা দু একটা বাড়িঘর ছিল যার একটাতে ছিল টিউবকল—সেগুলো মনে হয় ফাঁকা। তবে টিউব কলে দু একজন আছে দেখা যায়। তারা দুখানি মাটির কলসি ভরে নিল। কালকের জন্য খাওয়ার জলের আর চিন্তা নাই। একটু এগিয়ে এসে   কলসীটা  মাটিতে রেখে অধীর ভাবছিল এক আনার বিড়ি নেবে কিনা। হানিফ লক্ষ্য করছিল কিন্তু--। কোমরে গোঁজা পয়সাটা বের করে  মুখ তুলতেই অধীর দেখলো তাদের ঘিরে প্রায় জনা পাঁচেকের একটি দল। সবাই কম বয়সী যুবক। তাদের একজন তাদের যাবতীয় খোঁজ খবর নিতে প্রশ্ন করা শুরু করলো। একসময় তাদের মধ্যে দুজন অধীরদের সঙ্গে সঙ্গে নৌকাতেও এলো। সব দেখে শুনে তারা বলল যে ডাক্তার হাসপাতাল করতে হলে  দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসতে হবে। এদিকের অবস্থা ভালনা। আমরা মুক্তিবাহিনির সাহায্যকারী। দুজন চলে যাওয়ার পর বোঝা গেল তারা একটা মুক্তিবাহিনির ঘাঁটিতে এসে পড়েছে। একদিকে নিরাপত্তা অন্যদিকে ভয়।  তবু যেন সবার মনে একটা আনন্দের ভাব দেখা গেল। কিন্তু খারাপ করলো নিয়তির শরীরটা। সে শুয়েই থাকলো। রাতের রান্নার ভার নিল হানিফ।

বাড়ি থেকে বেরোনোর পর আজ রাতেই সবার ঘুম বেশ গভীর । গত সারাটা দিনের ক্লান্তি ছিল সবার শরীরে। আশেপাশের একটা নিরাপদ বলয়ের কল্পনাও  তাদের আরো আশ্বস্থ করে থাকবে। কিন্তু মাঝ রাতের দিকে চাপাস্বরে কিছু কথা শুনতেছিল অধীর। একসময় তাদের নৌকায় কারোর উঠে আসাও যেন টের পেল। তাতে অধীরের ঘুমটা পুরোপুরি ভেঙ্গেই গেল। শুনতে পেল চাপা গলায় কেউ বলছে—অ মিয়া নাউ খুইল্যা ভাগ তারাতারি—উড উড—সময় নাই কইলাম--। অধীর জেগে দেখতে পেল একজন তাদের নৌকা থেকে লাফ দিয়ে পাশের নৌকায় চলে গেল। অন্যান্য নৌকাগুলো ইতিমধ্যেই নদীর মাঝামাঝি চলে গেছে। আধীর খব দ্রুত নৌকার বাঁধন খুলে লগি টেনে নিয়ে সেও নৌকা ঠেলে ভাসিয়ে দিল। একসময় পাশাপাশি নৌকার মাঝিদের কাছ থেকে  জানা গেল যে শম্ভূগঞ্জ আর ময়মনসিং এর মাঝে ব্রহ্মপুত্র ব্রীজ ভেঙ্গে ফেলেছে মুক্তিযোদ্ধারা।  খবরটা ছড়িয়ে পড়তেই মিলিটারি এবং তাদের দোসররা ব্যাপক হত্যাকান্ডে মেতে উঠেছে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাদের ভাটি অঞ্চলের দিকে সরে যেতে হবে। তাদের পরামর্শ অধীর যেন তার নৌকা নিয়ে যতটা সম্ভব তফাতে থাকে। বোঝাই যাচ্ছে নৌকাগুলোতে কিছু মুক্তিযোদ্ধাও আছে।

২৭
বিগত ক’মাস যাবৎ দেশজুড়ে নানান অরাজকতা,গোলমাল,স্বাধীনতার লড়াই, মুক্তি আন্দোলন-- ইত্যাদির মধ্য থেকে ‘সংগ্রাম’ নামে  একটা শব্দ মানুষের মুখে মুখে বেশ চলছে। প্রত্যন্ত গ্রাম দেশেও এই শব্দটা দিয়েই অনেক কিছু বোঝানোর চেষ্টা হচ্ছে। যেমন,- অমুক জায়গার সংগ্রামের খবরডা হুনছুইন নাহি—বা হালার পুতেরা সংগ্রামের ডরে আর এই বর আইতনা—ইত্যাদি। আর এই শব্দটির সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের নানান কর্মকান্ডই মূলত যুক্ত। বঙ্গদেশের সুবিখ্যাত বর্ষা যখন পাততাড়ি গোটাতে শুরু করেছে তখন সেই ভেবে রাখা মিলিটারি আক্রমণের আতঙ্কও ছিল পাশাপাশি। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা যে গোপনে গোপনে এতটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে তা সাধারণ মানুষেরা ধরতে পারেনি। এদিকে ওদিকে ‘সংগ্রাম’এর ঘনঘটায় তারা যুগপৎ শিহরিত ও চিন্তিত।

২৫শে মার্চ ও তৎপরবর্তী কিছু ভয়াবহ ঘটনা আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশ পাওয়াতে পাক মিলিটারি প্রশাসন তার ক্লিনজিং অপারেশন এখন খুব সংহত উপায়ে গোপনে গোপনে করে যাচ্ছিল। তাদের আশা ছিল বর্ষার পরপর তারা তাদের কাজ শেষ করে ফেলতে পারবে।  কিন্তু ময়মনসিং জেলার পরিস্থিতি সেই সংকেত দিচ্ছে না। জেলার পূর্ব অংশের সঙ্গে রেল যোগাযোগটাই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। আর তারই দু দুটো ব্রীজ ধ্বংস! জায়গায় জায়গায় মিলিটারি ক্যাম্প ছড়িয়ে রয়েছে। তাদের জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার মুখে। কারণ সড়ক পথ এই জেলায় অধিকাংশ কাঁচা । বর্ষায় তা এখন প্রায় চলাচলের অযোগ্য। তার উপর নদীবহুলতাও একটা সমস্যা। অনেক নদীতে মোটর যান পারাপারের  মত ব্রীজ নাই। ফলে বাধ্যত জলপথ এবং স্থানীয় রাজাকার, শান্তিবাহিনি ইত্যাদির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা নিয়ে। আপাত অশক্ত, দুর্বল স্বাস্থ্যের মানুষগুলো এত সাহস কোথা থেকে পায়—উস্কানির কথা বলা হলেও, শুধু ইন্ডিয়ার উস্কানিতে এতটা সাহসিকতা---বলা হয় ‘দেশপ্রেম’---সত্যি সত্যি এই ‘দেশপ্রেম’ শব্দটার কোন বাস্তবতা এখনও আছে কি না---এত হত্যা ধর্ষণের পরেও---থাকলে কীভাবে থাকতে পারে---কিঞ্চিৎ মস্তিষ্কওলা সামরিক অফিসারেরা ভেবে পাচ্ছেনা। ‘ব্লাডি বাঙালি’ উচ্চারণ করতে ঠিক আগের মত জোশ পাওয়া যাচ্ছেনা।ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে বিগত যুদ্ধের কথিত এত বীরত্বের গাঁথা কি শুধু নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে মারা আর নারীদের উপর বীভৎস অত্যাচারের মধ্যেই হারিয়ে গেল! মিলিটারি প্রশাসনের প্রয়োগ পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করার কোন ভাবনা চিন্তা উপর মহলে হচ্ছে কিনা কে জানে!

অপারেশনের অফিসাররা এখন নিজেদের রক্ষা করার জন্য স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে ব্যস্ত। সড়ক পথে ময়মনসিং টু মোহনগঞ্জ  যোগাযোগ স্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। শহরের মহল্লা থেকে গ্রাম সর্বত্র শান্তি বাহিনিকে তাদের সহযোগীদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খুব বেশি প্রয়োজন হলে মিলিটারি কল করতে বলা হয়েছে। নদ নদী জল জঙ্গলের দেশে গেরিলার প্রথম টার্গেট হওয়ার দুর্ভাগ্য তারা এড়াতে চাইছে। কিন্তু কার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে---গত ক’মাস ধরে যা যা হয়েছে তাতেতো সব টার্গেট প্রায় শেষ। ঝাঁপিয়ে  পড়তে হলে নিজের ভাই বেরাদরের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। তবু চেষ্টার ত্রুটি রাখা চলবে না। ঘরে ঘরে গেরিলা খোঁজ, আওয়ামী খোঁজ, কাফের মালাউন খোঁজ, প্রয়োজনে শিশ্ন চেক করো।

মেয়েছেলেদের হিন্দু মুসলমান নেই। ঐসব ঘরের আউরত হলেই নির্দেশিকা মোতাবেক কাজ। তবে ঢাকা সহ বড় বড় শহরগুলিতে মিলিটারি আগের মতই সক্রিয় থাকছে। মাথা গরম কোন অফিসারের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ‘মাদারচোদ’---বর্ডারে বসে বসে বর্ডার গার্ডরা কী করছে-- দুষ্মন ইন্ডিয়ান ফৌজীরা ট্রেনিং দিয়ে দিয়ে গেরিলাদের দেশের মধ্যে ঢুকিয়ে  দিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে নাকি তারাও কিছু কিছু থাকছে। হাড্ডিসার বাঙালির চেহারা মনে হলেই মাথা আরও গরম হয়ে যাচ্ছে। যদিও উপর মহল থেকে বলা হয়েছে ‘মানুষ চাই না—মাটি চাই’। প্রয়োজনে সব শেষ করে দাও। মানুষ আমরা পয়দা করে নেব। একদম খাঁটি মুসলমান ।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য