বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ২৪-২৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০১ ১৬:৫৬:১৯

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২৪
তেরেজা তার সাথে প্রায় পঞ্চাশটি প্রিন্ট সুইজারল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল, যার প্রত্যেকটি তার সর্বোচ্চ দক্ষতার সাথে নিজ হাতে সযত্নে ডেভেলপ করা - সেগুলো সুইজারল্যান্ডের একটি বহুল প্রচারিত ছবির ম্যাগাজিনে প্রকাশ করার জন্য তাদের প্রস্তাব করেছিল সে।পত্রিকাটির সম্পাদক তাকে সাদরে স্বাগত জানান ( সব চেকরা তখনও  দুর্ভাগ্যের জ্যোতির্বলয় তাদের সাথে নিয়ে ঘুরছে , এবং দয়ালু সুইসদের যা সহজে স্পর্শ করেছিল);  তিনি তেরেজাকে বসতে বলেন, তার ছবির প্রিন্টগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখেন, প্রশংসা করেন এবং তিনি ব্যাখ্যা করেন, সেই ঘটনার পর  নির্দিষ্ট বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে গেছে, আপাতত এই ছবিগুলো তাই তার পত্রিকায় প্রকাশের সামান্যতম সম্ভাবনাও নেই (তার মানে এই না যে ছবিগুলো সুন্দর নয়)।

তেরেজা প্রতিবাদ করে বলেছিল, ‘কিন্তু প্রাহাতে তো তা শেষ হয়ে যায়নি’। তার অস্পষ্ট জার্মান ভাষায়, সে তাকে ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করে, যদিও এই মুহূর্তে যখন তার দেশ দখলীকৃত, যা ঘটছে তা সবকিছু তাদের বিরুদ্ধে, রুশদের এই মুহূর্তে দেশ ছেড়ে চলে দাবার দাবীতে ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের কাউন্সিল তৈরি হচ্ছে, ছাত্ররা ধর্মঘট করছে, তার সমস্ত দেশ সশব্দে একই কথা বলছে যা তারা চিন্তা করছে।

‘সবচেয়ে অবিশ্বাস্য ব্যাপার হচ্ছে ! এখানে আর কারো তাতে কিছু যায় আসে না’।

সম্পাদক স্পষ্টতই স্বস্তিবোধ করে যখন তার পত্রিকার একজন মহিলা ফটোগ্রাফার  তার অফিসে এসে ঢোকেন এবং এই কথোপকথনটিতে বাধা পড়ে। মহিলাটি সম্পাদকের হাতে একটা ফোল্ডার এগিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এই যে নুডিষ্ট বীচ নিয়ে আর্টিকেলটা এখানে আছে’।

সম্পাদক যথেষ্ট সংবেদনশীল একজন মানুষ খানিকটা ভীত হবার জন্য যে, একজন চেক, যে কিনা ট্যাঙ্কের ছবি তুলেছে , তার কাছে বীচে নগ্ন নরনারীদের ফটোগ্রাফ অনেক হালকা মনে হবে। টেবিলের এক প্রান্তে সে সযত্নে ফোল্ডারটি সরিয়ে রাখে এবং দ্রুত মহিলাটিকে বলেন, ‘একজন চেক সহকর্মীর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেই. আমাদের জন্য উনি বেশ কিছু অসাধারণ আর চমৎকার ছবি তুলে এনেছেন’।

মহিলা এরপর তেরেজা সাথে করমর্দন করেন, তারপর তার ফটোগ্রাফগুলো হাতে নিয়ে দেখতে শুরু করেন,  তিনি তেরেজাকে বলেন, ’আমার ঐ ছবিগুলো একবার দেখতে পারো’। তেরেজা ঝুঁকে পড়ে ফোল্ডারটি হাতে নেয় এবং ছবিগুলো বের করে। প্রায় ক্ষমা চাইবার ভঙ্গিতে সম্পাদক তেরেজাকে বলেন, অবশ্যই ছবিগুলো তোমার ছবি থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।

তেরেজা বলে, ‘মোটেও না,  সবই  একরকম’।

সম্পাদক এবং মহিলা ফটোগ্রাফার তারা দুজনেই কেউই তাকে বুঝতে পারেনা। এমন কি আমারও কষ্ট হচ্ছে ব্যাখ্যা করতে,তেরেজার মনে তখন আসলে কি ছিল, যখন সে একটা নগ্ন সমুদ্র সৈকতের সাথে রুশ আগ্রাসনকে তুলনা করেছিল। ছবিগুলো দেখতে দেখতেই তেরেজা একটা ছবিতে খানিকটা বেশী সময় নীল, ছবিটা চারজনের একটা পরিবারের, সবাই বৃত্তাকারে দাড়িয়ে আছে: একজন নগ্ন মা তার সন্তানদের উপর ঝুঁকে আছে, তার বিশাল স্তনটি নীচের দিকে ঝুলছে ছাগল বা গরুর স্তনের মত। বাবাও অন্যদিকে একই রকমভাবে ঝুঁকে আছে, তার শীশ্ম এবং অণ্ডকোষ দেখতেও ক্ষুদ্রাকৃতির গরু বা ছাগলের স্তনের মতই মনে হচ্ছে।

সম্পাদক তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তোমার ভালো লাগেনি ,তাইনা’?

‘খু্ব ভালো ফটোগ্রাফ এগুলো’ তেরেজা বলে।

মহিলাটি বলেন, ‘আমার মনে হয় বিষয়বস্তু দেখে সে শকড হয়ে গেছে, আমি তোমার দিকে তাকিয়ে বলতে পারি তুমি কখনোই ন্যুড বীচে পা রাখোনি’।

তেরেজাও বলে, ’না’।

সম্পাদক হেসে বললেন, ‘তুমি দেখেছো , কত সহজ অনুমান করা তুমি কোথা থেকে এসেছো? কমিউনিস্ট দেশগুলো ভয়ঙ্কর গোড়া’।

খানিকটা  মাতৃসুলভ স্নেহ নিয়ে মহিলা ফটোগ্রাফারটি তেরেজাকে বলে, ’নগ্ন শরীরের কোনো সমস্যা নেই, এটা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার আর সবকিছু যা স্বাভাবিক, তা সুন্দর’।

তেরেজার হঠাৎ মনে পড়ে যায়, তাদের ফ্ল্যাটের মধ্য দিয়ে তার মায়ের নগ্ন হাঁটাহাঁটি করার দৃশ্যটি;  যেন তখনও সে তার পিছনে তার মায়ের হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছিল, যখন সে দৌড়ে বাসার সব পর্দা টেনে দিচ্ছিল যেন তার মায়ের নগ্নতা রাস্তা থেকে কেউ দেখতে না পায়।

২৫
মহিলা ফটোগ্রাফারটি তেরেজাকে ক্যাফেটেরিয়ায় কফির খাওয়ার জন্য নিমন্ত্রণ করে। ‘ঐ ছবিগুলো তোমার, খুব চমৎকার, আমি লক্ষ্য না করে পারলাম যে, নারী দেহের ছবি তোলার ব্যাপারে তোমার অসাধারণ শিল্পবোধ আছে। তুমি জানো আমি কি বলতে চাইছি, এই যে প্রলুব্ধ করার ভঙ্গিমায় তরুণীরা’।

‘যে ছবিতে তারা পথচারীদের চুমু খাচ্ছে তারা রুশ ট্যাঙ্কের সামনে দাড়িয়ে?

‘হ্যাঁ, তুমি খুবই ভালো ফ্যাশন ফটোগ্রাফার হতে পারবে, তুমি কি জানো সেটা’? প্রথমে তোমার একজন মডেল জোগাড় করতে হবে, তোমার মত একজন যে একটা ভালো সুযোগ খুঁজছে; তারপর তুমি তোমার তোলা ফটোগ্রাফের একটা পোর্টফলিও তৈরি করবে এবং বিভিন্ন এজেন্সিতে দেখাবে। তোমার নাম হতে খানিকটা সময় লাগবে স্বাভাবিকভাবেই; এর মধ্যে আমি তোমার জন্য যেটা এখনই এখানে করতে পারি সেটা হলো, বাগান সেকশনের সম্পাদনার দায়িত্বে যিনি আছেন তার সাথে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি। তার কিছু ক্যাকটাস আর গোলাপ ইত্যাদির ছবি তোলা লাগবে’।

তেরেজা তাকে আন্তরিকভাবেই ধন্যবাদ জানায়, কারণ স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে তার বিপরীতে বসা মহিলাটি আসলেই তার সদিচ্ছা থেকে কথাগুলো তাকে বলছে। কিন্তু তখনই সে নিজেকে আপনমনে বলে, কেন ক্যাকটাসের ছবি তুলতে হবে? প্রাহাতে সে যেভাবে তার ক্যারিয়ার তৈরি করেছিল, সেই প্রক্রিয়া জুরিখে পুনরাবৃত্তি করার মত কোন ইচ্ছাই তার ছিল না: সেই কাজ, আর ক্যারিয়ার নিয়ে সংগ্রাম, প্রতিটা ছবি প্রকাশ করা নিয়ে যুদ্ধ। শুধুমাত্র অহঙ্কারের কারণে সে কখনো উচ্চাভিলাষী ছিল না। শুধুমাত্র একটি জিনিসই সে চেয়েছিল, তার মায়ের জগত থেকে পালাতে। এই বিষয়টি তার কাছে স্ফটিক স্বচ্ছ: ছবি তোলার ব্যাপারে যতই তার উৎসাহ থাকুক না কেন, খুব সহজেই সে এই একই ইচ্ছাটা অন্য যে কোন কাজের দিকে ফেরাতে পারতো। ফটোগ্রাফি তার জন্য শুধুমাত্র একটা ‘বড় কিছু’ পাবার চেষ্টা এবং টমাসে পাশে থেকে জীবনটা কাটানোর সুযোগ পাওয়া।

সে বলে, ‘আমার স্বামী একজন ডাক্তার, আমার ভরণপোষণ সে করতে পারবে, আমার ছবি তোলার কোনো দরকার নেই’।

মহিলা ফটোগ্রাফার উত্তর দেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এত সুন্দর কাজ করার পর কিভাবে তুমি এই পেশাটাকে ছাড়ার কথা ভাবছো’।

হ্যাঁ, আগ্রাসনের ছবি তোলা সম্পূর্ণ অন্য একটা ব্যাপার, সেটা সে টমাসের জন্য করেনি, নিজের তীব্র আবেগ   থেকেই করেছে। কিন্তু সেই আবেগটা ফটোগ্রাফির জন্য না, সে কাজটা করেছে তীব্র ঘৃণা থেকে। সেই ঘটনার আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না; আর এই ফটোগ্রাফগুলো যা সে তার তীব্র আবেগ দিয়ে সৃষ্টি করেছে, শুধু সেগুলো আর কেউ চায়না কারণ তাদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেছে। শুধু ক্যাকটাসের বছর জুড়ে আবেদন আছে, আর ক্যাকটাসের প্রতি তার কোন আগ্রহই নেই।

সে বলে,‘ সত্যি তুমি খু্ব দয়ালু, কিন্তু আমি বরং বাসায় থাকবো, কোনো কাজের দরকার নেই’।

মহিলা জিজ্ঞাস করে, ‘বাসায় বসে থাকলে কি তোমার জীবনের পূর্ণতা আসবে?’;

তেরেজা বলে, ‘ক্যাকটাসের ছবি তোলার চাইতে পূর্ণতো বটেই’।

মহিলা বলে, ‘এমনকি যদিও তুমি ক্যাকটাসের ছবি তুলছো, তারপরও তো সেটা তোমার নিজের জীবন, তুমি তোমার স্বামীর জন্য যদি জীবন কাটাও, তাহলে তোমার নিজের বলে কোন জীবন থাকবে না’।

হঠাৎ করেই তেরেজার খুব বিরক্ত লাগলো: ‘আমার স্বামীতো আমার জীবন, ক্যাকটাসরা না’।

মহিলা ফটোগ্রাফ খানিকটা নরম স্বরে বলে, ‘তার মানে তুমি নিজেকে সুখী বলে মনে করছো’ ?

তেরেজা তখনও বিরক্ত বলে, ‘অবশ্যই, আমি ‍সুখী’।

মহিলা বলে,‘ শুধুমাত্র এক ধরনের মহিলারা আছেন, যারা এই কথা বলে তারা খু্বই……’ ,এখানেই কথা শেষ করে সে।

তেরেজা তার বাক্যটা শেষ করে দেয়, ‘…… সীমাবদ্ধ, সেটাই তুমি বোঝাতে চাইছো, তাইনা’?

মহিলা আবার তার কথা নিয়ন্ত্রণে নেয়, ‘সীমাবদ্ধ না, সময়ের জন্য বেমানান’;

‘তুমি ঠিক বলেছো’, তেরেজা বিষণ্ণতার সাথে উত্তর দেয়,’ ঠিক  এ কথাটা আমার স্বামীও আমার সম্বন্ধে বলে’।
 [চলবে...]

আপনার মন্তব্য