প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস : বাঙালিমনীষার অতলস্পর্শী দলিল

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৩-০৭ ২১:২৪:৩১

 আপডেট: ২০১৬-০৩-০৮ ২২:৪৯:৩৪

প্রণবকান্তি দেব:

‘এতো বড় আকাশটাকে ভরলে জোছনায়/ওগো চাঁদ এ রাতে আজ তোমায় বুঝা দায়’ - ‘প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস’ গ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে উল্লিখিত চরণগুলোর শেষ তিনটি শব্দ মনে গেঁথে রইলো; ‘তোমায় বুঝা দায়’। আবুল মাল আবদুল মুহিত সম্মাননগ্রন্থ পাঠে বিস্ময়েরই শুধু ডালপালা মেলে, বাড়ে অনন্ত জিজ্ঞাসার স্বপ্নচাঁদর। একজন ব্যক্তির প্রজ্ঞার যে বহুমাত্রিক স্ফুরণ ঘটতে পারে এ গ্রন্থটি পাঠ না করলে বুঝা যাবে না। আমরা মনে করি, একজন বাঙালিমনীষার জীবন ও কর্মের অতলস্পর্শী এক দলিল এটি।

আবুল মাল মুহিত সম্পর্কে গ্রন্থের সম্পাদক যখন বলেন, ‘ধীমান মুহিত একাধারে পাঠক, লেখক, ভাবুক, বিশ্লেষক, গবেষক, আর্থনীতিক ও রাজনীতিক। বাঙালি চেতনা, ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ তাঁর জীবনভর সাধনার প্রধানতম অনুসঙ্গ। তাঁর বহুদর্শী চিন্তাস্তর ও নবসৃষ্টির প্রেরণা আমাদের আর্থসামাজিক জীবনকে সৃজনরসে উজ্জীবিত করে’, তখন একজন পাঠক অবলীলায় অন্তর্দৃষ্টিতে অবলোকন করে নিতে পারেন মুহিতমানসের বর্ণিল পটচিত্র।

গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান। অর্ধশতাধিক বছরের চেনাজানা মানুষ সম্পর্কে আনিসুজ্জামান আবুল মাল আবদুল মুহিতকে একজন নির্ভরশীল বন্ধু হিসেবে আখ্যায়িত করেন। সাতশ বায়ান্ন পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটি বিন্যস্ত হয়েছে বিভিন্ন উপশিরোনামে।

যেমন, ‘মুগ্ধতার বয়ান ও স্মৃতিপাঠ’। এতে মুহিতজীবনের আলোকময় ব্যক্তিগত দিক থেকে শুরু করে উঠে এসেছে তাঁর সহপাঠী, সহকর্মী ও সমকালীন লেখকদের মুহিত-পর্যালোচনা।

এ অধ্যায়ে লিখেছেন রফিকুল ইসলাম, ছদরুদ্দিন আহমদ চৌধুরী, ফারুক চৌধুরী, মো. আবদুল আজিজ, নুরুল ইসলাম, বিজিতকুমার দে, কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, শামসুজ্জামান খান, রামেন্দু মজুমদার, স্বদেশ রায়, মনিরুজ্জামান, মো. সালেহ উদ্দিন, মুনতাসীর মামুন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, সেলিনা হোসেন, সেলু বাসিত, অপূর্ব শর্মাসহ অনেকেই।

তাঁদের লেখনীতে উঠে এসেছে একজন সজ্জন মুহিতের বহুমাত্রিক জীবনের উজ্জ্বল গল্পগুলো। গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম ‘বয়ন-অন্তর্বয়ন ও দৃষ্টিপাত’। এ অধ্যায়ে মূলত আলোকপাত করা হয়েছে মননশীল লেখক মুহিতের গ্রন্থপরিচয় ও এর ওপর বিচার-বিশ্লেষণ।

আবুল মাল মুহিতের রচনাবলি, তাঁর চিন্তার গভীরতা, তাঁর স্বপ্ন-আকাঙ্খার পর্যালোচনা সর্বোপরি বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে মুহিতসত্তার যোগসূত্র লেখকদের বিশ্লেষণাত্মক বর্ণনায় উঠে এসেছে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক এ অধ্যায় থেকে খুঁজে নিতে পারেন একজন স্বাপ্নিক মানুষের বহুবিচিত্র জীবনের নানা খুঁটিনাটি। পেতে পারেন গ্রন্থপাঠের বিচিত্র আস্বাদ।

এ অধ্যায়ের লেখকদের মধ্যে উল্লেখ্য সালেহ মাহমুদ রিয়াদ, রসময় মোহান্ত, নন্দলাল শর্মা, মিহিরকান্তি চৌধুরী, নজমুল হক, তাপসী চক্রবর্তী, আসমা-উল-হোসনা, দীপঙ্কর মোহান্ত, মোহাম্মদ আবদুল হামিদ, শংকর চৌধুরী, হোসনে আরা কামালী, রজত কান্তি ভট্টাচার্য্য, জয়ারাণী আইন, প্রণবকান্তি দেব, আবুল ফতেহ ফাত্তাহ প্রমুখের লেখায় মুহিতরচনার বৈশিষ্ট্য, তাঁর গদ্যরীতি,  ভাষা-আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিশ্লেষণ, রাজনৈতিক ও সামাজিক বিষয়ের প্রতি লেখকের দৃষ্টিভঙ্গি প্রভৃতি বিষয় উঠে এসেছে।

এ গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে কবিতার পঙ্তিমালা; ‘আলোকের পারাবত’। দিলওয়ার, নির্মলেন্দু গুণ, নৃপেন্দ্রলাল দাশ, এ. কে. শেরাম, মাশুক ইবনে আনিস, শামস নূর, মোহাম্মদ হোসাইন, পুলিন রায়, আবিদ ফায়সাল প্রমুখ কবি মুহিতকে তুলে ধরেছেন কবিতার উপমা-রূপক-উৎপ্রেক্ষায়।  

গ্রন্থের চতুর্থ অধ্যায় বিন্যস্ত হয়েছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের সাক্ষাৎবচন ‘জীবনের গান, প্রাণের ফোয়ারা’ অভিধায়। এ অধ্যায়ে বিভিন্ন সময়ে মুহিত-প্রদত্ত চারটি সাক্ষাৎকার স্থান পায়। প্রথম আলো, কালেরকণ্ঠ, অভিমত এবং দেশটিভিতে প্রচারিত সাক্ষাৎকারগুলোয় মুহিতজীবনের অজানা তথ্য উঠে এসেছে। আবুল মাল আবদুল মুহিত বাংলাদেশ প্রেক্ষাপটে একজন প্রাজ্ঞ ব্যক্তিত্ব। তাঁর জীবনভর সাধনার অন্বিষ্ট হচ্ছে আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ, রাজনৈতিক-সংস্কৃতির উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন।



একজন মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে তাঁর দূরদৃষ্টি ও লেখনী আমাদের সমাজকে আলোকিত করছে। গ্রন্থপাঠ ও সমাজ-অধ্যয়ন তাঁর জীবনের মহত্তম স্বপ্ন। সে স্বপ্ন-বাস্তবায়নে এখনও তিনি নিরন্তর কাজ করতে অভ্যস্ত। সঙ্গত কারণে এ অধ্যায়কে `Revisit of History’ বলা যেতে পারে।

গ্রন্থের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে রয়েছে মুহিতের নির্বাচিত কিছু সময়োপোযোগী রচনা, সন্নিবেশিত হয়েছে তাঁর বর্ণাঢ্য জীবন ও রচনাপঞ্জি। একই পটে সংযোজিত হয়েছে তাঁর কর্মময় জীবনের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র। সব মিলিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে চেনা-অচেনা সকল পরিধিতেই অধ্যয়নের এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টার নাম ‘প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস’ গ্রন্থ।

এ গ্রন্থটির সংকলন সম্পর্কে সম্পাদক নিজেই বলেছেন, ‘আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো চেতনাসঞ্চারী মানুষের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের সেতুবন্ধন সৃষ্টির মাধ্যম হিসেবে’ এ গ্রন্থসংকলনের পরিকল্পনা। প্রতীয়মান হয় সম্পাদকের এ কথাটিই উজ্জ্বল তাঁরার মতো সত্য। কেননা গ্রন্থই পারে অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে যোগসূত্র রচনা করে দিতে।

গ্রন্থটির সংকলক ও সম্পাদক আবুল ফতেহ ফাত্তাহ তাঁর নিষ্ঠা ও অন্তরের আবেগ, ভালোবাসা আর মমত্ববোধ দিয়ে বাঙালি নবজাগরণের উত্তরসাধক আবুল মাল আবদুল মুহিতকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার যে মহৎ কর্ম সাধন করেছেন এজন্য তাঁকে অভিনন্দন জানাই। আবুল মাল আবদুল মুহিতের জীবন, দর্শন ও ভাবনার অনুশীলনের মাধ্যমে বর্তমান প্রজন্ম এক প্রাগ্রসর জীবনের স্বপ্ন দেখার প্রয়াস পাবে। সে লক্ষ্যে ‘প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস’ গ্রন্থটি হতে পারে তাঁর পথ দেখানো আলোকসম্পাতের মতই উজ্জ্বল। চিন্তার বর্ণিল শিখার মতো বইয়ের প্রতিটি পাতা পথ দেখাতে পারে, পথ রচনা করতে পারে আগামীর ভবিষ্যৎ।

‘প্রত্মপাঠ’ প্রকাশন গ্রন্থটি প্রকাশ করে নিজেরাই হয়ে গেল ইতিহাসের গৌরবময় একটি পাঠ। শিল্পী তানিম বিন ইমদাদের মনোরম প্রচ্ছদ সহজেই পাঠকের দৃষ্টি কাড়বে। হয়তো অপ্রসাঙ্গিক হবে না ধরণিকন্যা শেখ হাসিনা মদনমোহন কলেজের প্লাটিনাম জুবিলি উৎসবে প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করে এ গ্রন্থের আরও বেশি মহিমা দান করেছেন।

পরিশেষে বলি, বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ-সাহিত্য ও প্রগতির ইতিহাসে আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রাজ্ঞজন, এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। সে-অর্থে আলোচ্য গ্রন্থ অতীত, বর্তমান ও আগামীকালের সমাজপরিপ্রেক্ষিত ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির অমূল্য ইতিহাস। আমরা সেই চিন্তক ও বিস্ময়কর জীবনবোধের নায়ক আবুল মাল আবদুল মুহিতের জীবন ও কর্মের আলোকময় সংলাপ প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস গ্রন্থপাঠে অনুধাবন করি। তাঁর সৃষ্টিকর্মের উজ্জ্বল আলো সকল পাঠকের মানসলোকে সোনালি উষার দীপ্তি ছড়াক।

প্রজ্ঞাদীপ মুহিতমানস/ সংকলন-সম্পাদন আবুল ফতেহ ফাত্তাহ/ প্রকাশক প্রত্মপাঠ/ ওয়েস্টউইং, রাজা ম্যানশন (দোতলা)/ জিন্দাবাজার, সিলেট/ প্রকাশকাল ২০১৫

আপনার মন্তব্য