দিলওয়ার: যে কবি গণমানুষের

গণমানুষের কবি দিলওয়ারের ৭৯তম জন্মতারিখে শ্রদ্ধা

 প্রকাশিত: ২০১৫-০১-০১ ২১:৪৬:৪১

 আপডেট: ২০১৫-০১-০১ ২১:৫১:৪৬

কবির য়াহমদ:



সক্রেটিসবারবার আমি শুনতে চাই/ 

তোমার কালজয়ী মানবীয় উচ্চারণ-/ 

আমি শুধু একজন এথেনসবাসী কিংবা গ্রীক নই/ 

আমি হচ্ছি বিশ্বনাগরিক।

 



পৃথিবীর সক্রেটিসের জন্যে কবিতায় কবি নাগরিকতার সংজ্ঞা নিরূপণ করে গেছেন এভাবে। এই সংজ্ঞায়নের কালে সক্রেটিস আছেন বিমুর্ত অথচ সবচেয়ে উজ্জল এক এক অংশ হয়ে আছে স্বয়ং কবিকবি দিলওয়ার! দেশ কাল আর ভৌগলিক সীমা ভেদ করে একজন কবি নিজেকে এভাবেই প্রকাশ করতে জানেন। তাই কালে বসে মহাকালের পঙক্তি লেখাই শুধু কবিদের কাজ হয়ে থাকে না এর বাইরে কবিতার মত কবির নিজস্বতা প্রকাশের একটা পরিষ্কার ইশতেহার প্রকাশের দায় এসে যায়। কবি এখানে নিজেকে প্রকাশ করে গেছেন অবলীলায়নিঃসন্দেহে।


 


কবি দিলওয়ার। পঞ্চাশ দশকের উজ্জল এক কাব্যপ্রতিভা। শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরির মত কাব্যপ্রতিভার সময়কাল থেকেই তাঁর কাব্যের স্ফুরণ। তিনি নাগরিক কবি ছিলেন না কিন্তু ছিলেন গণমানুষের কবি। তাঁর কাব্য সাধারণ মানুষের আবেগকে ছুঁয়ে ছিল আগাগোড়াই। গাঁয়ের মানুষের শরীরের গন্ধের সাথে তাঁর কবিতা সমানতালে হেঁটে যেত। ফলে খুব সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন কাব্যভালোবাসার অনন্য এক নাম। 



 

কবিছড়াকারসাংবাদিকসাহিত্যিকনাট্যকারগীতিকার সব পরিচয় ছাপিয়ে ছিলেন আপাদপমস্তক এক কবি। তাঁর কবিতার রাজ্য অন্য সব কবিদের মত নিজস্ব চিন্তা চেতনা দিয়েই সমৃদ্ধ ছিলসেই স্বাভাবিক। ব্যক্তি জীবন এবং কাব্য জীবন মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল আজন্মই। ছিলো নাড়ীর টানতাই এক সময়ের পেশাগত জীবনের স্থানিক অবস্থা পেরিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন শেকড়ের কাছেনিজের বসতবাড়িতে এবং সেখানেই ছেড়েছেন শেষ নিঃশ্বাস। জীবদ্দশায় যেমন কাব্য আর কবিতার সাথে ছিল নিত্য বাস ঠিক তেমনিভাবে বাড়ির চৌহদ্দিতেও ছিল সে ছোঁয়া। খান মঞ্জিলের প্রতিটি ধূলিকণার সাথে মিশে ছিল কবি আর তাঁর কবিতার স্বাক্ষর। কবিতার কবি সাজিয়েছেন এভাবে নিজের ব্যক্তিগত জীবনও তাই কবি-র জন্মভূমি কেমন হওয়া উচিত ছিলোসে সম্পর্কে কবি বলছেন-কবি-র রাজ্যে রাজা-বাদশা-র কিংবা রাজ্যসাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের বুকফাটা হাহাকার অথবা উল্লাসের অট্টহাস্য নেই ৷ এই রাজ্যে রয়েছে এক অখন্ড- জীবনবোধযার প্রেম-প্রীতিসুখ-দুঃখহাসি-কান্না দক্ষিণমেরু থেকে উত্তরমেরু অবধি বিস্মৃত! কালের শুভেচ্ছায় কবি ও কবিতার জগত্‍ চিরসবুজঅবিনাশী যৌবনের প্রতীক! (এককথা, দিলওয়ার১ জানুয়ারী ২০০৫)



 

সিলেট-ঢাকা-সিলেট। তাঁর কবি সময়কালে সে সময়ে মফস্বলে থেকে নামডাক করা রীতিমত কঠিনই এক কাজ ছিল। কিন্তু তিনি তা করে গেছেন সফলতার সাথে। সিলেটের মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে সিলেটে বসে ছড়িয়েছেন তাঁর কাব্যদ্যুতি। একটা মফস্বল শহরে বসে লিখেন তিনি পৃথিবী স্বদেশ যার আমি তার সঙ্গী চিরদিন এরকম অমর কোন লাইন। তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে কলকল রবে বয়ে যাওয়া সুরমা আর ইতিহাসের সাক্ষী কীনব্রিজ। এই কীনব্রিজ কবিকে আন্দোলিত করেছে। ফলে তিনি কীনব্রিজে সূর্যোদয় কবিতায় লিখেন- নীচে জল কলকল বেগবতী নদী সুরমার/ কানপেতে শুনি সেই অপরূপ তটিনীর ভাষা/ গতিবন্ত প্রাণ যার জীবনের সেই শ্রেয় আশা/ সৃষ্টির পলিতে সেই বীজ বোনে অক্ষয় প্রজ্ঞার



 

দীর্ঘ ষাট বছরের সাহিত্যজীবনে কবি দিলওয়ার শুধুমাত্র তাঁর কাব্যপ্রতিভা দিয়েই বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেননি। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি অসামান্য অবদান রেখেছিলেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পগোষ্ঠীর সিলেট শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন তিনি। ছিলেন সিলেট কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারের বাস্তবায়ন কমিটির মুখ্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকের মতিয়া চৌধুরীকে নিবেদিত একটি কবিতায় তিনি তাঁকে অগ্নিকন্যা আখ্যা দিয়েছিলেন। এবং এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এই নামেই অদ্য সমধিক সুবিদিত। ভাষা আন্দোলন নিয়ে লিখেছিলেন- আয়রে চাষী মজুর কুলি মেথর কুমার কামার/বাংলা ভাষা ডাক দিয়েছে বাংলা তোমার-আমার।  দেশ আর স্বাধীনতাকে মনেপ্রাণে ধারণ করতেন বলে নাগরিকদের উদ্দেশে যতদিন বেঁচে আছো কবিতায় লিখেন- যতদিন বেঁচে আছো ততোদিন মুক্ত হয়ে বাঁচো/ আকাশ মাটির কণ্ঠে শুনি যেন তুমি বেঁচে আছো 



 

আগাগোড়া দেশপ্রেমিক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষের কবি সাম্প্রতিক সময়ের তুমুল সাড়া জাগানো গণজাগরণ মঞ্চের সমর্থক ছিলেন। বয়সের চাপ ও ছাপ তাঁকে ঘরের চার সীমানার মধ্যে আটকে রেখেছিলো কিন্তু সময়ে সময়ে তিনি তাঁর লেখনিতে উচ্চারণ করেছেন রাজাকারদের বিচারের দাবিতে তাঁর অভিমত শাহবাগ চত্বরকে তিনি দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সাথে তুলনাকে সমর্থন জানিয়েছেন অকপটে। এ সম্পর্কিত দুইটি লেখার একটিতে তিনি শাহবাগ চত্বরকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের লাল সংকেত এবং অন্য একটি লেখায় তিনি সবুজ সংকেত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শাহবাগ চত্বরদ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের লাল সংকেত লেখায় তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেন- মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রাপ্ত বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ পেয়েছিলো। সেখান থেকে একচুলও নড়ার অবকাশ নেই। এই সত্যকে যে বা যারা ছাই চাপা দিতে চাইবেতাদেরকে অবশ্যই মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে (দৈনিক যুগভেরী১৯-০২-২০১৩)



 

কবিতার কবি দিলওয়ারের পুরো নাম দিলওয়ার খান। আটপৌরে জীবন বিধানের পারিবারিক ত্বকমা তিনি ছেঁটে ফেলে দিয়ে নিজেকে পরিচিত করেছিলেন শুধুমাত্র দিলওয়ার নামেই। কারণ তিনি মনে করতেন যে নামে তাঁকে পরিবার আর স্বজন জানে সেটাই তাঁর প্রকৃত পরিচয় আর পরিচিতি। জন্মেছিলেন ১৯৩৭ সালের ১লা জানুয়ারী সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার ভার্থখলা গ্রামে পিতা মৌলভী মোহাম্মদ হাসান খান এবং মাতা রহিমুন্নেসা ছিলেন চার ভাই ও চার বোনের মধ্যে সপ্তম

 



 

সিলেটের দক্ষিণ সুরমা হাইস্কুলের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও মাত্র দুমাস পর তিনি শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেন  নিজেকে জড়িয়ে নেন সাংবাদিকতায়৷ ১৯৬৭ সালে দৈনিক সংবাদের সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগদান করেন ১৯৬৯ সালে এই দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তিনি সিলেটে ফিরে আসেন ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে সিলেটের কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকদের নিয়ে গঠন করেন সমস্বর লেখক ও শিল্পী সংস্থা এবং উনসত্তরের গণআন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সমস্বরকে স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে কাজে লাগান ১৯৭৩-৭৪ সালে অধুনালুপ্ত দৈনিক গণকন্ঠের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৭৪ সালে তিনি ঢাকাস্থ রুশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত মাসিক উদয়ন পত্রিকার সিনিয়র অনুবাদক হিসেবে প্রায় দুই মাসের মতো কাজ করেন ১৯৬০ সালে এই কবির একটি গান দিয়ে সিলেট রেডিও স্টেশনের উদ্বোধন করা হয় ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ গ্রামোফোন কোম্পানি লিমিটেড কবি চারটি গান দিয়ে একটি ডিস্ক বাজারে ছাড়ে গানগুলো হলো- মুর্শিদ আমি খুঁজবো না গোতুমি রহমতের নদীয়ামন আমার কেমন করেও নদীর ঘাটে জল আনিতে গিয়া



 

গণমানুষের কবি দিলওয়ারের মুল লেখালেখির ক্ষেত্র ছিল সাহিত্য। তাঁর লিখিত সবগুলো লেখা গ্রন্থভুক্ত হয়নি। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমুহ হচ্ছে- জিজ্ঞাসা (কাব্যগ্রন্থ১৯৫৩)ঐক্যতান (কাব্যগ্রন্থ১৯৬৪)পুবাল হাওয়া (গানের বই১৯৬৫)উদ্ভিন্ন উল্লাস (কাব্যগ্রন্থ১৯৬৯)বাংলা তোমার আমার (গানের বই১৯৭২)ফেসিং দি মিউজিক (ইংরেজি কাব্যগ্রন্থ১৯৭৫)স্বনিষ্ঠ সনেট (কাব্যগ্রন্থ১৯৭৭)রক্তে আমর অনাদি অস্থি (কাব্যগ্রন্থ১৯৮১)বাংলাদেশ জন্ম না নিলে (প্রবন্ধগ্রন্থ১৯৮৫)নির্বাচিত কবিতা (কাব্যগ্রন্থ১৯৮৭)দিলওয়ারের শত ছড়া (ছড়ার বই১৯৮৯)দিলওয়ারের একুশের কবিতা (কাব্যগ্রন্থ১৯৯৩)দিলওয়ারের স্বাধীনতার কবিতা (কাব্যগ্রন্থ১৯৯৩)ছাড়ায় অ আ ক খ (ছড়ার বই১৯৯৪)দিলওয়ারের রচনাসমগ্র ১ম খ- (১৯৯৯)দিলওয়ার-এর রচনা সমগ্র ২য় খ- (২০০০)ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর ডাকে (ভ্রমণ২০০১) 



 

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কবিতার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমী ১৯৮০ সালে কবি দিলওয়ারকে সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত করে এবং পরে ১৯৮১ সালে ফেলোশিপ প্রদান করে৷ এছাড়াও লাভ করেন ময়মনসিংহ সাহিত্য সংসদ কর্তৃক ১৯৮৬ সালের আবুল মনসুর সাহিত্য পুরস্কার১৯৯১ সালে দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক ও সম্মাননারাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার লাভসুকান্ত সাহিত্য পুরস্কার এবং অন্যান্য বেশ কয়েকটি পদক ও পুরস্কার। ২০০১ সালে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ সংবর্ধনা প্রদান করে।



 

সিলেটে বাস করা কবি দিলওয়ারের অনেকেই প্রশ্ন করতো কেন তিনি মফস্বলে পড়ে আছেনঅকালপ্রয়াত কবিপুত্র কিশওয়ার ইবনে দিলওয়ার একবার কবিকে প্রশ্ন করেছিলেন- আপনি এভাবে মফস্বলে পড়ে আছেন কেনমফস্বলে থাকলে তো মূল্যায়ন পাবেন না। উত্তরে কবি বলেছিলেন- যদি লিখতে পারি কবিতাই আমাকে স্বীকৃতি দেবে। গ্রামে বসেমফস্বলে বসে আমি গণমানসিকতার কবিতা উপস্থাপন করতে পারব। আমার স্বীকৃতি হবে গণমানুষের স্বীকৃতি হ্যাঁকবি গণমানুষেরই স্বীকৃতি আর ভালোবাসা পেয়েছেন।



 

১০ অক্টোবর ২০১৩ দিনটি বাংলা সাহিত্যের জন্যে একটা বিয়োগান্ত দিন। এই দিনে কবি দিলওয়ারের কলম থেমে গেছে সারা জীবনের জন্যে। তাঁর শরীর নিথর আর চোখ বুজার সাথে সাথেই বাংলা সাহিত্যের আকাশ থেকে খসে গেছে একটা নক্ষত্র জীবন প্রদীপ নিভে যাবার ক্ষণে যে অধ্যায়ের সমাপ্তি হলো সেই একই অধ্যায় হয়তো মূল্যায়ন কালেরকে জানে! তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পর মনে হলো এই সময়ে সিলেটে কোন কবি আর বেঁচে নেই! এই সময়ে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখ করার মত খুব বেশি কবি আর বেঁচে নেই!


 


চিরায়ত পথ ধরে যারা যায় আর যারা আসে


মুদ্রার দুপিঠ তারাপ্রেম নিয়ে মাটিতে আকাশে- দিলওয়ার।

 

 

 

আপনার মন্তব্য