জীয়ন্তে জীবনানন্দ: কাব্যমেধাময়ী মাতা কুসুমকুমারী

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-০৬ ১৭:৩৬:৪১

ফরিদ আহমেদ:

জীবনানন্দ দাশের চেয়ে তাঁর মা-কে বাঙালিরা বেশি পড়ে বা স্মরণ করে, এই কথা যদি কেউ বলে, তবে তাকে পাগল ঠাওরানোর সম্ভাবনাই বেশি। পাগল ঠাওরান আর যাই ঠাওরান, কথা কিন্তু সত্যি। কীভাবে? সেটাই বলছি।

জীবনানন্দের কবিতা কতো জন মানুষ পড়ে বা জানে বা প্রতিদিন স্মরণ করে? খুব বেশি না। অথচ, সামান্য শিক্ষিত থেকে শুরু করে মাঝারি শিক্ষিত কিংবা উচ্চ শিক্ষিত যে কোনো বাঙালিকেই 'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?/কথায় না বড় হ'য়ে কাজে বড় হবে।' এই দুটো লাইন কবিতা শোনান, তাদের প্রত্যেকেই দেখবেন এর সাথে পরিচিত। বাংলা সাহিত্যের এই সুবিখ্যাত লাইন দুটি যে কবিতার অংশ, সেই কবিতাটা কে লিখেছে, বলেন তো দেখি? জ্বী, পরিষ্কার ইঙ্গিত দিয়ে দিয়েছি আমি। এটা জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাসের লেখা একটা কবিতার অংশ।

কুসুমকুমারী দেবী বরিশালের মেয়ে। তাঁর বাবা চন্দ্রনাথ দাস বরিশালের কালেক্টরিতে কাজ করতেন। এই ভদ্রলোক কবিতা এবং হাসির গান লিখতেন। বাবার এই গুণ বংশগতভাবে মেয়ের মধ্যে চলে আসে। তিনিও ভালো কবিতা লেখা শুরু করেন।

কোলকাতার বেথুন স্কুলে পড়তেন তিনি। ফার্স্ট ক্লাসে পড়ার সময় (আমাদের এখনকার হিসাব অনুযায়ী ক্লাস টেন), জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যনানন্দ দাসের সাথে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর।ফলে, প্রবেশিকা পরীক্ষা আর দেওয়া হয় না তাঁর। এর বদলে সংসারধর্ম করা শুরু করেন তিনি অল্প বয়েস থেকেই। সেই যুগে অবশ্য এটাই স্বাভাবিক প্রথা ছিল।

জীবনানন্দ দাশের বাবা সত্যানন্দ দাসগুপ্ত ব্রাহ্ম সমাজের মানুষ ছিলেন। খুবই ধার্মিক ছিলেন তিনি। কুসুমকুমারী দেবীও ব্যতিক্রম ছিলেন না। এক সময় তিনি কিছুদিন বরিশালের ব্রাহ্ম সমাজে আচার্যের কাজও করেছেন। তাঁর কণ্ঠ ছিলো খুব সুমিষ্ট। নিয়মিত তিনি ধর্ম সংগীত, যেটাকে ব্রাহ্ম সংগীত বলে, সেটা গাইতেন।

কিন্তু, এগুলো না। তাঁর আসল প্রতিভা ছিলো কাব্য রচনায়। তিনি খুব ভালো কবিতা লিখতে পারতেন। ব্রহ্মবাদী পত্রিকায় নিয়মিত তাঁর লেখা কবিতা ছাপা হতো। তাঁর কোনো কোনো কবিতা আজও ছোট বাচ্চাদের পাঠ্য পুস্তকে দেখা যায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটির বিখ্যাত দুটো লাইনের কথা আগেই উল্লেখ করেছি। সেই কবিতাটার নাম ছিল 'আদর্শ ছেলে'। সম্পূর্ণ কবিতাটা আমাদের অনেকের কাছেই অজ্ঞাত, শুধু এই দুই লাইনই জানা আছে। আসুন দেখি পুরো কবিতাটা কেমনতর ছিল।

আদর্শ ছেলে
কুসুমকুমারী দাস

আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে?
কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে।
মুখে হাসি, বুকে বল, তেজে ভরা মন,
'মানুষ' হইতে হবে, - এই তার পণ।
বিপদ আসিলে কাছে, হও আগুয়ান,
নাই কি শরীরে তব রক্ত, মাংস, প্রাণ?
হাত, পা, সবারি আছে, মিছে কেন ভয়?
চেতনা রয়েছে যার, সে কি পড়ে রয়?
সে ছেলে কে চায় বল? - কথায় কথায়
আসে যার চোখে জল, মাথা ঘুরে যায়।
সাদা প্রাণে হাসি মুখে কর এই পণ -
মানুষ' হইতে হবে, মানুষ যখন।
কৃষকের শিশু কিংবা রাজার কুমার,
সবারি রয়েছে কাজ, এ বিশ্ব মাঝার,
হাতে প্রাণে, খাট সবে, শক্তি কর দান,
তোমরা 'মানুষ' হ'লে, দেশের কল্যাণ।

তিনি ভালো কবিতা লিখতেন। কিন্তু, এর জন্য ব্যাপক পরিশ্রম তাঁকে করতে হতো না। কবিতা লেখা ছিলো তাঁর সহজাত দক্ষতার অংশ। বিশাল একটা সংসারের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। এর মাঝখানে সময় বের করে কবিতা লেখা ছিল অনেক কঠিন একটা কাজ। কিন্তু, এর মাঝ দিয়েও তিনি অনেক কবিতা লিখেছেন। কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে কিংবা অনেক সময় কাজের মাঝখানে থেকেও তিনি অতি দ্রুত কবিতা লিখে ফেলেছেন। জীবনানন্দ দাশ তাঁর মায়ের কবিতা লেখা নিয়ে লিখেছেন:

"কি রকম তাড়াতাড়ি লিখতে পারতেন তিনি। রান্না করছেন, রান্না করছেন, পিসেমশায় আচার্য মনোমোহন চক্রবর্তী এসে বললেন - এক্ষুনি 'ব্রহ্মবাদী'র ফর্মা প্রেসে যাচ্ছে, অবিলম্বেই একটি কবিতা লিখে দাও কুসুম। ...অমনি মা খাতা-কলম নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে একহাতে খুন্তি আর একহাতে কলম নাড়ছেন দেখা যেত - যেন চিঠি লিখছেন, বড় একটা ঠেকছে না কোথাও! আচার্য চক্রবর্তীকে প্রায় তখুনি কবিতা দিয়ে দিতেন, পরে 'ব্রহ্মবাদী'র পৃষ্ঠায় তা প'ড়ে স্বভাব-কবিদের কথা মন এ পড়তো আমার। আমাদের দেশের লোক-কবিদের স্বভাবী সহজতাকে, ..মা'র কবিতায় আশ্চর্য প্রসাদগুণ ... মা যদি নিজের তখনকার জীবনের কবিতা লেখার বিশিষ্ট ঐতিহ্য অত তাড়াতাড়ি নিরস্ত না ক'রে ফেলতেন, তা হ'লে অনেক কিছুই হতে পারতো। যে সাহিত্যিক ও কবির গরিমা তাঁর প্রাপ্য ছিল, সেটাকে অন্তর্দমিত করে রাখলেন। তিনি প্রকাশ্যে কোনো পুরস্কার নিতেন না।"

শুধু কুসুমকুমারী দেবীই নন, বাংলার ঘরে ঘরে এমন অসংখ্য নারীই সংসারের ঘানি টানতে টানতে, হাড়ি ঠেলতে ঠেলতে, নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পারেন নি কখনো। সঠিক সুযোগ দিলে, যত্ন নিলে, আজকের বাংলা সাহিত্য যে পুরষশাসিত, একপেশে, পুরুষই সর্বত্র, সেটা হয়তো থাকতো না।

এই রকম একজন মহিয়ষী মায়ের গর্ভেই যে জীবনানন্দ দাশ জন্মাবে, কবিতায় রাশি রাশি পদ্মফুল ফোটাবে, এতে আর বিচিত্র কি আছে! তাই না?

আপনার মন্তব্য