বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব- ৭.২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-১৯ ০১:০০:১৫

কাজী মাহবুব হাসান:

ভুল বোঝা শব্দগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত অভিধান (শেষাংশ) - ৭.২

শক্তি
বহু হোটেলের কোনো একটির বিছানা শুয়ে যেখানে তারা সঙ্গম করেছিল, সাবিনা ফ্রান্জের বাহুতে টোকা দেয় বলে, ‘তোমার যা মাংসপেশি আছে, অবিশ্বাস্য’!

ফ্রান্জ সাবিনার প্রশংসায় তৃপ্তিবোধ করেছিল। বিছানা থেকে নেমে বসে পড়ে একটি ভারী ওক কাঠের চেয়ারের এক পা ধরে ধীরে ধীরে মাথার উপর উঠিয়ে সে বলে, ‘তোমার কখনো ভয় পাবার কারণ নেই, আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারবো যা কিছুই আসুক না কেন। আমি একসময় জুডো চ্যাম্পিয়ন ছিলাম’।  

যখন ভারী চেয়ারটা এক হাত দিয়ে ধরে সে মাথার উপর তোলে, সাবিনা বলে, ‘জেনে ভালো লাগলো যে, তুমি অনেক শক্তিশালী’।

কিন্তু মনে মনে নিজেকে সে বলেছিল, ফ্রান্জ শক্তিশালী হতে পারে ঠিকই, কিন্তু তার শক্তিটি নির্দেশিত বাইরের দিকে । যখন সেই মানুষগুলোর প্রসঙ্গ আসে, যাদের সাথে সে থাকে, যে মানুষগুলোকে সে ভালোবাসে, সেখানে ফ্রান্জ খুবই দুর্বল। ফ্রান্জের এই দুর্বলতাকে বলা হয় ভালোত্ব। ফ্রান্জ সাবিনাকে কখনোই কোনো আদেশ দেয় না।কখনোই সে তাকে হুকুম করবে না, যেমন টমাস করতো, মেঝেতে আয়না বিছিয়ে এর উপর নগ্ন হয়ে সামনে পিছনে হাটতে বলতো, ফ্রান্জের সেই ইন্দ্রিয়পরায়ণতার কোনো অভাব নেই ঠিকই কিন্তু তার সেই শক্তি নেই নির্দেশ দেবার জন্য। কিছু জিনিস আছে যা শুধু করা সম্ভব প্রচণ্ডতা দ্বারা, শারীরিক ভালোবাসা প্রচণ্ডতা ছাড়া অকল্পনীয়।

 সাবিনা ফ্রান্জকে মাথার উপর চেয়ার হাতে নিয়ে সারা ঘরে হেটে বেড়াতে দেখে, দৃশ্যটি তার কাছে উদ্ভট মনে হয় এবং একটা অদ্ভুত দুঃখবোধ তাকে আচ্ছন্ন করে।

সাবিনার মুখোমুখি মাটিতে চেয়ারটা নামিয়ে রেখে সে চেয়ারটির উপরে বসে। ‘অবশ্যই, শক্তিশালী হওয়াটা আমি উপভোগ করি’, সে বলে,‘ কিন্তু জেনেভাতে এই মাংসপেশি আমার কি উপকারে আসবে? এগুলো অলঙ্কারের মত, ময়ূরের পেখম। কারো সাথে আমি জীবনে কখনো লড়াই করিনি’।

সাবিনা তার বিষণ্ণ ভাবনার আরো গভীরে প্রবেশ করে: কি হতো যদি তার সাথে এমন কোনো একজন পুরুষ থাকতো যে সবসময় তাকে হুকুম করতো? এমন কোনো পুরুষ যে তাকে বশ করতে চাইতো? কত দিন অবধি সে তার সাথে মানিয়ে চলতে পারতো? পাঁচ মিনিটও না! এখান থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়, আসলে কোনো পুরুষই তার জন্য সঠিক না। দুর্বল কিংবা সবল।

‘তুমি আমার উপর কেন কখনো তোমার শক্তি প্রয়োগ করোনি’, সাবিনা জানতে চেয়েছিল।

ফ্রান্জ ধীরে বলেছিল, ‘কারণ ভালোবাসা মানে শক্তিকে বর্জন করা’। সাবিনা দুটো বিষয় অনুধাবন করতে পেরেছিল, প্রথমত, ফ্রান্জের কথাটি মহৎ আর সঠিক; এবং দ্বিতীয়ত, আর এগুলোই ফ্রান্জকে তার ভালোবাসার জীবনে অযোগ্য করেছে।

সত্যে বসবাস
তার ডায়রি অথবা চিঠিগুলোর কোথায় কাফকা এমন একটি সূত্রের কথা উল্লেখ করেছিলেন, ফ্রান্জ মনে করতে পারে ঠিক কোথায়। কিন্তু এটি তার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ‘সত্যে বসবাস’ মানে আসলেই কি বোঝায়’? নেতিবাচকভাবে কথাটি ব্যাখ্যা করা খুব সহজ: এর মানে কখনো মিথ্যা না বলা, কোনো কিছু গোপন না করা, এবং কোনো কিছু নিয়ে ভান না করা। যখন থেকেই তার সাবিনার সাথে দেখা হয়েছে, তখন থেকেই ফ্রান্জ একটি মিথ্যার মধ্যে বসবাস করছে। সে তার স্ত্রীকে অস্তিত্ব নেই এমন সব সম্মেলন আর বক্তৃতার কথা বলে আমস্টারডামে কিংবা মাদ্রিদে। জেনেভার রাস্তায় সাবিনার সাথে একসাথে নিয়ে হাটতে সে ভয় পেতো। এবং এই মিথ্যা বলা আর গোপনীয়তা সে উপভোগও করতো,  কারণ এই সবকিছুই তার জন্য নতুন। স্কুল শিক্ষকের কোনো প্রিয় ছাত্রের মতই সে উত্তেজিত, সাহস করে স্কুল ফাকি দেবার মত আচরণ করে।

সাবিনার জন্য সত্যে বসবাস, আমাদের নিজেদের কাছে যেমন মিথ্যা না বলা, তেমনি অন্যদের কাছেও মিথ্যা না বলা, সম্ভব হতে পারে শুধুমাত্র সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে দূরে কোথাও: যে মুহূর্তে আমরা কি করছি তার উপর কেউ নজর রাখে, সেই চোখকে বিবেচনা করে আমরা কিছুই করিনা যা সত্যনিষ্ঠ হতে পারে। সবার সামনে, অন্যদের চিন্তা মনের মধ্যে রেখে চলাই মানে মিথ্যায় বসবাস। সাবিনা সেই সব সাহিত্যকর্ম খুবই ঘৃণা করে, যেখানে মানুষ তাদের ও তাদের বন্ধুদের সব ধরনের অন্তরঙ্গ গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেয়। সাবিনা মনে করতো, যে মানুষটা তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হারায়, সে সবকিছুই হারায়।আর যে মানুষ স্বেচ্ছায় তার গোপনীয়তা পরিত্যাগ করে সে আসলেই একটা দানব। একারণেই সাবিনা অন্ততপক্ষে আদৌ কোনো যন্ত্রণা অনুভব করেনি তার ভালোবাসাকে গোপন রেখে। বরং এর বিপরীত, শুধুমাত্র সেটা করেই সে সত্যের মধ্যে বসবাস করতে পারে।

অন্যদিকে ফ্রান্জ, নিশ্চিত যে জীবনের এই দ্বি-বিভক্তি - গোপন এবং উন্মুক্ত, হচ্ছে সব মিথ্যার উৎস: ব্যক্তিগত জীবনে কোনো একটি মানুষ যেমন, সামাজিক জীবনে সে খুব ভিন্ন। ফ্রান্জের জন্য, সত্যে বসবাস মানে এই ব্যক্তিগত আর সামাজিক জীবনের মধ্যে দেয়ালটিকে ভেঙ্গে ফেলা। তার পছন্দের একটি কাজ ছিল, কোনো একটি কাঁচের ঘরে বসবাস করার কাম্যতা নিয়ে আন্দ্রে বেতোঁর একটি উদ্ধৃতি দেয়া, যে ঘরের ভিতরে সবাই সব কিছু দেখতে পারে, এবং যেখানে গোপন কিছুই নেই।

যখনই সে শুনেছিল তার স্ত্রী সাবিনাকে বলছে, গলার লকেটটা খুব কুৎসিত! তখনই সে উপলব্ধি করেছিল সে আর মিথ্যায় বসবাস করতে পারবেনা, সাবিনার সমর্থনে তার পাশে তাকে দাড়াতে হবে। আর তখনই সেটা সে করেনি শুধুমাত্র সে ভয় পেয়েছিল তার গোপন ভালোবাসার সাথে যেন সে বিশ্বাসঘাতকতা না করে।

ককটেইল পার্টির পরের দিন, সেই সপ্তাহ শেষে সাবিনা ও তার রোমে যাবার কথা ছিল। কিন্তু ‘ঐ লকেটটা কুৎসিত’ এই কথাগুলো কিছুতেই সে ভুলতে পারছিল না, আর এটি মারি-ক্লদের একটি নতুন রূপ উন্মোচিত করেছিল তার সামনে। তার আগ্রাসী মনোভাব - অভেদ্য, কোলাহলমূখরতা, প্রাণশক্তির উচ্ছ্বাস - যা তাকে অব্যাহতি দিয়েছিল ভালোত্বের বোঝা থেকে, তাদের বিবাহিত জীবনের তেইশ বছর ধরে যে বোঝা সে ধৈর্য সহকারে বহন করে এসেছে। আমস্টারডামের পুরনো চার্চের ভিতরে সুবিশাল শূন্য পরিসরের কথা মনে পড়েছিল তার এবং অবোধ্য একটি তীব্র আনন্দ সে অনুভব করে,  যে অনুভূতিটি তার ভিতরে সূচনা করেছিল সেই শূন্যতাটি।

ফ্রান্জ যখন তার ছোট ব্যাগটি গোছাচ্ছিল যখন মারি-ক্লদ ঘরে এসে ঢোকে, পার্টিতে আসা নানা অতিথিদের নিয়ে সে তার কথা বলা অব্যাহত রেখেছিল, উৎসাহের সাথে কারো দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন আর আরো কারো দৃষ্টিভঙ্গি সে হেসে উড়িয়ে দেয়।

ফ্রান্জ অনেকক্ষণ ধরে তার দিকে তাকিয়ে অবশেষে বলে, ‘রোমে আসলে কোনো সম্মেলন নেই’।

মারি-ক্লদ বিষয়টি বুঝতে পারেনা, ‘তাহলে তুমি যাচ্ছো কেন’? সে বলে, ‘গত নয় মাস ধরে আমার একটি প্রেমিকা আছে, যার সাথে আমি জেনেভাতে মিলিত হতে চাইনা। সেকারণেই আমি এত ভ্রমণ করছি। আমি ভেবেছি বিষয়টি তোমার জানার সময় হয়েছে’।

প্রথম কিছু শব্দ উচ্চারণ করার পর ফ্রান্জ তার নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে, সে অন্যদিকে তাকায় যেন মারি-ক্লদের মুখে হতাশা তাকে দেখতে না হয়, যে হতাশা তার শব্দগুলো সৃষ্টি করবে বলে সে প্রত্যাশা করেছিল।

খানিকটা বিরতির পর সে মারি-ক্লদকে বলতে শোনে, ‘হ্যাঁ, আমি মনে করি বিষয়টি আমার জানার সময় হয়েছে’।

তার কণ্ঠস্বর এত দৃঢ় যে, ফ্রান্জ তার দিকে ঘুরে তাকায়। তাকে আদৌও বিচলিত মনে হয়না। বাস্তবিকভাবেই তাকে দেখতে সেই এমন রমণীর মতই লাগছে, যে একদিন আগে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলেছিল, ঐ লকেটটা কুৎসিত!

মারি-ক্লদ আরো যোগ করে: ‘এখন যেহেতু আমাকে বলার জন্য তুমি সাহস অর্জন করতে পেরেছো যে, গত নয় মাস ধরে তুমি আমার সাথে প্রতারণা করছো, তোমার কি মনে হয় তুমি বলতে পারবে, সে কে’?

সবসময়ই সে নিজেকে বলেছে, মারি-ক্লদকে আঘাত করার কোনো অধিকার তার নেই এবং তার মধ্যে থাকা রমণীটিকে তার শ্রদ্ধা করা উচিৎ। কিন্তু তার ভিতরে সেই রমণীটি কোথায় গেল? অন্যার্থে, সেই মাতৃরুপটির কি ঘটেছে, যার সাথে সে তার স্ত্রীকে মানসিকভাবে সংযুক্ত করেছিল? তার মা, দুঃখিত এবং আহত, বেমানান জুতা দুই পায়ে পড়ে, মারি-ক্লদের ভিতর থেকে প্রস্থান করেছে - অথবা হয়তো না, মারি-ক্লদের ভিতরে সে হয়তো কখনোই ছিল না। পুরো বিষয়টি তার সামনে উন্মোচিত হয় আকস্মিক ঘৃণায়।  

‘তোমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার আমার কোনো কারণ নেই’, সে বলে। যদি  সে তার অবিশ্বস্ততা দিয়ে মারি-ক্লদকে আহত করতে সফল না হতে পারে, সে নিশ্চিত ছিল, তার প্রতিদ্বন্দ্বীর নাম প্রকাশ করলে হয়তো সেটি করা সম্ভব হবে। তার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে সে তাকে সাবিনার কথা বলে।

এর কিছুক্ষণ পর বিমানবন্দরে তার সাথে সাবিনার দেখা হয়। আকাশে বিমানটি ওড়ার সময় সে নিজেকে ক্রমশ হালকা থেকে আরো হালকা অনুভব করে। অবশেষে সে নিজেকে বলে, নয় মাস পরে সে এখন সত্যের  বসবাস করছে।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য