বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৮

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-২৪ ১২:২৪:২১

কাজী মাহবুব হাসান:


সাবিনার মনে হয়েছিল ফ্রান্জ তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার দরজাটি উন্মুক্ত করে দিয়েছে। যেন সে মারি-ক্লদ, মারি-অ্যান, চিত্রকর অ্যালেন, সেই ভাস্কর যে তার আঙ্গুল ধরে ছিল - জেনেভায় তার পরিচিত সব মানুষের মাথার ভিতর উকি দিচ্ছে। এখন সে পছন্দ করুক কিংবা না করুক এমন এক রমণীর প্রতিদ্বন্দ্বীতে রূপান্তরিত হয়েছে, যার প্রতি তার কোনো ন্যুনতম আগ্রহ নেই। ফ্রান্জ বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করবে, এবং সে তাদের বিশাল দাম্পত্য শয্যায় মারি-ক্লদের জায়গা নেবে। প্রত্যেকেই বেশী কিংবা কম দূরত্ব থেকে এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করবে এবং সে বাধ্য হবে সবার সামনে এই নাটকে অভিনয় করার জন্য। সাবিনার পরিবর্তে, তাকে সাবিনার ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে কিভাবে সেই ভূমিকায় ভালো অভিনয় করা যায়।  একবার যখন তার ভালোবাসার কথা প্রচারিত হয়েছে, এটি আরো ভারী হয়ে উঠবে, বোঝায় পরিণত হবে। সাবিনা এই ভাবনায় শঙ্কায় অস্বস্তিবোধ করে।

রোমের একটি রেস্টুরেন্টে তারা রাতের খাবার খায়। নীরবে সাবিনা পান করে।

ফ্রান্জ তাকে জিজ্ঞাসা করে, তুমি তো রাগ করোনি, তাই না?

সাবিনা তাকে আশ্বস্ত করে বলে, না সে রেগে নেই। কিন্তু সে তখনও অনিশ্চিত এবং সংশয়ে, তার কি আনন্দিত হওয়া উচিৎ… নাকি না। সাবিনার মনে পড়ে সেই সেই মুহূর্তটির কথা যখন তাদের দেখা হয়েছিল অ্যামস্টারডাম এক্সপ্রেসের স্লিপিং কম্পার্টমেন্টে, যে মুহূর্তে সে আসলেই নতজানু হতে চেয়েছিল ফ্রান্জের সামনে, তার আলিঙ্গন ভিক্ষা করার জন্য, তাকে জোর করে আঁকড়ে ধরার জন্য, এবং কখনোই তাকে ছেড়ে না যাবার জন্য। বিশ্বাসঘাতকতার সেই বিপদজনক রাস্তার শেষ প্রান্তে আসার জন্য তীব্র কামনা করেছিল সাবিনা, বিশ্বাসঘাতকতার পরিসমাপ্তির ঘোষণা দিতে চেয়েছিল সে।

সেই কামনাকে তীব্রতর করার জন্য যতই চেষ্টা করুক না কেন সাবিনা, কিংবা সেই মুহূর্তটিকে ডেকে আনুক না কেন তার সাহায্যে, যতই সে নির্ভর করুক না কেন সেই ঘটনাটির উপর, বিস্বাদের সেই অনুভূতিটা কেবলই আরো তীব্রতর হয়ে ওঠে।

রোমের রাস্তায় আরো কিছুক্ষণ হেটে তারা তাদের হোটেলে ফিরে আসে, যেহেতু তাদের চারপাশে ইতালীয়রা সব হৈ চৈ, চিৎকার আর নানা অঙ্গভঙ্গি করছিল, তারা নীরবে হেটে আসতে পেরেছিল তাদের নীরবতাকে না শুনেই।

স্নান করতে বাথরুমে অনেকক্ষণ সময় নেয় সাবিনা, কম্বলের নীচে তার জন্য অপেক্ষা করেছিল ফ্রান্জ, সবসময়ের মতই ছোট একটি ল্যাম্প জ্বলছিল।

যখন সে বেরিয়ে আসে, সে এটি বন্ধ করে দেয়, প্রথমবারের মত সে কাজটি করেছিল, ফ্রান্জের উচিৎ ছিল আরো ভালো করে মনোযোগ দেয়া, সে লক্ষ্য করেনি, কারণ তার কাছে আলোর কোন অর্থ নেই। যেমন আমরা জানি সে সঙ্গমের সময় চোখ বন্ধ করে রাখে।

বাস্তবিকভাবে তার এই বন্ধ করে রাখার চোখের কারণে সাবিনা আলোটা নিভিয়ে দেয়। এক মুহূর্তের জন্যেও তার সেই বন্ধ হয়ে থাকা চোখের পাপড়ি তার সহ্য হয়না। চোখ, যেমন প্রবাদে আছে, হচ্ছে আত্মার জানালা, ফ্রান্জের শরীর যখন তার বন্ধ চোখ সহ সাবিনার শরীরের উপর আছড়ে পড়তে থাকে, তখন সেই শরীর তাহলে আত্মাহীন শরীর। অনেকটা সদ্যজাত প্রাণীর মত, এখনও অন্ধ, মায়ের স্তন বৃন্তের জন্য কাতর স্বরে গোঙাচ্ছে। পেশীবহুল ফ্রান্জ সঙ্গমের সময় তার স্তনবৃন্ত চুষতে থাকা দানবীয় কুকুর ছানার মত। সে আসলেই তার মুখে স্তনবৃন্ত নেয় যেন সে দুধ পান করার জন্য চুষছে। সেই ধারণাটি, নীচে সে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এবং উপরে দুগ্ধপোষ্য শিশু, এবং সুতরাং সে একটি শিশুর সাথে সঙ্গম করছে, অত্যন্ত বিতৃষ্ণাজনক। না সে আর কখনোই দেখতে চায়না তার শরীর তার উপরে বেপরোয়াভাবে নড়াচড়া করছে, কখনোই সে তাকে তার স্তন মুখে নেতে দেবেনা, যেমন কোনো কুকুর মা তার সন্তানদের সুযোগ করে দেয়, আজই শেষ বারের মত, অপরিবর্তনীয়ভাবে চূড়ান্ত!

সে জানতো, অবশ্যই, সে একটু অতিমাত্রায় পক্ষপাতদুষ্ট  আর স্বার্থপরের  মত আচরণ করছে, কারণ ফ্রান্জ ছিল তার জীবনে আসা সবচেয়ে সেরা পুরুষ - বুদ্ধিমান, সে তার চিত্রকর্ম বুঝতো, সুদর্শন এবং ভালো - কিন্তু যতই সে বিষয়টি নিয়ে ভাবে, ততই সে ফ্রান্জের বুদ্ধিমত্তাকে ছিনিয়ে নেবার আকাঙ্ক্ষা বোধ করে, তাদের সহৃদয়তাকে কলুষিত করার ইচ্ছা বোধ করে এবং তার ক্ষমতাহীন শক্তিকে অবমাননা করতে ইচ্ছা করে।

সেই রাতে, সাবিনা তার সাথে সঙ্গমে লিপ্ত হয় আগের চেয়ে আরো বেশী উন্মত্ততা নিয়ে, এটাই শেষবারের মত মিলিত হওয়া - এই উপলব্ধি সাবিনাকে আরো কামনাপীড়িত হয়ে। তবে সঙ্গমের সময়, সে দূরে, বহু দূরে,  আরো একবার সে বিশ্বাসঘাতকতা করার সোনালী শিঙ্গার আওয়াজ সে শুনতে পায় দূরে, এবং সে জানতো সে আর প্রতিরোধ করবে না সেই আহবান।  তার সামনে স্বাধীনতা সুবিশাল পরিসরটি সে অনুভব করতে পারে এবং এর সীমাহীনতা তাকে উত্তেজিত করে। উন্মত্ত পাগলের মত, বন্ধনহীন উল্লাসে সে ফ্রান্জের সাথে সঙ্গম করে যেভাবে এর আগে সে কখনোই করেনি।

তার বুকে উপর শুয়ে ফ্রান্জ ফুঁপিয়ে কাঁদে, নিশ্চিত ছিল সে বুঝেছে: রাতের খাবারের সময় জুড়ে সাবিনা নীরব ছিল, তার সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি কথাও বলেনি, কিন্তু এটাই ছিল তার উত্তর। তার আনন্দের একটি সুস্পষ্ট প্রদর্শনী সে করেছে, তার তীব্রতম আবেগ, তার সম্মতি, তার সাথে চিরকাল বাস করার তার বাসনা।  

তার নিজেকে মনে হয়েছিল এক অশ্বারোহীর মত যে বিস্ময়কর একটি শূন্যতার দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে যাচ্ছে,  স্ত্রীহীন শূন্যতা, কন্যাহীন, সংসারহীন, চমৎকার শূন্যতা যা ঝেড়ে যা পরিষ্কার করেছে হারকিউলিসের ঝাড়ু, যে চমৎকার শূন্যতা সে পূর্ণ করবে তার ভালোবাসা দিয়ে।

একে অপরের সওয়ার তখন ঘোড়ার মত করে এবং দুজনেই তাদের বাসনার দূর সীমানার দিকে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে, বিশ্বাসঘাতকতায় মাতাল হয়ে, যে বিশ্বাসঘাতকতা তাদের মুক্ত করেছে। ফ্রান্জ সাবিনার উপর সওয়ার এবং সে তার স্ত্রীকে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সাবিনা ফ্রান্জের উপর সওয়ার, যে ফ্রান্জের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।
(চলবে...)

আপনার মন্তব্য