বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৪-৩০ ১৭:০৮:৪৫

কাজী মাহবুব হাসান:


প্রায় ২০ বছর ধরে ফ্রান্জ তার স্ত্রীর মধ্যে তার মাকে দেখেছে - দুর্বল, অসহায় এক চরিত্র যার প্রয়োজন ছিল তার সুরক্ষার। এই ছবিটি তার গভীরে প্রোথিত ছিল। এবং খুব সহজে মাত্র দুই দিনে সে এর থেকে পরিত্রাণ পায়নি - বাড়িতে ফেরার সময় তার বিবেক তাকে যন্ত্রণা দিচ্ছিল। ভয় পেয়েছিল যে মারি-ক্লদ হয়তো পুরোপুরিভাবে ভেঙ্গে পড়েছে তার চলে যাবার পর এবং হয়তো তাকে তীব্র হৃদয় যন্ত্রণায় সে দেখতে পাবে। সন্তর্পণে ফ্রান্জ দরজার তালা খোলে ও তার ঘরে যায়, কিছুক্ষণ সেখানে দাড়িয়ে সে শোনে, হ্যাঁ, মারি-ক্লদ বাসায় আছে। কিছু মুহূর্তের ইতস্ততা শেষে সে মারি-ক্লদের যায়, আগের মতই তাকে শুভেচ্ছা জানাতে প্রস্তুত হয়ে।

কি?, ছদ্ম একটি বিস্ময়ে তার ভ্রু উঁচিয়ে সে চিৎকার করে ওঠে, তুমি? এখানে?

আমি আর কোথায় যেতে পারি? যে বলতে চেয়েছিল (সত্যিকারভাবে আশ্চর্য হয়ে) কিন্তু কিছুই সে বলেনা।

‘বিষয়টি এখনই পরিষ্কার করার দরকার আমাদের, কি করবো আমরা, ঠিক আছে? এখন থেকেই সাবিনার সাথে তোমার থাকার ব্যাপারে আমার কোনো আপত্তি নেই’।

রোমের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার আগের দিন যখন সে স্বীকারোক্তি করেছিল, তার মনে কোনো সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা ছিলনা। সে প্রত্যাশা করেছিল বাসায় ফিরে, বৈরী নয় এমন একটি পরিবেশে সব বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করবে যেন মারি-ক্লদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশী কোনো ক্ষতি না হয়। তার কখনোই মনে হয়নি যে সে খুব শান্ত ও ঠাণ্ডা স্বরে তাকে চলে যাবার জন্য চাপ দিতে পারে।

যদিও এটি সব কাজ সহজতর করবে, কিন্তু খানিকটা হতাশা অনুভব করাটা সে এড়াতে পারেনা। সারাজীবনই সে ভয় পেয়েছে মারি-ক্লদকে আঘাত করার জন্য এবং স্বেচ্ছায় নিজেকে আটকে রেখেছে একগামীতার অর্থহীন অনুভূতিশুন্য শৃঙ্খলায়। এবং এখন, বিশ বছর পর, সে হঠাৎ করেই উপলব্ধি করে এই সব কিছুই তার বাড়াবাড়ি ছিল, বহু রমণীকে সে বিসর্জন দিয়েছে এই বিভ্রান্তির জন্য।

সেই বিকালে, সে তার লেকচার শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরাসরি সাবিনার বাসায় যায়। সে সিদ্ধান্ত  নিয়েছিল তাকে জিজ্ঞাসা করবে, সে কি তার ওখানে রাত কাটাতে পারে কিনা। দরজায় ঘণ্টি বাজায়, কিন্তু কেউই উত্তর দেয়না। উল্টোদিকে রাস্তার পাশে একটি কাফেতে বসে তার বিল্ডিং এর প্রবেশ পথের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

সন্ধ্যা নামে, সে বুঝতে পারে না কি করবে। তারা সারাজীবন সে মারি-ক্লদের সাথে এক বিছানায় শুয়েছে, যে যদি মারি-ক্লদের ওখানে যায়, কোথায় সে শোবে? অবশ্যই, সে পাশের রুমে সোফায় তার বিছানা করে নিতে পারে। কিন্তু সেটা কি খুব একটা পাগলামো মনে হবে না? সেটা কি দেখতে মনে হবে না অশুভ কোনো ইচ্ছার চিহ্ন? মারি -ক্লদের সাথে সে বন্ধু হিসাবে থাকতে চেয়েছে, আর যাই হোক। কিন্তু তার সাথে এক বিছানায় শোয়ার প্রশ্নই আসে না। সে এমনকি শুনতে পায় তার শ্লেষাত্মক মন্তব্যটি, ঘুমানোর জন্য সে কেনো সাবিনার বিছানা পছন্দ করছে না। হোটেলে একটি রুম ভাড়া করে সে।

পরের দিন যে আবারো সাবিনার দরজার ঘণ্টি বাজায়, সকালে দুপুরে ও রাতে।
এর পরের দিন, ভবনের তত্ত্বাবধায়কের সাথে সে দেখা করে, তার কাছে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না, সে তাকে ফ্ল্যাটটির মালিকের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, ফ্রান্জ ফোন করেছিল তাকে, এবং জানতে পারে, দু দিন আগেই সাবিনা বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে।

পরের কয়েকটি দিন নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে সে ফিরে এসেছে সেখানে, সাবিনাকে খুঁজে পাবার আশা নিয়ে, কিন্তু একদিন সে দরজা খোলা পায়, ওভারঅল পরা তিনজন মানুষকে বাইরে রাস্তায় পার্ক করে রাখা ভ্যানে আসবাবপত্র এবং পেইন্টিং তুলতে দেখে।

তাদের সে জিজ্ঞাসা করে, তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেই আসবাবগুলো।

তারা উত্তর দেয় তাদের উপর কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া আছে তারা যেন কারো কাছে তাদের গন্তব্যের ঠিকানা প্রকাশ না করে।

আরেকটু হলেই গোপন ঠিকানাটি জানার জন্য কিছু টাকা দিতে সে উদ্যত হতো, কিন্তু হঠাৎ করে  সে অনুভব করে সেটা করার মত তার আর কোনো শক্তি নেই। তার দুঃখ পুরোপুরিভাবে তাকে ভেঙ্গে ফেলেছে। সে কিছুই বুঝতে পারে না, কি ঘটছে সে সম্বন্ধে তার বিন্দুমাত্র কোনো ধারণাই নেই। সে শুধু জানে, সাবিনার দেখার হবার পর থেকেই সে অপেক্ষা করছিল এমন কিছু ঘটার জন্য। যা অবশ্যই ঘটবে, তা ঘটবেই। ফ্রান্জ এর বিরোধিতা করেনি।

শহরের পুরোনো অংশে সে তার নিজের জন্য একটি ছোট ফ্ল্যাট খুঁজে নেয়, যখন সে জানতো তার স্ত্রী এবং মেয়ে কেউই বাসায় থাকবে না, সে তার পুরোনো বাসায় ফিরে গিয়েছিল তার কাপড় আর গুরুত্বপূর্ণ কিছু বই নিয়ে আসবার জন্য। খুবই সতর্ক ছিল সে, মারি-ক্লদ যেন কোনো কিছুর অনুপস্থিতি টের না পায়।

একদিন, একটি কাফে জানালা দিয়ে সে তাকে দেখেছিল, দুজন রমণীর সাথে বসে আছে এবং মুখ বিকৃত করার অসংযত ক্ষমতার কারণে বহুদিন ধরেই বলিরেখায় পূর্ণ তার মুখ প্রাণচঞ্চলতায় উচ্ছল- শ্রোতা মহিলারা গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছে আর সারাক্ষণই হাসছে। ফ্রান্জ কিছুতেই সেই অনুভূতিটাকে মন থেকে সরাতে পারে না, সে হয়তো তাদের তার কথাই বলছে। নিশ্চয়ই সে জানে যে সাবিনা জেনেভা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে ঠিক যে সময় ফ্রান্জ তার সাথে একসাথে থাকতে চেয়েছে। কি হাস্যকর গল্পই না হতে পারে এটি! সে আদৌ অবাক হয়নি তার প্রাক্তন স্ত্রীর বন্ধুদের হাসি পাত্রে রূপান্তরিত হওয়ার জন্য।

তার নিজের বাসা, নতুন ফ্ল্যাটে ফিরে স আসে যখন, যেখানে প্রতিটি ঘণ্টায় সে সেইন্ট পিয়ের এর ঘন্টাধ্বণি শুনতে পায়, ফ্রান্জ লক্ষ্য করে ডিপার্টমেন্ট স্টোর থেকে তার নতুন ডেস্কটি পৌঁছে দিয়েছে। দ্রুত সে মারি-ক্লদ ও তার বন্ধুদের ভুলে যায়, কিছুক্ষণের জন্য এমনকি সে সাবিনাকেও ভুলে যায়। ডেস্কে সে বসে, খুশী হয় যে সে নিজেই এটা পছন্দ করে কিনেছে। বিশ বছর ধরে সে এমন আসবাবপত্রের মধ্যে ছিল যার কোনোটাই সে নিজে পছন্দ করেনি। সবকিছুই মারি-ক্লদই ব্যবস্থা করেছে। অবশেষে সে আর ছোট বালক থাকে না, জীবনে প্রথমবারের মত সে পুরোপুরিভাবে এখন তার নিজের উপর নির্ভরশীল। পরেরদিনই একটি বই রাখার একটি আলমারি বানানোর জন্য সে একজন কাঠমিস্ত্রিকে ঢেকে আনে। বেশ কিছুদিন ধরেই সে ব্যস্ত ছিল সেটি পরিকল্পনা করার জন্য, কোথায় এটা থাকবে, কিভাবে সাজাবে সেই বিষয়ে।

খুবই বিস্ময়ের সাথে একটা পর্যায়ে সে উপলব্ধি করতে পারে, খুব সুনির্দিষ্টভাবে সে আসলে অসুখী নয়। সাবিনার শারীরিক উপস্থিতি সে যতটা সন্দেহ করেছিল তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণিত হয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি হচ্ছে সোনালী পদচিহ্ন, সেই যাদুকরী পদচিহ্ন যা সাবিনা তার জীবনে রেখে গেছে, যা কেউ কখনো মুছে ফেলতে পারবে না। তার দিগন্ত থেকে চিরতরে অদৃশ্য হয়ে যাবার ঠিক আগে সাবিনা তার হাতে হারকিউলিসের ঝাড়ুটি দিয়ে গেছে, এবং সেটি দিয়ে সে তার জীবনের ঘৃণ্য সবকিছু ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে বের করে দিয়েছে। একটি হঠাৎ সুখ, তীব্র সুখানুভূতি, সেই আনন্দ যা আসে স্বাধীনতা আর একটি নতুন জীবন থেকে - এইসব কিছুই তার জন্য রেখে যাওয়া সাবিনার উপহার।

আসলেই, সবসময় সে অবাস্তবকেই বেছে নিয়েছে বাস্তবতার পরিবর্তে, ঠিক যেমন ছাত্রছাত্রী পূর্ণ লেকচার হলের চেয়েও বরং মিছিলে সে ভালো অনুভব করেছে ( যা, যেমন আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম, যেগুলো পুরোটাই  নাটকীয় অভিনয় আর স্বপ্ন), ঠিক তেমন ভাবেই সে বেশী সুখী অদৃশ্য দেবী সাবিনার সাথে, সেই সাবিনার চেয়েও - যে তার সঙ্গী হয়েছে পৃথিবীব্যাপী বহু ভ্রমণে এবং সারাক্ষণই যার ভালোবাসাকে হারাবার ভয় করেছে সে। তাকে স্বনির্ভর হয়ে বাঁচার জন্য একটি পুরুষের অপ্রত্যাশিত স্বাধীনতা প্রদান করে, সে তাকে মোহময়তার একটি অলৌকিক দীপ্তি দিয়ে গেছে। রমণীদের কাছে ফ্রান্জ আরো বেশী আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, তার একটি ছাত্রীও তার প্রেমে পড়ে।

এবং বিস্ময়কর অল্প সময়ের মধ্যেই তার জীবনের পটভূমিও বদলে যায় আমূল। কিছুদিন আগেও সে বাস করতো একটি গৃহপরিচারিকা সহ বড় উচ্চ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ফ্ল্যাটে, একটি কন্যা এবং স্ত্রী সহ, এখন সে বাস করে শহরের পুরোনো অংশে একটি ছোট ফ্ল্যাটে, যেখানে সে প্রতি রাতে মিলিত হতো তার তরুণ ছাত্রী-প্রেমিকার সাথে। তার কোনো প্রয়োজন ছিল না এক হোটেল থেকে আরেক হোটেলে তাকে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর, সে এখন তার নিজের ফ্ল্যাটেই তার সাথে সঙ্গম করতে পারে, তার নিজের বিছানায়, তার নিজের বই আর বিছানার পাশের ছাইদানি সহ টেবিল সহ।

 ফ্রান্জের নতুন প্রেমিকা ভদ্র যদিও বিশেষভাবে সুন্দরী নয়, কিন্তু সেও ঠিক একইভাবে ফ্রান্জের অনুরাগী ছিল, কিছুদিন আগে মাত্র যেভাবে ফ্রান্জ সাবিনার অনুরাগী ছিল। তার কাছে বিষয়টি অপ্রীতিকর মনে হয়নি। এবং যদি তার তেমন কিছু মনে হয়ে থাকেও হয়তো সে অনুভব করেছিল চশমা সহ কোনো ছাত্রীকে দিয়ে সাবিনাকে প্রতিস্থাপিত করা একধরনের অধঃপতন, তার অন্তর্নিহিত ভালোমানুষি বিষয়টি লক্ষ্য রেখেছিল যেন সে তার প্রতি মনোযোগি হয় এবং পিতৃসূলভ একটি ভালোবাসায় কোনো কমতি না থাকে, যে ভালোবাসাটি প্রকাশিত হবার কোনো সত্যিকার পথ পায়নি এর আগে, বিশেষ করে যখন মারি-অ্যান সবসময় তার মেয়ে হিসাবে কম আচরণ করেছে, যতটা না করেছে মারি-ক্লদের অনুলিপি হিসাবে।

 একদিন সে তার স্ত্রীর সাথে দেখা করতে গিয়েছিল, সে তাকে বলেছিল, সে আবার বিয়ে করতে চায়। মারি-ক্লদ তার মাথা ঝাঁকিয়েছে।

‘কিন্তু বিবাহ বিচ্ছেদ তোমার কোনো কিছু পরিবর্তন করবে ন, তুমি কোনো কিছু হারাবে না, আমি তোমাকে সব সম্পত্তি লিখে দেবো!’

মারি-ক্লদ বলে, ‘সম্পত্তির প্রতি আমার কোনো আগ্রহ নেই’।

‘তাহলে কোন বিষয়ে তোমার আগ্রহ’?

স্মিত হেসে সে বলে, ‘ভালোবাসা’।

বিস্ময়ের সাথে ফ্রান্জ তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘ভালোবাসা’?

‘ভালোবাসা হচ্ছে একটা যুদ্ধ’, মারি-ক্লদ তার হাসিমুখ অপরিবর্তিত রেখেই বলে, ‘এবং আমার পরিকল্পনা হচ্ছে শেষ অবধি যুদ্ধটা চালিয়ে যাওয়া’।

‘ভালোবাসা যুদ্ধ’ ? ফ্রান্জ বলে, ‘বেশ, আমার যুদ্ধ করার কোনো ইচ্ছা নেই।’ সে চলে আসে।
(চলবে...)

আপনার মন্তব্য