বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-১০

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-০৪ ২৩:৫০:২৪

কাজী মাহবুব হাসান:

১০
জেনেভায় চার বছরের পর সাবিনা প্যারিসে বসতি গড়েছিল, কিন্তু সে তার বিষণ্ণতাকে থেকে মুক্তি পায়নি। কেউ যদি তাকে জিজ্ঞাসা করে কি হয়েছে তার, তাকে রীতিমত সংগ্রাম করতে হয় সেটি ব্যাখ্যা করার জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজতে।

যখন আমরা আমাদের জীবনের নাটকীয় মূহুর্তগুলোকে অভিব্যক্তি দিতে চাই, আমাদের প্রবণতা আছে ভারের রূপক ব্যবহার করার। আমরা বলি কোনো কিছু আমাদের উপর বিশাল বোঝার মত চেপে আছে, হয় আমরা সেই বোঝা বহন করবো অথবা ব্যর্থ হয়ে সেই ভারের নীচে পিষ্ট হবো, আমরা এর সাথে সংগ্রাম করি, হারি কিংবা জিতি। এবং সাবিনা - কি ভর করেছিল তার উপর? কিছু না। সে একজন প্রেমিককে ত্যাগ করেছিল কারণ তার মন চাইছিল তাকে ত্যাগ করে আসার জন্য। সে কি তাকে হয়রানি করেছিল? সে কি চেষ্টা করেছিল তার উপর প্রতিশোধ নেবার জন্য? না, তার নাটক ছিল এমন একটি নাটক সেটি ভারের নয় বরং নির্ভারতার। তার ভাগ্যে যা ঘটেছিল সেটি বোঝা নয় বরং বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা।

সেই সময় অবধি, বিশ্বাসঘাতকতা সাধারণত তাকে পূর্ণ করতো উত্তেজনা আর আনন্দে, কারণ সেগুলো নতুন আরো বিশ্বাসঘাতকতার অভিযানের নতুন পথ উন্মুক্ত করে দিতো। কিন্তু কি হবে যদি সেই পথই শেষ হয়ে যায়? কেউ তাদের পিতামাতা, স্বামী, দেশ, ভালোবাসার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে কিন্তু যখন পিতামাতা, স্বামী, দেশ, ভালোবাসা সব চলে যায় - বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য তাহলে কি বাকী থাকে আর?

সাবিনা তার চারপাশে শূন্যতা অনুভব করে। কি হবে যদি এই শূন্যতাই হয় তার সব বিশ্বাসঘাতকতার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য?  

স্বাভাবিকভাবেই বিষয়টি আজ অবধি সে কখনোই  উপলব্ধি করতে পারেনি, কিভাবেই বা সে পারবে? যে লক্ষ্যগুলো আমরা অর্জন করার চেষ্টা করি,  সেগুলো সবসময়ই আবৃত। যে রমণী বিবাহের জন্য কামনা করে, সে এমন কিছুর জন্য কামনা করে যার সম্বন্ধে সে কিছুই জানে না, যে পুরুষটি খ্যাতির জন্য লালায়িত, তার কোনো ধারণাই নেই খ্যাতি কি। যে বিষয়টি আমাদের প্রতিটি কাজকে অর্থবহ করে, তার অর্থ সবসময়ই পুরোপুরিভাবে আমাদের অজানা। সাবিনা জানতো না তার বিশ্বাসঘাতকতা করার তাড়নার পেছনে সত্যিকারের উদ্দেশ্যটা আসলে কি। বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা - এটাই সেই লক্ষ্য? জেনেভা থেকে প্রস্থান তাকে যথেষ্ট পরিমাণ সেই লক্ষ্যের নিকটে নিয়ে এসেছে।

প্যারিসে আসার তিন বছর পর, সে প্রাহা থেকে একটি চিঠি পায়। চিঠির লেখক টমাসের ছেলে। কোনো না কোনো ভাবে সে তার সম্বন্ধে জেনেছে ও ঠিকানা যোগাড় করেছে এবং তার বাবার ঘনিষ্ঠতা বন্ধু হিসাবে তাকে সে লিখেছিল। সাবিনাকে টমাস ও তেরেজার মৃত্যুসংবাদ সে জানিয়েছিল। গত কয়েক বছর ধরেই তারা একটি গ্রামে বাস করতো, একটি সমবায় খামারের গাড়িচালক হিসাবে কাজ করতে টমাস, মাঝে মাঝে তারা পাশের একটি শহরে সস্তা হোটেলে রাত কাটাতে যেতো গাড়ি চালিয়ে, পাহাড়ের মধ্য দিয়ে যাবার রাস্তাটি ছিল বেশ আঁকাবাঁকা, সেখানেই তাদের পিকআপ গাড়িটি দুর্ঘটনায় ছিটকে পড়ে গভীর পাহাড়ের খাদে। তাদের শরীর রূপান্তরিত হয়েছিলে একতাল মাংসপিণ্ডে। পুলিশ পরে অনুসন্ধান করে আবিষ্কার করে গাড়ির ব্রেকটির মারাত্মক ক্রুটি ছিল।

খবরটি সে কিছুতেই মন থেকে সরাতে পারেনি। অতীতের সাথে তার শেষ সংযোগটি ছিন্ন হয়েছিল। তার পুরনো অভ্যাস মোতাবেক, সাবিনা নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে সমাধি ক্ষেত্রে হাঁটার মাধ্যমে।  মন্টপারনাস সমাধিক্ষেত্র তার সবচেয়ে নিকটে, ক্ষুদ্রাকৃতির ঘর কিংবা চ্যাপেল শুধু সেখানে প্রতিটি সমাধির উপর। সাবিনা বুঝতে পারে না কেন মৃতরা তাদের কবরের উপর নকল অুনকরণকৃত কোনো প্রাসাদ বানানো হোক এমনটা চাইতে পারে। সমাধিক্ষেত্রটি যেন পাথরে রূপান্তরিত আত্মশ্লাঘা। মৃত্যুতে আরো যৌক্তিক হবার বদলে সমাধিক্ষেত্রের বাসিন্দারা জীবনে যতটা ছিল তার চেয়ে আরো বেশী নির্বোধ হয়ে ওঠে। তাদের স্মারকস্তম্ভগুলোর উদ্দেশ্য সবাইকে দেখানো কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তারা। শেখানো কোনো বাবা, ভাই, পুত্র অথবা পিতামহী সমাহিত নেই, শুধুমাত্র বিখ্যাত পরিচিত মানুষরা, নানা খেতাব, ডিগ্রী, আর  সন্মানস্মারক বহনকারীরা, এমনকি ডাকঘরের কেরানীও তার বাছাইকরা পেশা, আর তার সামাজিক গুরুত্ব - তার মর্যাদা নিয়ে উচ্ছ্বসিত।

সারি বাধা সমাধিগুলোর মধ্যে দিয়ে হাটার সময় সে লক্ষ্য করে কিছু মানুষ জড়ো হয়েছে কাউকে সমাহিত করার জন্য। শেষকৃত্যের অনুষ্ঠানটির পরিচালকের হাত ভর্তি ফুল এবং প্রতিটি শোকার্তকে সে বিলি করছে একটি করে ফুল, সাবিনাকেও সে একটি দেয়, সাবিনা সেই দলের সাথে যোগ দেয়, বহু সমাধি স্মারককে পাশ কাটিয়ে তারা সেই কবরের কাছে আসে, এখনও যা ভারী পাথরের সমাধিফলক মুক্ত। মাটিতে গভীর গর্তের দিকে সে তাকায়, অনেক গভীর, সে তার ফুলটি সেখানে ফেলে দেয়, চমৎকারভাবে ডিগবাজী দিয়ে এটি ভেসে কফিনের উপর পড়ে। বোহেমিয়াতে কবর এত গভীর করে খোড়া হয় না। প্যারিসে কবরগুলো আরো বেশী গভীর। ঠিক যেমন এর উপর নির্মাণগুলো আরো দীর্ঘতর। তার চোখে পাথরের উপর পড়ে, কবরের পাশেই তা পড়ে আছে, শীতল একটি অনুভূতি তাকে স্পর্শ করে, দ্রুত সে বাড়ির পথে রওনা দেয়।

সারাদিন ধরেই সে পাথরটির কথা ভাবে, কেন তাকে এত শঙ্কিত করেছিল সেটি?

নিজেই উত্তর দেয়, যখন কোনো সমাধিকে আবৃত করা হয় পাথর দিয়ে, মৃতরা আর বের  হয়ে আসতে পারেনা।

কিন্তু মৃতরা তো এমনিতেই বের হয়ে আসতে পারেনা, সুতরাং সমাধি পাথর কিংবা ঘাস দিয়ে আবৃত করে রাখার মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?

পার্থক্যটা হচ্ছে যদি কোনো একটি সমাধি পাথর দিয়ে ঢাকা থাকে, এর মানে আমরা চাইনা মৃত ব্যক্তিটি ফিরে আসুক। ভারী পাথর মৃতকে বলে, যেখানে আছো সেখানেই থাকো!

এটাই সাবিনাকে মনে করিয়ে দেয় তার বাবার কবরের কথা। তার বাবার কবরের উপর মাটি, যেখানে ফুল ফুটে আছে, সেটি স্পর্শ করে আছে একটি মেপল গাছ,  শিকড় আর ফুলগুলো তারা মৃতদেহকে কবর থেকে বের হয়ে আসার একটি পথ নিবেদন করেছে। যদি তার বাবার কবর আবৃত থাকতে একটি পাথরে, তাহলে তার মৃত্যুর পর সে কোনোভাবেই তার সাথে যোগাযোগ করতে পারতো না, গাছের মধ্যে তাকে ক্ষমা করে দেয়া তার কণ্ঠস্বর কখনোই সে শুনতে পারতো না ।

 তেরেজা আর টমাস যে সমাধিক্ষেত্রে সমাহিত সেটি কেমন ?

আরো একবার সে তাদের নিয়ে ভাবতে শুরু করে। মাঝে মাঝে তারা পাশের শহরে সস্তা হোটেলে রাত কাটাতে গাড়ি নিয়ে বের হতো। চিঠির এই অনুচ্ছেদটি তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এর অর্থ তারা সুখে ছিল। এবং আবারো সে টমাসকে কল্পনা করে যেন সে তার কোনো চিত্রকর্ম: সামনে ডন হুয়ান, একটি সুপরিসর মঞ্চ যা সৃষ্টি করেছে নবীন কোনো চিত্রকর, সেই পটভূমির একটি ফাটল দিয়ে - ট্রিস্টান। সে ট্রিস্টান হিসাবে মারা গেছে, ডন হুয়ান হিসাবে না। সাবিনা মা বাবা একই সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যু বরণ করেছিল। টমাস আর তেরেজা একই সেকেন্ডে। হঠাৎ করেই সে তীব্রভাবে ফ্রান্জের অনুপস্থিতি অনুভব করে।

যখন সাবিনা ফ্রান্জকে সমাধিক্ষেত্রে  তার হেটে বেড়ানোর অভ্যাসের কথা বলেছিল, তীব্র বিরক্তির সাথে সে কেঁপে উঠেছিল প্রায় এবং বলেছিল সমাধিক্ষেত্রগুলো পাথারের স্তূপ ছাড়া আর কিছু না । সাথে সাথেই ভুল বোঝাবুঝির একটি বিশাল সাগর উন্মুক্ত হয়েছিল তাদের মধ্যে। মন্টপারনাস সমাধিক্ষেত্রের সেই দিনের আগ অবধি সাবিনা কখনো বুঝতে পারেনি, ফ্রান্জ আসলে কি বোঝাতে চেয়েছিল। সে দুঃখবোধ করে তার সাথে এত বেশী অধৈর্যশীল থাকার কারণে, হয়তো যদি তারা একসাথে আরো কিছুটা বেশী সময় থাকতে পারতো, সাবিনা আর ফ্রান্জ তাহলে তাদের ব্যবহৃত শব্দগুলো বুঝতে শুরু করতো। ধীরে ধীরে, সন্তর্পণে তাদের শব্দভাণ্ডারগুলো একত্র হতো, লাজুক প্রেমিকা প্রেমিকাদের মত, এবং একজনের সঙ্গীত হয়তো অন্যজনের সঙ্গীতকে স্পর্শ করতে শুরু করতো। কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে।

হ্যাঁ, অনেক দেরী হয়ে গেছে, আর সাবিনা জানে সে প্যারিসও ছেড়ে যাবে, আবারো অন্য কোথাও তাকে পথ চলতে হবে, কারণ এখানে যদি সে মরে যায় তাহলে তারা তার সমাধি পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হবে। এবং কোনো এক রমণীর মনে যার জন্য কোনো জায়গাই ঘর নয়, পালাবার সব পথের পরিসমাপ্তির ভাবনা তার জন্য অসহনীয়।
(চলবে...)

আপনার মন্তব্য