বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, তৃতীয় পর্ব-১১

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-১০ ১১:২৬:০৩

কাজী মাহবুব হাসান:

১১
ফ্রান্জের সব বন্ধুরাই তার স্ত্রী মারি-ক্লদের কথা জানতো, বড় চশমাসহ মেয়েটার সম্বন্ধেও তারা সবকিছুই জানতো, কিন্তু কেউই সাবিনার কথা জানতো না। ফ্রান্জ ভুল করেছিল যখন ক্যাফের বাইরে দাড়িয়ে সে মনে করেছিল তার স্ত্রী তার বান্ধবীদের সাবিনার বিষয়ে কথা বলেছে। সাবিনা খুব সুন্দরী রমণী, এবং মারি-ক্লদ চায়নি মানুষরা তাদের চেহারা তুলনা করুক।

যেহেতু ফ্রান্জের ধরা পড়ে যাবার ভয় এত বেশী ছিল যে সে কখনোই সাবিনার কোনো চিত্রকর্ম, ড্রইং এমনকি তার কোনো ছবিও চায়নি। পরিণতিতে,  সাবিনা তার জীবন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে কোনো চিহ্ন ছাড়াই। স্পর্শযোগ্য সামান্য কোনো প্রমাণ নেই যা কিনা সে দেখাতে পারে, সে তার জীবনের সবচেয়ে চমৎকার বছরটি সাবিনার সাথে কাটিয়েছিল।

এবং সেটি শুধুমাত্র সাবিনার প্রতি তার বিশ্বস্ত থাকার কামনাটাই বৃদ্ধি করেছিল।

মাঝে মাঝে যখন একসাথে তারা তাদের ফ্ল্যাটে একা থাকতো, মেয়েটি বই থেকে তার চোখ তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দিয়ে ফ্রান্জের দিকে তাকাতো, আর জিজ্ঞাসা করতো, কি নিয়ে ভাবছো?

তার আর্মচেয়ারে বসে, ছাদের দিকে তাকিয়ে, ফ্রান্জ সবসময়ই সম্ভাব্য বিশ্বাসযোগ্য উত্তরও খুঁজে পেতো, কিন্তু আসলেই তখন সে সাবিনার কথা ভাবছে।

যখনই কোনো বিখ্যাত জার্নালে তার কোনো প্রবন্ধ প্রকাশ হতো, মেয়েটাই প্রথম সেটি পড়ে এবং তার সাথে আলোচনা করতো। কিন্তু তখন তার চিন্তা জুড়ে থাকে সাবিনা এটা নিয়ে কি বলতো সেই ভাবনাটি। যে যা কিছু করেছে, সাবিনার জন্য করেছে, যেভাবে সাবিনা কাজটি করা উচিৎ বলে মনে করতো।

অবিশ্বস্ততার এই রূপটি ছিল ক্রটিহীনভাবেই নিষ্পাপ, আর খুব ভালোভাবেই সেটি ফ্রান্জের মানসিকতার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল, যে কখনোই এমন কিছু করবে না যা তার এই চশমা পরা ছাত্রী-প্রেমিকার ক্ষতি করতে পারে। সে সাবিনার প্রতি তার এই অনুরাগ ভালোবাসার চেয়ে বরং ধর্মের মত করেই সে প্রতিপালন করতো।

সত্যি, সেই ধর্মের ধর্মতত্ত্বানুযায়ী, সাবিনাই তার কাছে মেয়েটিকে পাঠিয়েছে। সুতরাং তার পার্থিব আর অপার্থিব ভালোবাসার মধ্যে ক্রটিহীন শান্তি বিরাজমান ছিল। এবং যদিও অপার্থিব ভালোবাসা অবশ্যই (ধর্মতাত্ত্বিক কারণে) ব্যাখ্যার অযোগ্য এবং এটি শক্তিশালী মাত্রার অবোধ্য ও ব্যাখ্যার অযোগ্য বিষয়গুলো ধারণ করে থাকে (আমাদের শুধু ভুল বোঝা শব্দগুলোর কথা স্মরণ করতে হবে, ভুল বোঝাবুঝির সেই দীর্ঘ অভিধান), তার পার্থিব ভালোবাসা দাড়িয়ে আছে সত্যিকারের একটি বোধের উপর।

ছাত্র-প্রেমিকা সাবিনার চেয়ে বয়সে অনেক বেশী তরুণ, তার জীবনের সঙ্গীতের কম্পোজিশন এখনও সুস্পষ্টতা পায়নি, সে ফ্রান্জের কাছে কৃতজ্ঞ সেই সব মোটিফের জন্য যা ফ্রান্জ তাকে দিয়েছিল সেখানে যুক্ত করার জন্য। ফ্রান্জের সেই গ্র্যান্ড মার্চ এখন তারও মতবাদ। তার জন্য সঙ্গীত এখন ডায়োনাইসিয়ান মত্ততা। মাঝে মাঝে তারা একসাথে নাচতে যেত, তারা সত্যে বসবাস করতো এবং এমন কিছু করতো না যা ছিল গোপন। তারা বন্ধু, সহকর্মী, ছাত্র এবং আগন্তুকদের সঙ্গ খুঁজতও এবং তাদের সাথে গান, পান এবং আড্ডা সবই তারা উপভোগ করতো। আল্পসে তারা প্রায়ই বেড়াতে যেত, ফ্রান্জ একটু বাঁকা হতো, মেয়েটি তার পিঠে লাফিয়ে উঠতো, তারা খোলা মাঠে এভাবে দৌড়াতো,, চিৎকার করে দীর্ঘ জার্মান কবিতা আবৃত্তি করতো যা শৈশবে তার মা তাকে শিখিয়েছিল।  উচ্ছল আনন্দে তার ঘাড় ঝোলা মেয়েটি হাসতো, ফ্রান্জের পা, কাঁধ আর ফুসফুসের ক্ষমতায় মুগ্ধ হয়ে।

একটি মাত্র বিষয় মেয়েটি ঠিক বুঝে উঠতে পারতো না, সেটি হলো রুশ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে দখল করা দেশগুলোর প্রতি ফ্রান্জের বিশেষ অদ্ভুত সমবেদনা। আগ্রাসনের বার্ষিকীর দিনে, জেনেভায় একটি চেক গ্রুপের আয়োজিত মিটিং এ তারা যোগ দিয়েছিল।

পুরো ঘর প্রায় খালি। কৃত্রিম ভাবে ঢেউ খেলানো ধুসর চুল ছিল বক্তার। দীর্ঘ একটি বক্তৃতা সে পড়ে শোনায়, এবং অল্প কিছু উৎসাহী দর্শককেও এমনকি অমনোযোগী করে তোলে। তার ফরাসী ভাষা ব্যাকরণগত ভাবে শুদ্ধ এবং সুস্পষ্টভাবে ভিনদেশী বাচনভঙ্গিও ছিল। মাঝে মাঝে, কোনো একটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেবার জন্য, সে তার তর্জনী তুলতো, যেন সে দর্শকদের হুমকি দিচ্ছে।  

চশমা পরা মেয়েটিকে বহু কষ্ট করে তার হাই তোলা ঠেকাতে হয়, যখন তার পাশে বসা ফ্রান্জের মুখে গভীর প্রশান্তির স্মিতহাসি। ফ্রান্জ যত বেশী এই প্রশংসাযোগ্য আকারের তর্জনী সহ ধূসর চুলের সুদর্শন মানুষটাকে দেখে, তত বেশী তাকে তার মনে হয় কোনো গোপন বার্তাবাহকের মত। সে এবং তার দেবীর মধ্যবর্তী কোনো বার্তাবাহী দেবদূত। সে তার চোখ বন্ধ করে এবং স্বপ্ন দেখে। সে তার চোখ বন্ধ করে, ঠিক যেমন করে সে তার চোখ বন্ধ করতো সাবিনার দেহের উপর পনেরোটি ইউরোপীয় এবং একটি আমেরিকার হোটেলে।
(তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত)

আপনার মন্তব্য