বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, চতুর্থ পর্ব: ৪-৫

 প্রকাশিত: ২০১৬-০৫-২৭ ১৫:৩৮:৫৮

কাজী মাহবুব হাসান:


তেরেজা পুরনো শহর চত্বরে সে এসে পৌছায় - টাইন চার্চের* কঠোরভাবে আনুগত্য প্রত্যাশী চুড়া, গথিক এবং বারোক শৈলীতে নির্মিত ঘরগুলো দিয়ে বানানো অনিয়মিত আয়তাকার একটি ক্ষেত্র। পুরনো টাউন হল, যেটি নির্মিত হয়েছে চতুর্দশ শতাব্দীতে, সেটি চত্বরের ‍পুরো একপাশ ধরে বিস্তৃত, যা এখন ধ্বংসের মুখে, প্রায় গত পঁচিশ বছর ধরে এটি এমনই রয়েছে।ওয়ার’স, ড্রেসডেন, কোলোন, বুদাপেস্ট - সব শহরই গত যুদ্ধে তীব্র ক্ষতচিহ্ন বহন করছে। কিন্তু তাদের বাসিন্দারা আবার তাদের গড়ে তুলেছেন, তীব্র পরিশ্রমের সাথে ঐতিহাসিক সব অংশগুলো পুনসংস্কার করেছেন। প্রাহার মানুষরা এই বিষয়ে অন্য শহরগুলোর তুলনায় হীনমন্যতায় আক্রান্ত বলা যেতে পারে।

পুরনো টাউন হলই একটি মাত্র উল্লেখযোগ্য ভবন যা ধ্বংস হয়েছে যুদ্ধে, সুতরাং তারা এটিকে সেই যুদ্ধে ধ্বংস হবার স্মারক হিসাবে সংরক্ষণ করেছেন, যেন কোনো পোল্যাণ্ডবাসী বা জার্মানবাসী তাদের কখনো অভিযুক্ত করতে না পারে, তারা তাদের চেয়ে কম দুর্ভোগের শিকার হয়েছিল। এই মাহাত্মপূর্ণ ধ্বংসাবশেষের সামনে, যুদ্ধে অশুভ পরিণতি সম্বন্ধে বর্তমান আর চিরন্তন সময়ের জন্য স্মারক হিসাবে দাড়িয়ে আছে একটি ইস্পাতের দণ্ড দিয়ে নির্মিত কোনো আন্দোলন বা অন্য কিছু করার জন্য মঞ্চ, যেখানে কমিউনিস্ট পার্টি প্রাগের মানুষদের অতীতে যেমন জড়ো করেছিল ও পরেও জড়ো করবে তাদের গৌষ্টিক প্রবৃত্তি নিশ্চিত করতে।
 
পুরোনো টাউন হলে ধ্বংসাবশেষের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় দৃশ্যটি হঠাৎ করে তেরেজাকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দেয়, নিজের ধ্বংসাবশেষ, কদর্যতা, নিজের দুর্ভোগ, কেটে ফেলা বাহুর অবশিষ্টাংশ অনাবৃত করে সবার সামনে প্রদর্শন এবং সারা পৃথিবীকে সেটি দেখার জন্য বাধ্য  করার সেই বিকৃত প্রয়োজনীয়তা। ইদানীং সবকিছুই তাকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিতে শুরু করেছে। তার মায়ের জগত, যেখান থেকে সে দশ বছর আগেই পালিয়েছিল, মনে হচ্ছে আবার তার কাছে ফিরে এসেছে,  সব দিক থেকেই তাকে ঘিরে ধরেছে। সে কারণেই টমাসকে সেই সকালে তেরেজা বলেছিল কিভাবে তার মা তেরেজার গোপন ডায়রি পড়তো তাদের রাতের খাবারের টেবিলে তার শ্লেষাত্মক হাসি সহ। মদ্যপানের সময় ঘটা ব্যক্তিগত কথোপকথন যখন রেডিওতে সম্প্রচারিত হয়, সারা পৃথিবী একটি ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে’** পরিণত হয়েছে এছাড়া এর আর কি অর্থ হতে পারে?
 
একেবারে প্রায় শৈশব থেকেই, তেরেজা ‘কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প’ শব্দটি ব্যবহার করে এসেছে তার পরিবারের সাথে জীবন কাটানো সে কেমন অনুভব করেছে সেটি বোঝাতে। একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হচ্ছে একটি পৃথিবী যেখানে মানুষ সারাক্ষণই, রাত দিন গায়ে গা লাগিয়ে বসবাস করে। নিষ্ঠুরতা আর সহিংসতা সেখানে গৌণ (এবং কোনোভাবেই অপরিহার্য নয়) একটি বৈশিষ্ট্য মাত্র। একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প হচ্ছে ব্যক্তিগত সব গোপনীয়তার চূড়ান্ত বিনাশ। প্রোশাজকা, যাকে অনুমতি দেয়া হয়নি এমনকি নিজের ব্যক্তিগত ঘরে মদ্যপানের সময় বন্ধুর সাথে আড্ডা মারার জন্য  (তার অজানা ছিল বিষয়টি - আর তার জন্য বিষয়টি না জানা ভয়ানক একটি ভুল!) সে একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বাস করে। তেরেজা যখন তার মায়ের সাথে থাকতো সেও একটি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বাস করতো। শৈশব থেকেই তার জানা ছিল কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প ব্যতিক্রম বা অবাক করে দেবার মত কিছু নয় বরং খুবই মৌলিক কোনো কিছু, একটি পরিস্থিতি যেখানে আমাদের জন্ম হয়, যেখান থেকে কেবল সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা মুক্তি পেতে পারি।


বাষ্পস্নানের সময় রমণীরা তিনটি সারি বাধা বেঞ্চের উপর এত কাছাকাছি বসে আছে যে, তারা পরস্পরের শরীর স্পর্শ করা এড়াতে পারছে না। তেরেজার পাশে বসে ঘামছিল ত্রিশের কাছাকাছি বয়সের খুব সুন্দর মুখের এক রমণী। তার অবিশ্বাস্যকরম বড় আর দুলতে থাকা স্তনটি তার কাঁধ থেকে ঝুলন্ত, সামান্যতম নড়াচড়ায় লাফিয়ে উঠছিল সেগুলো, যখন রমণীটি উঠে দাড়ায়, তেরেজা দেখে তার পেছনটাও দুটো সুবিশাল বস্তার মত, যার সাথে রমণীর সুশ্রী মুখের কোনো মিল নেই।হয়তো
 
হয়তো রমণীটি প্রায়শই আয়নার সামনে দাড়িয়ে তার শরীরটাকে পর্যবেক্ষণ করে, এর ভিতর দিয়ে তার আত্মায় উঁকি দেয় যেমন শৈশব থেকে তেরেজা করে এসেছে। নিশ্চয়ই সেও, তার শরীরকে তার আত্মার পোস্টার হিসাবে ব্যবহার করার জন্য সেই তীব্র আনন্দময় আশা পোষণ করে । কিন্তু কি দানবীয় আকারেরই না সেই আত্মাকে হতে হবে, যদি সেটি এই দেহকে প্রতিফলিত করতে চায়, এই চারটা থলের তাককে।
 
তেরেজা উঠে দাড়ায়, শাওয়ারের নিচে দাড়িয়ে নিজেকে ধুয়ে নেয়। এর পর সে বাইরে বের হয়ে আসে। তখনও হালকা বৃষ্টি হচ্ছে,ভলটাভা নদীর ঠিক উপর শহরের দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখা অল্প কয়েক বর্গফুটের কাঠের দেয়াল দিয়ে ঘেরা একটি পাথরে চাতালে দাড়িয়ে, সে নিচে তাকায় সেই রমণীর মাথাটি দেখার জন্য, যার কথা সে কিছুক্ষণ আগেই ভাবছিল, তাকে বয়ে চলা নদীর পানিতে দ্রুত মাথা ডুবাতে আর উঠাতে দেখে সে।
 
রমণীটি তেরেজার দিকে তাকিয়ে হাসে, চমৎকার নাক তার, বড় বাদামী চোখে শিশুর মত দৃষ্টি। নদী থেকে মই বেয়ে উঠার সময় তার কোমল বৈশিষ্ট্যগুলো রূপান্তরিত হয় চারিদিকে পানি কণা ছিটানো দুজোড়া কম্পমান থলেতে।
 
টিকা:
* চার্চ অব মাদার অব  গড বিফোর টাইন, পুরনো  প্রাগ শহরের সবচেয়ে পরিচিত  চার্চ চতুর্দশ শতক থেকে।
** কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প একধরনের বন্দীশালা, যেখানে সাধারণ বহু মানুষকে সীমিত জায়গার মধ্যে আটকে রাখা হয় কোনো বিচার ছাড়া। শব্দটি বিশেষভাবে ব্যবহৃত হয় যুদ্ধের সশয় শত্রু বা শত্রুভাবা হয় এমন নাগরিকদের বন্দী করার ক্ষেত্রে, যারা কেউ বিচারে শাস্তি প্রাপ্ত কোনো অপরাধী নন।
(চলবে)

আপনার মন্তব্য