‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’: একটি আর্কাইভের নাম

গ্রন্থ আলোচনা

 প্রকাশিত: ২০১৭-০২-১২ ১৬:৩৭:৩৩

 আপডেট: ২০১৭-০২-১৩ ০০:২৯:১৭

আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল:

সম্প্রতি ‘অনিন্দ্য প্রকাশ’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে সামাজিক ও রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে লেখা সাব্বির খানের নিবন্ধ সংকলন ‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’। বইটি সম্পর্কে আমার প্রাথমিক মূল্যায়ন নেতিবাচক এবং তা আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে। এর কারণ খুব সাধারণ হলেও ব্যতিক্রম। এটি লেখকের সদিচ্ছা ও সততা যে তিনি বই বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিতর্কিত বা সমালোচিত হওয়ার মতো কোনও ইস্যু তার বইতে স্থান দেননি। এছাড়া আলোচিত বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে আগ্রহী পাঠকের সংখ্যা বাংলাদেশে খুবই সীমিত।

বইটির লেখক সাব্বির খান শুধুমাত্র একজন সুলেখক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বরই নন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ইতিহাস, মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ ইত্যাদি ইস্যু সম্পর্কে তার রয়েছে গভীর জ্ঞান। বইটিতে লেখক নিজেকে নিরপেক্ষতার যে বলয়ে আবদ্ধ রাখেননি, এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষশক্তির একজন হিসেবে নিজের অবস্থানকে বেশ খোলামেলা ভাবেই উপস্থাপন করেছেন।

বইয়ের প্রতিটি নিবন্ধে নিজের ধারণ করা আদর্শের পক্ষে অকাট্য যুক্তি তুলে ধরেছেন তিনি। ‘বিএনপিকে জামায়াতের অগ্রবর্তী প্রক্সি দল’ হিসেবে উল্লেখ করে যে বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধটি তিনি লিখেছেন, তার সদুত্তর বিএনপির পক্ষে দেয়া সম্ভব হবে না!

এ বইতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখায় বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে যুদ্ধাপরাধী, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, মৌলবাদ ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত। এছাড়াও তিনি তার সর্বজনবিদিত অবস্থানকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে তুলে ধরতে প্রয়াস পেয়েছেন এ বইয়েরই আরো কয়েকটি নিবন্ধে।

রাজনৈতিক অবস্থানকে অগ্রগণ্য না ধরে আদর্শিকভাবে ১৯৭২-এর সংবিধানের পক্ষে এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে ঘৃণ্য ও বর্বর ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে সুস্পষ্টভাবে অভিমত প্রকাশ করেছেন সাব্বির খান। বিভিন্ন প্রসঙ্গের যৌক্তিক দৃষ্টান্ত তুলে ধরে সমালোচনা ও সমালোচনা করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের হোতাদের। প্রাঞ্জল ভাষায় যৌক্তিক তথা সত্যাশ্রয়ী তির্যক সমালোচনা থেকে দেশী ও বিদেশী আলোচিত-সমালোচিত বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তিত্ব থেকে শুরু করে এমনকি বিশ্বখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমসকেও নিস্তার দেননি তার লেখায়, যা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার।

বইটির একটি নিবন্ধে উগ্র ডানপন্থীদের দ্বারা মৌলবাদের উত্থান এবং হেফাজতে ইসলামীর ১৩ দফা অযৌক্তিক দাবির প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে বামপন্থীদের রাজনৈতিক দ্বিধাবিভক্তি ও সীমাবদ্ধতার চুলচেরা বিশ্লেষণও। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার ব্যাপারে লিখতে গিয়ে তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ‘ভোট ব্যাংক’ হিসেবে বিবেচনা না করে এদেশের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করাতে এবং তাদের নিয়ে অপরাজনীতির বন্ধের উপর গুরুত্বারোপ করেছেন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও তার সমীকরণ এবং নিয়ামকগুলো বিবেচনা করে সন্ত্রাসবাদের অপতৎপরতায় আন্তর্জাতিক পৃষ্ঠপোষকতা, বিশ্বের স্বীকৃত জঙ্গিসংগঠন এবং তাদের কর্মকাণ্ড, কৌশল ও ক্রমশ বিস্তারের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে লেখা নিবন্ধগুলোতে গভীর পর্যবেক্ষণ ও অসাধারণ ধীশক্তির পরিচয় প্রতীয়মান হয়েছে।

‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’ সাব্বির খানের প্রথম গ্রন্থ হলেও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক হিসেবে লিখছেন বহু বছর থেকেই। তাই তার লেখার পরিপক্বতা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ গ্রন্থটিতে স্থান পেয়েছে তার নির্বাচিত নিবন্ধগুলো যা বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদ-মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। নিবন্ধ নির্বাচনেও তিনি প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন; যেমন: দেশের সবচেয়ে আলোচিত দুটি ইস্যু- ধর্মীয় রাজনীতি ও ভারত-জুজুর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট লেখাও স্থান পেয়েছে এ সংকলনে।

১৭৫ পৃষ্ঠার এ গ্রন্থটিতে স্থান পাওয়া ৩৫টি নিবন্ধের প্রতিটি নিবন্ধে সাব্বির খানের ক্ষুরধার লেখনীতে অত্যন্ত সাবলীল ভাষায় প্রকাশ পেয়েছে অসাধারণ ও অকাট্য যুক্তি, মানবিক আবেদন, আদর্শিক অবস্থান, ইতিহাস, বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক ঘটনার দৃষ্টান্তসহ দূরদর্শী ও গভীরের চিন্তাচেতনা। তাই যৌক্তিক কারণেই এই ক্ষুদ্র পরিসরে ‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’ গ্রন্থটির আলোচনা বা পর্যালোচনা করা এক প্রকার অসম্ভবই বলা যায়।

এ গ্রন্থের লেখক সাব্বির খানের দু’টি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ না করলে লেখকের প্রতি অবিচার করা হবে এবং গ্রন্থ-পর্যালোচনা কিছুটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

প্রথমত: সাধারণত রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা নিজের নিরপেক্ষতা অটুট রাখতে যেকোনো ইস্যুর সম্ভাব্য প্রেক্ষাপটের পক্ষ-বিপক্ষ উভয় দিকেই ‘ভারসাম্য’ রক্ষার চেষ্টা করেন। কিন্তু সাব্বির খানের বেলায় দেখা যায় ঠিক তার উল্টোটা। তিনি খোলামেলাভাবেই সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কে নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেন এবং পরবর্তীতে তার দূরদর্শিতাই সঠিক বলে প্রতীয়মান হয়।

দ্বিতীয়ত: একজন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষক হিসেবে তিনি কোনো বিষয় বা ইস্যুর উপরে শুধু অভিমত প্রকাশ করেই তাঁর দায়িত্বের সমাপ্তি টানেন না। একই সাথে তিনি তদসংক্রান্ত বিষয়ে করণীয় তথা সমূহ সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায় ছাড়াও বিভিন্ন যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের উপরেও দিক-নির্দেশনামূলক আলোচনা করে থাকেন, যা তাকে সুস্পষ্টভাবেই ভিন্নতা দেয়।

‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’ নিবন্ধের নামে বইটির নামকরণ। এ লেখাটিতে লেখকের মানবিক আবেদন, আবেগ ও সাধারণ জনতার প্রতি গভীর সহমর্মিতা প্রতিটি পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করবে। রাজনৈতিক ধ্বংসযজ্ঞ ও অরাজক পরিস্থিতিতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নির্লিপ্ত ভূমিকাকে সাবলীল ভাষায় তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। এ বইটি যদি ভবিষ্যতে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তাহলে ব্যক্তিগত দায়মুক্তির দায়ে হলেও সুশীল সমাজ জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আগামীতে ইতিবাচক ধারার পক্ষে দাঁড়াতে বাধ্য হবে।

সাব্বির খান বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পাশাপাশি রাজনৈতিক বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারেন। স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ততা, মাঠ পর্যায়ের রাজনীতি ও জনমত সম্পর্কে অবগত থাকার প্রচেষ্টা, বিশ্ব রাজনীতি ও রাজনৈতিক ধারা পর্যবেক্ষণ, সর্বোপরি বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের ব্যক্তিগত আগ্রহ- এসব কিছুর সমন্বয়ের ফলে তার নিবন্ধগুলো পরিণত হয়েছে গবেষণাধর্মী নিবন্ধে। তাই যারা দেশ, রাজনীতি ও আদর্শ সম্পর্কে সচেতন, যারা দেশের নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখেন কিংবা সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকেন, তাদের জন্য গবেষণাধর্মী এবইটি যথেষ্ট গুরুত্ববহন করবে। এছাড়াও প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের যে বইগুলো অবশ্যই পড়া উচিত, এটি সেই তালিকায় স্থান পাওয়ার যোগ্য।

‘পোড়া মৃতদেহের রাজনীতি ও সময়ের গল্প’ বইটিতে অনেক উপাদান রয়েছে যা ‘রেফারেন্স-গ্রন্থ’ হিসেবে গণ্য হবে বলেই আমার বিশ্বাস, যার সুফল ভোগ করবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।

  • আব্দুল্লাহ হারুন জুয়েল: সাবেক ছাত্রনেতা, লেখক ও তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ

আপনার মন্তব্য