স্যারের বউ এবং পাহাড়ি মেয়ে

 প্রকাশিত: ২০১৭-০৫-০৬ ১৪:৩২:১১

আফরিন জাহান হাসি:

নৈতিকতার স্খলন দেখেও –
মানবতার পতন দেখেও-
নির্লজ্জ অলস ভাবে বইছ কেন?
জ্ঞান বিহীন নিরক্ষরের-
খাদ্য বিহীন নাগরিকের
নেতৃ-বিহীনতায় মৌন কেন?
ব্যক্তি যদি ব্যক্তি কেন্দ্রিক,
সমষ্টি যদি, ব্যক্তিত্ব রহিত,
তবে শিথিল সমাজকে ভাঙো না কেন?
সহস্র বরষার-
উন্মাদনার-
মন্ত্র দিয়ে- লক্ষ জনেরে-
সবল সংগ্রামী, আর অগ্রগামী
করে তোলো না কেন?

সুস্মিতার মাথার মধ্যে গানের কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে, আর বুকের ভেতর তোলপাড় চলছে। ও একা বসে আছে পাহাড়ের এক কোণায় বিশাল তেঁতুল গাছের নিচে, সুন্দর করে পার্কের বেঞ্চের মত করা একটি বেঞ্চে। এখান থেকে কর্ণফুলীর বাঁকটা খুব সুন্দর দেখায়। আবার এ কোণা থেকেই ঝুপ করে পাহাড়টি খাড়া নিচে নেমে গেছে, তাই পাহাড়ে ওঠার সিঁড়ি রাস্তা কিছুই চোখে পড়ে না, মনে হয় নদীর পাড়টাই এত উঁচুতে।

অবশ্য উল্টোদিকে ঘুরে বসলেই আঁকাবাঁকা সিঁড়িটা ঠিক সামনে দিয়ে চলে গেছে দেখা যায় আর নদীটা কে অনেক বেশী দূরের মনে হয়। তাই ও চলার পথের উল্টো দিক হয়েই বসে আছে। এর আরও একটা সুবিধা আছে, এক ধাপ উপরে গাছপালা ঘেরা ছোট্ট অফিসটা এদিক থেকে স্পষ্ট দেখা যায়। সবুজ মাঝে মাঝে ঘর থেকে বের হয়ে ওকে দেখে যায়, ওপরে তাকালে দুজনের চোখাচোখি হয়, ওর আর একা লাগে না।

এমনিতে সবুজের তেমন ব্যস্ততা থাকে না, হঠাৎ দু-একদিন রাজ্যের কাজ এসে জড়ো হয়। অনেক রাত পর্যন্ত কাজ করতে হয়। সুস্মিতা অফিসেও বসে থাকতে পারে, কিন্তু বিকেল থেকে সন্ধ্যা ওর প্রকৃতির মাঝে থাকতেই ভালো লাগে। এটা ওর ছেলেবেলার অভ্যাস, ঢাকায় ওদের বাড়ির পেছনেই ছিল বিশাল ঝিল, পুরো বাড়ি জুড়ে ছিল অনেক গাছপালা। সারা বিকেল ও প্রকৃতির মাঝে পায়চারি করতো, কখনো ঝিল পাড়ে বসে থাকতো। কখনো মনোযোগ দিয়ে ঋতুর পরিবর্তন দেখা, কখনো মাথার ভেতর হাজারো চিন্তার দোলাচল- এভাবেই ওর একলা সময় পার হয়ে যায়!

আজ ও গভীরভাবে ভাবছে কিভাবে অন্যায়ের প্রতিকার করা যায়! পেছনে নারী কণ্ঠ শুনে চিন্তায় ছেদ পড়লো ওর, ফিরে দেখলো একজন নারী আর একটি কিশোরী মেয়ে উপরে যাচ্ছে। যদিও এই পাহাড়ে কদাচিৎ অন্য কোন নারী আসে, তবুও ওর অস্থিরতা বেশীক্ষণ এ নিয়ে ভাবতে দিল না, ও আবার আপন ভাবনায় ডুবে গেল।

কিছুক্ষণ পর একজন এসে খবর দিল, নীচের নার্সারির অফিসারের স্ত্রী এসেছেন ওর সাথে দেখা করতে।

এই পাহাড়ের অফিসার এবং তার স্ত্রী নিয়ে অনেকের মাঝে ঔৎসুক্য আছে নানা কারণে। এদের অধিকারে অস্ত্র গোলাবারুদ আছে, এরা সবুজ গাড়িতে ঘুরে বেড়ায়, অস্ত্রহাতে সৈনিক সারাক্ষণ এদের পাহারা দেয়! এত কিছুর সাথে যোগ হয়েছে এই ব্যাটালিয়নের নতুন বাচ্চা অফিসার এবং তার ততোধিক বাচ্চা বউ!

নিচের নার্সারিটা পাহাড় থেকে ছবির মত সুন্দর মনে হয়। একবার সুস্মিতা ঘুরতেও গিয়েছিল, নতুন নতুন জাতের ফলের চাষের পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। ও প্রথম বাদামী রঙের ডাব দেখেছিল ওখানেই। সেই নার্সারির অফিসারের স্ত্রী আর একটি চাকমা কিশোরী মেয়ে এসেছে ওকে দেখতে। যা জানা গেল, এই মেয়েটির খুব ইচ্ছে ওদেরকে দেখার।

নার্সারির খুব কাছেই ওদের বাসা। সেই সূত্রে এই চাকমা পরিবারের সাথে ঐ অফিসারের পরিবারের সখ্য। মেয়েটি নাকি প্রায়ই আবদার করে সুস্মিতাদের সাথে পরিচিত হওয়ার জন্য।

তখন শান্তিচুক্তির দিন তারিখ ঠিক হয়ে গেছে, পাহাড়ে বেশ আলোড়ন এই নিয়ে। তবুও চাকমা কিশোরীটির একা আসতে সাহস হয়নি। মেয়েটি এক রকম বিস্ময় আর চঞ্চলতা নিয়ে সুস্মিতাকে দেখছে। চাকমা আর বাংলা মিলিয়ে কথা বলছে। সাথের নারীটি মনে হয় চাকমা ভাষা বোঝে, সে মাঝে মাঝে দোভাষীর কাজ করছে। মেয়েটিকে মনে হলো একটু হতাশ, স্যারের বউ (এটাই প্রচলিত সম্ভাষণ) এত সাধারণ! গায়ের রং তো বেশ ময়লাই, হুম হাসিটা সুন্দর! ও, আর চুলগুলো সুন্দর!

সে উঠে আসছে, বসছে আর চঞ্চল পায়চারীর সাথে অকপটে এগুলো বলে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে বলে বসলো, স্যার অনেক সুন্দর, বউটা অত না!

সুস্মিতাও অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখছে। অনিন্দ্য রূপসী মেয়েটি। এত সুন্দর মেয়ে ও কমই দেখেছে। ওর মাথার ভেতর বয়ে চলা ভাবনা, আর এই অনিন্দ্য রূপসীর হঠাৎ আবির্ভাব, ও একটু অপ্রস্তুত, তাই এই কিশোরীর এই সব কথাবার্তায় কি বলবে বুঝে উঠছে না। ও শুধু ভাবছে চাকমা, বাঙালি - আমরা সবাই মানুষ, আমাদের চিন্তা ভাবনায় কি কোন পার্থক্য আছে? ওর নতুন বিয়ে, অনেক বাঙালিও ওকে দেখতে এসে এমনই বলেছে।

হঠাৎ সুস্মিতার মনে হলো, এই মেয়েটির সাথে যদি ওর ভাই এর পরিচয় হয়, মেয়েটি কি ওর ভাইকে ভালোবাসতে পারবে? নাকি ভালোবাসা হলেও চাকমা-বাঙালি/সেটেলারদের মধ্যে যে বিদ্বেষ তা ঐ ভালোবাসাকে তিক্ত করে তুলবে। আসলে ওর সৌন্দর্য সুস্মিতাকে লোভী করে তুলেছে, সেই সাথে যোগ হয়েছে ওর এতক্ষণের ভাবনাগুলো।

সুস্মিতা এখানে এসেছে অল্প কদিন। আগে টেলিভিশন বা পত্রিকায় শান্তিচুক্তির আলোচনায় যে অল্প ধারনা ও পেয়েছিল পাহাড়িদের সম্পর্কে, তা থেকে পুরো ভিন্ন ধারণা পেয়েছে সবুজের বক্তব্যে। সবুজ বাঙালি সরকারী অফিসার, কিন্তু ও যখন তারুণ্যের তীব্র আবেগে, ভেজা চোখে পাহাড়ের ইতিহাস নিয়ে কথা বলে- তখন মনে হয় ও যেন এই পাহাড়েরই! সেটেলার নামে পরিচিত বাঙালিদের আগমনের রাজনীতি, পাহাড়িদের হাতে অস্ত্র তুলে নেয়া- এ সবই সুস্মিতার দুর্বল মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দেয়।

কদিন আগেই, কাপ্তাই বাঁধের সংরক্ষিত এলাকায়, একেবারে কাছ থেকে সুইচ গেইট অন করা অবস্থায় বাঁধের পানির ঝর্ণাধারা দেখেছিল সুস্মিতা। ও ভাবছিল নায়াগ্রা কি এর থেকেও সুন্দর! চোখ সরাতে পারছিল না ও। ঐ জলপ্রপাতের তৈরি বাষ্পে ভিজে উঠেছিল ওর শরীর মন।

অচিরেই এই প্রচণ্ড ভালোলাগা বুকভাঙা কষ্টে রূপ নিয়েছিল। যখন সবুজ মনে করিয়ে দিয়েছিল, বাঁধ তৈরির ইতিহাস। কিভাবে পাহাড়ি জনবসতিকে কোন রকম প্রস্তুতির সময় না দিয়েই বাঁধ চালু হয়েছিল, কিভাবে বিস্তীর্ণ জনবসতি পানির নিচে তলিয়ে গিয়েছিল।

কী কষ্ট, কী নিষ্ঠুরতা! উন্নয়নের রাজনীতিতে নাকি সবসময়ই এরকম নিষ্ঠুরতা বিদ্যমান!

এখানে এসে থেকেই এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সুস্মিতা বিমোহিত, সেই সাথে পাহাড়ি নারীর সৌন্দর্য, তাদের পরিশ্রম- সুস্মিতা মুগ্ধ হয়ে দেখে। তখনো শান্তিচুক্তি হয়নি, হাজারো বিধিনিষেধ! একে সরকার পক্ষ তার উপর পোশাকি লোক হওয়ার কারণে অবাধ মেলামেশার সুযোগ নেই। কিন্তু ওর খুব ইচ্ছে করে এই মেয়েটির মতই তাদের কাছে থেকে দেখতে, তাদেরকে বুঝতে। এত বিধি-নিষেধের কারণ আর তার ইতিহাস সুস্মিতার ভেতরটাকে মুচড়ে ভেঙে ফেলে। কি করে এর প্রতিকার সম্ভব!

কী করে রাজনীতির এই নিষ্ঠুরতাকে দূর করা যায়? কেন সুস্মিতা এত দুর্বল হলো? প্রকৃতির মাঝে সুস্মিতা উত্তর খুঁজে বেড়ায়, তাই ভূপেন এর গানের কথাগুলো মাথায় ঘুরছিল। এই গানের কথাগুলো কি এখনো সত্য?

আপনার মন্তব্য