কথা ও সুর

 প্রকাশিত: ২০২০-০২-১২ ০১:২৫:২১

 আপডেট: ২০২০-০২-১২ ০১:৪৬:৪৯

আফরিন জাহান হাসি:

“দেখো তো, আমাদের প্রেমের মাঝে বার বার ঐ ব্যাটা ঢুকে পড়ছে! শুধুই নাক গলায়!”- সবুজের অনুযোগ। সুস্মিতা অবাক চোখে তাকায়- বলে, কে?

“ঐ যে বুড়োটা, ওই তো সব বলে গেছে! চিঠিতে, কথায় যাই তোমাকে বলতে চাই, সবই সে বলে গেছে। তাই তো বার বার সব কিছুতে সে ঢুকে পড়ে!”

প্রথম দিকে সবুজের এই হেঁয়ালিতে সুস্মিতা ভড়কে গিয়েছিল। এ আবার কে, কীভাবে সে সব কিছুতে চলে আসে! তারপর সবুজ ব্যাখ্যা করলো যে এই ব্যাটা হচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, হেন জিনিষ নেই যা নিয়ে তিনি লিখেননি! আর সবুজের তো তাকে কোট করা চাইই চাই! কী করবে, কোন ছোটবেলায় ওর বাবা ওকে পরম যত্নে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন তার সাথে। সেই থেকে সবুজ তার আবেগ প্রকাশে সাহায্য নেয় উনার লেখার, কবিতা আর গানের।

সুস্মিতারও শৈশব গেড়ে উঠেছে বিচিত্র গানের সমাহারে, বড় ভাই বোনেরা রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল গীতি, ব্যান্ড সংগীত, রেডিওর অনুরোধের আসর- কত রকম গানই না শুনতো! তারপর বহুদিন কেটে গেছে! সুস্মিতা মুগ্ধ হয়েছে বার বার। কী অদ্ভুত! এমন করে মানুষ বলতে পারে! এমন করে লিখে বোঝাতে পারে! এ যেন আমার মনের কথায় বলে দিচ্ছে! আমার একাকিত্ব! আমার ভালোলাগা, ভালোবাসা, অভাব, অনুযোগ! আনন্দ, চাওয়া- সবই তো!

কত কত গীতিকার, সুরকার কী অসাধারণ ভাবে আমাদের সবার মনের কথা বলে গেছেন, যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে একাকিত্ব আমাকে কুড়ে খায় কিংবা দুশ্চিন্তা অস্থির করে তোলে, অসহায় হয়ে আশ্রয় খুঁজি। নানা ধরনের গান আর সুরের মূর্ছনা আমাকে সেই আশ্রয় দেয়। আমার কথোপকথন চলে শিল্পী, গীতিকার আর ইন্সট্রুমেন্ট এর শব্দের সঙ্গে। আমার প্রশ্নের উত্তর মেলে সেসব গানের কথায়।

একই গানের কত রকম অর্থ করা যায়, যে যেভাবে ভাবতে চায়। আদতে মানুষ তো তার নিজের চিন্তাকেই খুঁজে পায় সবকিছুতে। যেমন অর্ধেক পানি রাখা গ্লাসকে, কেউ বলে অর্ধেক ভরা, কেউ বলে অর্ধেক খালি! তেমনি যখন যেমন মনের অবস্থা সেভাবেই গানের শব্দ কথা বলে চলে। কিংবা ইতিহাস থেকে খুঁজে পাওয়া যায় লেখক কেন, কোন অবস্থায় এ কথা লিখেছিলেন।

বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো
সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও॥

এ গানের কথায় আমি খুঁজে পাই, মানুষের অভিন্নতার কথা, মানুষে মানুষে একাত্মতার কথা। মনের ভেতর বয়ে চলে মানুষের সুখ দুঃখ আসলে অভিন্ন, সারা পৃথিবীর সবাই আসলে মানুষ হিসেবে একজন আর একজনের সাথে মিশতে চায়, একই আনন্দে মিলিত হতে চায়। কোন কোন গানের মাঝের কিছু কথা আপ্লুত করে-

বসিয়া আছ কেন আপন-মনে,
স্বার্থনিমগন কী কারণে?
চারি দিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি,
ক্ষুদ্র দুঃখ সব তুচ্ছ মানি
প্রেম ভরিয়া লহো শূন্য জীবনে ॥

কিংবা যখন শুনি-
সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।

মনে হয় এ গান আমাকে সাহস যোগাবে, শক্তি দেবে হৃদয়ের দুর্বলতাকে অতিক্রম করতে। বুকের ভেতর ঢেউ ওঠে, চেষ্টা করলে হয়ত আমিও পারবো, না পারা সব কিছুকে জয় করতে।

হাসন রাজা, লালন শাহ এর গান মানব চরিত্র বুঝতে সাহায্য করে, মানব জীবনের কত সংশয় কত সুন্দর করে প্রকাশ করেছেন তারা তাদের গানে। মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা কি আসলে নিজেদেরকে অন্যের মাঝে খুঁজি না! কিংবা খুব ইচ্ছে হয় না অপর একটা মানুষকে বুঝতে! হাসন রাজার এই গানে আসলে কিসের কথা বলেছেন তিনি!-

রূপ দেখিলাম রে নয়নে, আপনার রূপ দেখিলাম রে
আমার মাঝদো বাহির হইয়া, দেখা দিলো আমারে।
কখনো লালন এর মত একই ভাবে জানতে ইচ্ছে করে,
এমন সমাজ কবে গো সৃজন হবে।
যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান
জাতি গোত্র নাহি রবে।।

ভাবনার খোরাক যোগায় শাহ আব্দুল করিম এর গানের আকুল জিজ্ঞাসা

মুর্শিদ ধন হে, কেমনে চিনিব তোমারে?
দেখা দাওনা কাছে নেও না আর কতো থাকি দূরে?
কেমনে চিনিব তোমারে?

ভূপেন হাজারিকার গানের কথা হৃদয়ে আলোড়ন তোলে, দুঃখ ভুলে পাই মানুষের জন্য কাজ করার অনুপ্রেরণা। আহা আমি যদি পারতাম এভাবে বলতে, লিখতে!

আর ফুল নয়, আর মালা নয়,
নয় ফাগুনের কোন কাব্য,
মধুরাত নয়, মায়া চাঁদ নয়,
মানুষের কথা ভাববো শুধু মানুষের কথা ভাববো।

কখনো কখনো ভিন্ন আবেশ আনে হিন্দি গান, উর্দু গান। ইংলিশ গানের কথায় খুঁজে পাই সেই একই কল্পনার রাজ্য অথবা এগিয়ে যাবার আত্মপ্রত্যয়।

I have a dream. You are there.
High above the clouds somewhere.
Rain is falling from the skies,
but it never touches you;
you're way up high!

অথবা এই গান-

Seems like I've spent my whole life hoping
Dreaming of things I've never tried
Tangled in knots just waiting for my time to shine

মন যখন পরিচিত আলো বাতাস, কাঁদা মাটির জন্য আকুল হয় তখন একই সান্ত্বনা আনে -

Country roads, take me home
To the place I belong

অথবা

সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য
অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য।
আমার দু’চোখ ভরা স্বপ্ন
ও দেশ তোমারই জন্য।।

বেশিরভাগ সময় গানের কথা আমাকে সাহস যোগায়, সান্ত্বনা দেয়। কিছু কিছু গানের কথার থেকে সুর আর বাদ্যযন্ত্রের শব্দ অনেক বেশি প্রভাব ফেলে, যেমন

মন হাওয়ায় পেয়েছি তোর নাম,
মন হাওয়ায় হারিয়ে ফেললাম।

বাংলা লোকগীতি বা পুরোনো বাংলা গান বুকের ভেতর জমে থাকা কষ্ট কে চোখের জলে ভাসিয়ে দিয়ে স্থিরতা আনে। প্রেমের গান স্নিগ্ধতার আবেশ আনে। মনে পরে সুমন এর অভিবাদন গানটি-

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা…প্রিয়তমা
ভয় নেই এমন দিন এনে দেব
দেখ সেনাবাহিনী বন্দুক নয়, শুধু গোলাপের তোড়া হাতে
কুচকাওয়াজ করবে তোমার সামনে,
শুধু তোমাকেই তোমাকেই স্যালুট করবে তারা দিনরাত।।

একটা সময় এই গান এমন আচ্ছন্ন করে রাখতো, কল্পনায় দেখতাম সত্যি সত্যি সবুজ ঠিক ঐভাবে গোলাপের তোড়া হাতে এই গান গাইছে! হৃদয় ভালোবাসায় গুন গুন করতো-

গুন গুন গুন কুঞ্জে আমার একি গুঞ্জরন
গানের সুরে পেলাম এ কার প্রাণের নিমন্ত্রণ
হতাশ সময়ে নচিকেতার স্বপ্ন গান শুনে আশার বানী পেতো মন।
যখন সময় থমকে দাঁড়ায়
নিরাশার পাখি দু’হাত বাড়ায়
খুঁজে নিয়ে মন নির্জন কোন
কি আর করে তখন
স্বপ্ন স্বপ্ন স্বপ্ন
স্বপ্ন দেখে মন।।

আর বাঁশির সুর, সে তো অনবদ্য! দারুণ সব কথার সাথে যদি অসাধারণ বাঁশির মিশ্রণ থাকে তাহলে যে কোন কাজই একাগ্রচিত্তে করা যায়। গান আর সুরের কথা বলে শেষ করা যাবে না। এমন কি কেউ আছে যে আপনমনে সুখে অথবা দুঃখে গুন গুন করেনি কখনো!

উন্নত বিশ্বে সমস্ত স্কুলে, প্রতিটি ক্লাসে মিউজিক ক্লাস থাকে। প্রাথমিক লেভেল পর্যন্ত আবশ্যিক তা। গান আর বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সুরের ছোঁয়ায় বাচ্চারা আবিল হয়ে থাকে। কারণ হচ্ছে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশে মিউজিক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত তাদের কাছে। হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুল এর পাবলিকেশন এ, ইউনিভার্সিটি অব সেন্ট্রাল ফ্লোরিডার পাবলিকেশন এ মানুষের মস্তিষ্কের উপর মিউজিকের প্রভাব নিয়ে বিশদ গবেষণার তথ্য উপাত্ত আছে। এসব প্রকাশনায় বলা আছে, মিউজিক হচ্ছে মানব প্রজাতির বেসিক বৈশিষ্ট্য । সুপ্রাচীন সময় থেকে সমস্ত কালচারের মানুষের মধ্যেই এর উপস্থিতি দেখা যায়। মানব মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের গঠন থেকেও দেখা যায় যে এর জটিল বিন্যাস বিভিন্ন শব্দের মধ্য থেকে ছন্দ খুঁজে নেয়া বা আদতে মিউজিক এ সাড়া দেয়ার মত করেই তৈরি। মিউজিক মানুষের মস্তিষ্কের উচ্চপর্যায়ের ব্যবহার যেমন জ্ঞান চর্চা, অংক করা, ভাষা শিক্ষা, সমস্যার সমাধান, স্মৃতিশক্তি ও চিন্তার বিকাশে সাহায্য করে। বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে মানুষের স্বাস্থ্য এবং নানা পারদর্শিতায় মিউজিক এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। যারা নিয়মিত মিউজিক শোনে বা কোন বাদ্যযন্ত্র বাজায় তাদের আই কিউ লেভেল বেশি।দ্রুত মানসিক চাপ কমায় মিউজিক। স্ট্রোক এর রোগী, হার্ট এর রোগী, পারকিনসন্স বা আলঝাইমার কিংবা ব্রেইন ড্যামেজের রোগীর ক্ষেত্রে ওষুধের পাশাপাশি মিউজিক এর ব্যবহার অগ্রগতির প্রমাণ রেখেছে, বিভিন্ন অপারেশন এর সময়ও রোগী এবং ডাক্তারের ব্লাড প্রেসার লেবেল নিয়ন্ত্রণের প্রমাণ পাওয়া গেছে।

কথা আর সুরে বিভোর সুস্মিতা ভাবে- গান নিঃসঙ্গতাকে ভরিয়ে তোলে ভালোবাসায়, যোগাযোগ ঘটে অন্য মানুষের ভাবনা চিন্তার সাথে, ভালো লাগা-ভালোবাসার সাথে। মানুষে মানুষে সেতু বন্ধন ঘটে গানে গানে, মনে আনে শান্তি, শরীরে প্রশান্তি। যদি গাইতে পারতাম!

আপনার মন্তব্য