না-বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে

 প্রকাশিত: ২০২০-০৫-০৯ ২১:৪৪:৫৯

আফরিন জাহান হাসি:

“আরে আকাশ তুমি! কোথায় ছিলে এতদিন!”

“আকাশ এসেছে, আকাশ এসেছে, আকাশ ভাই এসেছে!” বেশ একটা সাড়া পড়ে গেছে পুরো বাড়িতে। প্রায় ছয় মাস ধরে আকাশ লাপাত্তা, ওর বন্ধুও জানেনা কিছু, যেখানে প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আকাশ আসে এ বাড়িতে সেখানে এই ছয় মাসে ওর কোন খবরই নেই, এমনকি একটা চিঠিও না! এর মধ্যে সবাই বিটিভির সেই বিজ্ঞাপনটাও দেখে ফেলেছে ! যে বিজ্ঞাপনের মডেলকে দেখে ওদের সবাই দ্বিধায় ভুগছে, এটা কি আকাশ! তাই প্রথমেই আকাশকে উত্তর দিতে হলো মডেলিংয়ের জন্যই সে ব্যস্ত কি না যে কোন যোগাযোগের সময়ও পায়নি। শুনে তো আকাশ একেবারে আকাশ থেকে পড়লো! “আমি তো কোথাও মডেল হইনি!”

বিজ্ঞাপন

“ও, ওটা তাহলে কে? তোমার কী হয়েছিল?”

অবশেষে জানা গেল, পারিবারিক সমস্যায় আকাশ দীর্ঘদিন ঢাকায় আসতে পারেনি। তখনো মোবাইল ফোনের যুগ শুরু হয়নি, সবার বাড়িতেও ফোন নেই। নানা ঝামেলায় আকাশ চিঠি লেখারও ফুসরত পায়নি। এ বাড়িতে আকাশের আগমন প্রায় তিন বছর ধরে, সে মেসে থেকে পড়াশুনা করতো, সে আমার ভাই এর বন্ধু। পুরো পরিবারের সাথেই তার দারুণ সম্পর্ক! নিজের পরিবার থেকে দূরে থাকা একাকী এই ছেলে কখন যে এ বাড়ির একজন হয়ে উঠেছে সে আর এখন কারোরই মনে নেই। বাংলাদেশের একপ্রান্তে তার বাড়ি, যোগাযোগ অত সহজ নয়, তাই প্রায়ই সে বন্ধুর বাড়িতে এক দুদিন থেকেও যায়। তার চমৎকার ব্যবহার, অসাধারণ ব্যক্তিত্বের জন্য সে সবার কাছে সমাদৃত।

সাধারণত যেরকম দেখা যায়, বন্ধুর বোনের সাথে একটা প্রেমের সম্পর্ক তৈরি হওয়া, এক্ষেত্রে সেরকম কোন কিছুর লক্ষণও দেখা যায়নি। আমার প্রতি তার আলাদা কোন মনোযোগ কখনোই প্রকাশ পায়নি। সবার সাথে একসাথে যেটুকু কথাবার্তা সেখানে কোন জড়তাও নেই। তবে আকাশ বেশিরভাগ সময় সৌজন্য সাক্ষাত সেরেই ওর বন্ধুর ঘরে ঢুকে যায়, সেখানেই পুরো সময় পার করে, হয়ত খাবার টেবিলে আবার কথা হয়। এমনিতে সে খুবই হাসিখুশি, কিন্তু কথা বলায় কেমন যেন একটা গাম্ভীর্যও আছে, তার ব্যক্তিত্বের কারণেই হয়ত একটা সমীহ চলে আসে।

আমি তখন সদ্য তারুণ্যে পা ফেলা, তারুণ্যের স্বাভাবিক লাবণ্য আর চপলতায় পরিপূর্ণ। কেউ কেউ প্রেম নিবেদন করেছে, কেউ নানা ইঙ্গিতে বোঝাবার চেষ্টা করেছে তাদের ভালো লাগার কথা। অনেকটাই বুঝি কে কি চোখে আমাকে দেখছে! আকাশ ভাই এমন কোন কিছুই করেনি। সব কিছু মিলিয়ে এই অতি সুদর্শন ছেলেটিকে আমি শ্রদ্ধা করি। একদিন দুপুরবেলা অনেকে মিলে বেশ হট্টগোল করে আম ভর্তা খাওয়ার পর, উনি আমাকে ডেকে বলল, “তোমার সাথে আমার একটু কথা আছে, শুনে যেও।”

আমার বুকের ভেতর তখন হাতুড়ি পেটার শব্দ! কী বলবে উনি! আমি কী উত্তর দিবো! এরকম ভাবতে ভাবতে গেলাম উনার কাছে। উনি তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যকে আরও যেন বাড়িয়ে নিলেন গভীর চোখে তাকিয়ে! আমাকে বসতে বলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে যে কথাগুলো বললেন তা এরকম, “আমি মনে করি বন্ধুর ছোট বোন হিসেবে তোমার প্রতি আমার একটা দায়িত্ব আছে, সে দায়িত্ববোধ থেকে তোমাকে কথাগুলো বলছি, মনোযোগ দিয়ে শোন, হয়ত তোমার উপকার হবে। তুমি বড় হয়েছো, এখন অনেকেই তোমার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করবে ,কিন্তু তুমি বুঝে শুনে ডিসিশন নিও। সঠিক জীবন সঙ্গী নির্বাচন করলে সারাজীবন সুখে থাকবে। হুট করে কোন ইমোশনাল ডিসিশন নিও না। আজকে ঐ ছেলেটি তোমার দিকে যে চোখে তাকিয়ে ছিল, তুমি তার কিছুই খেয়াল করোনি, তার উদ্দেশ্য ভালো মনে হয়নি আমার, তুমি ওর থেকে অনেক ভালো ছেলে পাবে। সুন্দর চেহেরা মানেই ভালো মানুষ নয়। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা কর, এদের কোন কথায় প্রভাবিত হইয়ো না প্লিজ।”

বিজ্ঞাপন

আমি শান্তভাবে জি ভাইয়া বলে চলে আসলাম। উনি জানতেও চেয়েছিলেন আমি অলরেডি কাউকে পছন্দ করি কিনা! ঘটনা হচ্ছে আরও কয়েকজন ছিল সেই আম ভর্তা খাওয়ার সময়, তাদেরই একজন বেশ সুপুরুষ, যাকে নিয়ে উনার এই চিন্তা! এর পরপরই উনি ব্যস্ত হয়ে পরেছিলেন, ঢাকাতেই কম আসতেন, আমাদের এখানেও। শুনেছিলাম বাবার ব্যবসার দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তাই সময় করতে পারছেন না।

এর বছর খানেক পর আমার বিয়ে ঠিক হলো। বিয়ের দিন কনের স্টেজে বসে আছি, বড় ভাবি এসে একটা কানের দুল দিয়ে বলল, “এটা পরতো একটু, আকাশ দেখবে।” পেছনে দেখি আকাশ ভাই আর একজন অপরিচিত, যিনি আকাশ ভাইকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন, যেন তার দাঁড়াতে কষ্ট হচ্ছে! আমি লাজুক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ সেই কানের দুল পরে থাকলাম। আকাশ ভাই কেমন অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে ছিল, চোখগুলো লাল! ভাবির কাছ থেকে শুনেছিলাম, উনি কারও সাথে কথা বলেনি এমনকি খায়ওনি, ড্রেসিং রুমে বসে হাউমাউ করে কেঁদেছে! সাথের লোকটি ভাবিকে অনুরোধ করছিল কানের দুলটা আমাকে পরতে বলার জন্য এবং তার পরপরই উনারা ওখান থেকে চলে যান।

বিয়ের অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায় বিষয়টা তেমন কেউ খেয়ালই করেনি। আজও রহস্য কেন সে ওভাবে কেঁদেছিল,কেন কিছু না বলে চলে গেল! সে কি বন্ধুর ছোট বোনের প্রতি দায়িত্বপূর্ণ ভালোবাসায় না কি অন্য কিছু!

আপনার মন্তব্য