দুঃস্বপ্ন দূরীভূত

 প্রকাশিত: ২০১৮-০১-২০ ২১:৪৮:৫৭

আফরিন জাহান হাসি:

অস্ত্র, গোলাবারুদ আর সৈন্যদল নিয়ে রাহাত তৈরি। ভেতরটা জ্বলে যাচ্ছে, সেই আগুনে সব কিছু পুড়িয়ে ফেলতে ইচ্ছা করছে। রেবা, আমি আসছি; আসছি রেবা- এই এক বাক্যের তুফান চলছে মনের ভেতর।
    
আমিন সাহেব হতবিহবল, তিনিই এই ব্যাটালিয়নের কমান্ডিং অফিসার। তার নির্দেশ ছাড়া কিছুই সম্ভব না। রাহাত তার জুনিয়র, আমিন সাহেবের অনুপস্থিতিতে রাহাত দায়িত্ব নেয়। এত সৈনিক, রাহাত - এদের সবার জীবন বিপন্ন হবে তার নিজের মেয়েকে উদ্ধার করতে যেয়ে। তিনি কিছুই ভাবতে পারছেন না।

কারা ধরে নিয়ে গেল মেয়েটিকে? কজন ছেলে কলেজে যাওয়ার পথে রেবাকে বিরক্ত করতো,তারা? নাকি পাহাড়ি অস্ত্রধারীরা?

তখনো শান্তি চুক্তি হয়নি,পাহাড়ে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বেই তিনি নিয়োজিত। অন্য কারো মেয়ে হলেও তো তিনি এই অপারেশনের অর্ডার দিতেন। কাকে পাঠাতেন? রাহাতকে কি?

রাহাত অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে, মনে মনে বলে এই বুড়োটা এত কি ভাবছে! মুখে বলে, “আমরা দেরি করে ফেলছি, এতক্ষণে কী হচ্ছে কে জানে, আমি চললাম।”

সুস্মিতা নিঃশ্বাস বন্ধ করে শুনছিল। রাহাতকে সে ভালো করেই চেনে, শান্ত, ধীর স্থির, চমৎকার অফিসার। অবশ্য এরকম বিশেষ পরিস্থিতিতে তো সে তাকে দেখেনি। সুস্মিতাও অস্থির হয়, থামলে কেন, তারপর?

সবুজ বলে, আগে ওদের প্রেমের গল্প শোন, বাকীটা পরে শুনো। রাহাত যখন জয়েন করে, তরুণ অফিসার, তখনো ছাত্রাবস্থার চিহ্ন মুছে যায়নি, কিছুটা উড়ুউড়ু মন। আর রেবা তখন স্থানীয় কলেজে ডিগ্রি পড়ে, বাবা-মায়ের সাথে এই পাহাড়েই থাকে। ঠিক যেন পাহাড়ি ঝর্ণা। ব্যাটালিয়নের নির্দিষ্ট গণ্ডির মাঝে তাকে আটকে রাখা কঠিন। লম্বা, ছিপছিপে সুন্দরী তরুণী, ঝলমলিয়ে ঘুরে বেড়ায় পাহাড় জুড়ে। তার মিষ্টি ব্যবহার আর প্রাণোচ্ছলতা মুগ্ধ করে সবাইকে। আর রাহাতও কম যায়না, সদ্য মিলিটারি ট্রেনিং নেওয়া সুঠাম দেহি, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের মানুষ। রূপসী পাহাড়ের রূপ-লাবণ্যে ভরপুর পরিবেশে দুজন দুজনকে আকর্ষণ করে তীব্রভাবে। কখন যে ভালোবাসায় বিলীন হয়, নিজেরাই টের পায়না তারা।

কিন্তু কে, কারা, কীভাবে ধরে নিয়ে গেল রেবাকে? সুস্মিতা অবাক হয়, রেবার সাথে গার্ড ছিল না?

ছিল দুজন, অস্ত্রও ছিল। রেবা স্থানীয় বাজারে শপিংয়ে বা ঘুরতে বের হয়েছিল, সবুজ বলে। বললামই তো ও চঞ্চলা হরিণীর মত, ওকে আটকে রাখা কঠিন। এর মধ্যেই আট-দশ জন যুবক হবে,  যারা ওকে তুলে নিয়ে যায়। তারপর রাহাত সম্মুখ যুদ্ধে জয় করে আনে রেবাকে। কেউ মারা যায়নি, কিন্তু আহত হয়েছিল অনেকেই। এরপর যা হয়, চারিদিকে নানা রটনা। অনেকেই তাকে দেখতে আসতে চায়, কৌতূহল! এই অযাচিত কৌতূহল দুর্বিষহ করে তোলে রেবার জীবন, ওর কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়।  রেবা কেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়।

আমি যখন জয়েন করি এখানে তখন অনেকেই স্বপ্রণোদিত হয়ে এই গল্প শোনাতে এসেছে আমাকে। জানো আমার একটুও আলাদা কৌতূহল হয়নি, খুব ডিটেইলস আর জানতে। আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে দেখেছি ওদের দুজনকে।     
                               
এ ঘটনার পরপরই রাহাত বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যায় আমিন সাহেবের কাছে। আমিন সাহেবের বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল। কিন্তু রেবা বেঁকে বসে, ও কিছুতেই ওর এই জীবনের সাথে রাহাতকে জড়াতে চায় না। রেবা আসলে তখনো ট্রমার মধ্যে ছিল, তাছাড়া ঐ সময় মানসিক সাপোর্ট, কাউন্সিলিং- এগুলো বিষয় কম লোকই জানতো। রাহাতের ভালোবাসা একাই সব ভূমিকা নিয়ে নেয়। রাহাত রেবাকে রাজি করায়, একটু একটু করে ভালোবাসা দিয়ে সারিয়ে তোলে তাকে। আর যে কাজটি রাহাত খুব অসাধারণভাবে করে তা হলো, এ ঘটনাকে সে একেবারেই একটা দুর্ঘটনা আর আইনি বিষয় করে তোলে। অপরাধীর শাস্তি যেন হয় সে চেষ্টা করে। কিন্তু রটনাগুলোর প্রতি সবাইকে এমন নিঃস্পৃহ থাকতে বলে যেন তা দুঃস্বপ্নের মত মিলিয়ে যায়। আর তাই ধীরে ধীরে এই নিয়ে আলোচনাও কমে আসতে থাকে।

সবুজ দম নেয়, তুমি তো এখন বেশ কদিন ওদের কাছাকাছি থাকবে, তোমাকে অনুরোধ করবো যদি এই প্রসঙ্গ আসে, অযথা কৌতূহল দেখিয়ে দুঃস্বপ্নকে জাগিয়ে তুলো না।

এরপর সে সময় আসে, সুস্মিতার সাথে রেবার দারুণ বন্ধুত্ব হয়। একপর্যায়ে রেবা বলে, ওর জীবনে একটা দুর্ঘটনা ছিল। একটু যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে রেবা। দ্রুতই তা মিলিয়ে যায়। রাহাতের প্রশংসা আর খুনসুটি নিয়ে আলাপে মেতে ওঠে রেবা। সুস্মিতাও আর ঘাটায় না বিষয়টা। তার থেকে ওদের দুজনের এই বর্তমান, অনেক সুন্দর, অনেক পজিটিভ। রাহাত আর রেবার ভালবাসার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয় সুস্মিতা। সবুজের উক্তি মনে পড়ে, “দুর্ঘটনাকে নিত্য বয়ে বেড়ালে তা বোঝা হয়েই থাকবে, এর চেয়ে নিছক দুঃস্বপ্ন ভেবে তা দূরীভূত করতে পারলে, জীবন সুন্দরের দিকে আগাবে। নতুন স্বপ্ন নিয়ে উদিত হবে নতুন ভোর”।

আপনার মন্তব্য