কথোপকথন

 প্রকাশিত: ২০১৮-০২-২৪ ১৫:৫৭:১১

আফরিন জাহান হাসি:

পাহাড়ের ঘন ঘাসের উপর কম্বল দিয়ে বিছানা বানিয়ে পাতলা চাঁদর গায়ে শুয়ে আছি। শীতের কড়া রোদ জড়িয়ে আছ আমায়। আদুরে রোদের ওম পেয়ে ঘুমে দুচোখ জুড়ে আসছে। এর মাঝেই শুনতে পেলাম ক্রন্দসী যেন কথা বলছে আমার সঙ্গে, “সুস্মিতা তুইও বুঝছিস না, আমার যে সাহস হয় না, আমি বড় ভীতু রে।”

ক্রন্দসী আমার প্রাণের বন্ধু, যেন দুই দেহে এক প্রাণ। অথচ আমাদের জীবনাচরণে কত ব্যবধান!

আমি ওকে সান্ত্বনা দেই, সাহস করার চেষ্টা তো করতে হবে। মানুষই একমাত্র প্রাণি যে নিজেকে বদলাতে পারে।
 
ক্রন্দসীর গলায় অভিমান, আমি আবার মানুষকে অনেক ভালোবাসি, পাছে কেউ কষ্ট পায় আমার ব্যবহারে, একটুও তা চাইনা। সেটাকেও অনেকে আমার দুর্বলতা ভেবে বসে, ভাবে নরম মানুষ, কিছুই বলবে না, ইচ্ছে করে খারাপ ব্যবহারের সুযোগ নেয়। মানুষ কেন এমন! কেন বোঝে না যে অপেক্ষাকৃত নরম পেলেই অত্যাচার করতে হয় না! তাছাড়া পরিবেশও লাগেরে।

আমার কোন সাপোর্ট নেই। আমি কোন কিছুর প্রতিবাদ করলে সবাই মিলে এমন করে তেড়ে আসবে, এমন বিশ্রী অবস্থা হবে- সেটা সহ্য করতে পারবো না। এমনিতেই ওদের অভিযোগ শুনলে বোবা হয়ে যাই।

হ্যাঁ পরিবেশ! এটা তুই কিছুটা ঠিকই বলেছিস। তোর আত্মবিশ্বাস যে কী পরিমাণ কমে গেছে তা তুই নিজেও বুঝছিস না। ধরতে গেলে, বাচ্চা বয়সে ওরকম একটা বড় সংসারে তুই বিবাহিত জীবন শুরু করেছিলি। তোর বর তো শিক্ষিত জ্ঞানী মানুষ, সেও বুঝলো না! এরকম সারাক্ষণ সমালোচনার মধ্যে থাকলে, সারাক্ষণ ভয়ে থাকলে যে কখন দোষ হয়, এর ফলাফল কি হতে পারে! নিজের প্রতিও তুই বিশ্বাস হারিয়েছিস। অথচ কত প্রতিভা ছিল তোর। তাই আমি বলি চর্চা করলে, একটু সাহস, একটু ভালোবাসা পেলে তুই আবার সেই সব ফিরে পাবি। ফিরে পাবি তোর আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস। দীর্ঘদিনের অযত্নে যা হারিয়েছিস তা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব।

কোথায় পাবো সেই সাহস, সেই ভালোবাসা! আমি ক্রন্দসী, কেঁদেই আমার জীবন শেষ হবে। আমারই যোগ্যতা নেই কোন কিছু অর্জন করার, করো মন জয় করার। শিখিনি রে, আমি জানি না। নিজের জন্য আমার আর কিছু করতে ইচ্ছেও হয় না। তাই বলি, সুস্মিতা তুইও এখন আর আমাকে বুঝিস না।

আমি তোকে ঠিকই বুঝি, তুই আমার কথা শুনতে চাচ্ছিস না। ইংরেজিতে সেলফ-এসটিম  বলে একটা শব্দ আছে, বাংলায় একে আত্মবিশ্বাসই বলতে পারিস। নানা কারণে মানুষের মাঝে এর কম বেশী হতে পারে। যেমন তীব্র অবহেলায় তোর আত্মবিশ্বাস একেবারেই হারিয়ে গেছে। ইতিবাচক পরিবেশ, প্রশংসা, একটু গুরুত্ব -এসব পেলে, ইতিবাচক চিন্তা ভাবনা করলে এ আবার ফিরে পাওয়া সম্ভব। তোর চারপাশ থেকে যখন তুই তা পাচ্ছিস না, আমরা যারা তোকে ভালোবাসি তাদের কথা শোন। নিজেকেও একটু করে ভালবাসতে শুরু কর, নিজের প্রতি বিশ্বাস বাড়ানোর চর্চা কর। দেখবি একদিন তুইও অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবি, দেখবি তুই ও পারিস সবকিছু। যেটুকু যা তোর ভাল, ভালো সময়, ভালো চিন্তা, আমাদের ভালোবাসা, সেসব কথাই বেশী করে ভাববি সবসময়। নোংরা অপবাদ, অভিযোগ, এগুলো মাথা থেকে একেবারেই ঝেড়ে ফেল। চেষ্টা করতে থাক। ধীরে ধীরে, একটু একটু করে।

আমি বুঝি ক্রন্দসী, কী তীব্র অবহেলায় আজ তুই নিজের জন্যও কিছু চাইতে ভুলে গেছিস। অন্তত আমি তো তোর দুঃখ বোঝার চেষ্টা করছি। কত কত অসহায় আছে যাদের দুঃখ শোনারও কেউ নেই। কেউ কখনো বলেনি, অনাদরে হারিয়ে যাচ্ছো। বিরূপ, দুঃসহ পরিবেশকেই স্বাভাবিক নিয়তি বলে জীবন পার করে দিয়েছে। একবার চেষ্টা করে দেখনা, তোর ভেতরের সৌন্দর্য আর ভালোবাসা দিয়ে ঐ পরিবেশকে তুই বদলাতে পারিস কিনা। নিজেকে ভালবাস, সেই সাথে অন্যকেও ভালোবাসতে শেখা। কাঁদিস না, লক্ষ্মী মেয়ে কাঁদিস না।

ক্রন্দসীকে বুকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে দেখলাম, আমার দুচোখ ভেজা, ঘাসের উপর শুয়ে আছি। ঝাঁঝালো রোদে চোখ যেন ঝলসে উঠলো।

আপনার মন্তব্য