অপূর্ব শর্মা : গবেষণার বঙ্কিম পথের যাত্রী

 প্রকাশিত: ২০১৮-০৩-২৫ ১৭:১৮:০৩

নৃপেন্দ্র লাল দাশ:

ইতিহাসপ্রসিদ্ধ বালিহীরা বা বালিশিরার পাহাড় থেকে নেমে এসেছে দুইটি অনার্য নদী। এর একটির নাম বিলাস এবং অন্যটির নাম উদনা। এই দুই বোন নদী একত্রিত হয়ে নাম ধারণ করেছে গোপলা বা গোপেশ্বরী। হাইল হাওরের ভেতর দিয়ে এই নদী প্রবাহিত হয়েছে। বিলাসের এক ত্রিভঙ্গ মুরারী রূপ আছে। বাক নিয়েছে, বালুচরে নির্মাণ করেছে মুগ্ধ নৈসর্গিক শোভা। এখানেই হরিণাকান্দি বলে একটি গ্রাম আছে। এককালে হরিণ চড়ে বেড়াত কিনা জানি না; কিন্তু অরণ্যক পরিবেশ আছে গ্রামটির।

এই গ্রামেই জন্ম অপূর্ব শর্মার। তার বেড়ে ওঠার সঙ্গে এই প্রকৃতির দারুণ প্রভাব আছে। অকৃপণ প্রকৃতির আস্বাদ্যতা তার মজ্জায় ঢেলে দিয়েছে সৃজনের সুমঙ্গল বার্তা। শৈশবকাল থেকে শিক্ষাজীবনের পুরোটা জুড়েই ছিল তার প্রশ্নমুখরতার দারুণ ঘোরসওয়ার হওয়ার আকাঙ্খা। যে কারণেই লক্ষ্য করি, মুক্তিযুদ্ধের অনেক ধূসর পৃষ্ঠা তার হাতে প্রথম সূর্যোদয়ের মতোই জবাকুসুমশংকাশয় রূপ ধরেছে। শিক্ষাজীবনের কল্লোলিত পর্ব শেষ হয়ে যাওয়ায় পর স্কুল-কলেজের নানা অভিজ্ঞানের ঝড়ের হাওয়াকে প্রত্যক্ষ করার পর রাজনীতির নানা ঢামাঢোলে দিকভ্রান্ত না হয়ে প্রখর সমাজ জিজ্ঞাসায় অপূর্ব হয়ে উঠেছেন এক দ্রোহী চেতনার মানুষ। সাংবাদিকতা মূলত তার পেশা নয়, সত্যসন্ধ প্রেরণার উৎস। ইতিহাসের দায়বদ্ধতায় মুক্তিযুদ্ধের কুশিলবদের যোগ্য স্থান দেওয়ার অদম্য ইচ্ছায় তার লেখালেখির উদ্বুদ্ধয়।

শখের বসে নয়, খ্যাতির জন্য নয় ইতিহাসের অমোঘ প্রয়োজনেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সমগ্রতাকে স্পর্শ করবার জন্য কেবলমাত্র শুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনার উপাত্ত সঞ্চয়ের উগ্র আকাঙ্খায় অপূর্ব ছুটে চলেছেন ক্ষেত্রে গবেষণার বহু বঙ্কিম পথে। তার চলার পথ আতঙ্ক ভয় আর লোভের জালে বিস্তৃত থাকলেও অকম্প নিষ্ঠায় সত্য আবিস্কারের এক দিব্য প্রেরণায় তার পথচলা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উপাত্তকে সমৃদ্ধ করছে। তার রচিত মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক ৮ বইয়ের উপর নানা সুধিজন গভীরতাস্পর্শী আলোচনা করেছেন। কিন্তু একটা বিষয়ে কেউই উল্লেখ করেননি। বীরাঙ্গনা কিংবা চা জনগোষ্ঠীর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের যে মহাকাব্যিক উপাদান অপূর্ব সংগ্রহ করেছেন- তার পেছনে পূর্বজের প্রসারিত হাত ছিল না। তাকে নিজেই নিজের হাতে আলপথ নির্মাণ করে যেতে হয়েছে। নানাজনের সহযোগ ছিল তার নিজেরই নির্মাণ করা আত্মীয় সম্পর্কের শুভ যোগের পথে। প্রতিটি কর্ম ধরে ধরে আলোচনা না করে তার বৈশিষ্ট্যের শীর্ষলেখগুলোকে আমরা একবার সূত্রাকারে পরিক্রমা করে আসতে চাই।

        ১. মহান মুক্তিযুদ্ধের এক জ্যোতির্ময় নায়ক ছিলেন জগৎজ্যোতি। এই মহান মুক্তিযোদ্ধার জীবনায়ন অপূর্বের গবেষণায় প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। দুঃসাহসিক এই গেরিলার কথা জাতির সামনে তুলে ধরে তিনি শুধু ইতিহাসকেই সমৃদ্ধ করেন নি, প্রান্তিক জনযোদ্ধাদেরও করেছেন সন্মানিত। তার ক্ষেত্র গবেষণা অনুসঙ্গের নানা ধারাপাত এই বইকে ইতিহাসযানে স্থাপন করেছে।

        ২. লোকচক্ষুর অন্তরালে যেসব নারীশ্রেষ্ঠারা স্বাধীনতার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, সতীত্বের মত মহাসম্পদ বিলিয়ে দিয়েছিলেন এদের আত্মত্যাগের কথা এমন দরদ দিয়ে আর কেউ লেখেনি। মনে হয় হাজারো বীরাঙ্গনা মাতার মানষপুত্ররূপে অপূর্ব এই মাতৃকৃত্য করেছেন।

        ৩. রক্তমাখা একাত্তরের যারা নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন সেইসব ত্যাগব্রতী মানুষদের আলেখ্য ইতিহাসের দায়বোধ থেকে অপূর্ব তুলে এনেছেন। যা নিয়ে এতকাল কেউ ভাবেন নি, সেই নিস্পত্তি না হওয়া বিষয়টিকে উত্থাপন করে অপূর্ব মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের আরেকটি অনালোকিত দিক তুলে ধরেছেন দেশবাসীর সামনে।    
     
         ৪.এই জালালী কইতরের দেশ সিলেটের মহিয়সী নারীরা মহান মুক্তিযুদ্ধে যার যার ভূমিকা থেকে যে অবদান রেখেছিলেন তার আনুপূর্বিক বর্ণনা আছে ‘মুক্তিসংগ্রামে নারী’ বইয়ে। যারা এতদিন ছিলেন অনালোচিত এবং অন্তরালে; সেইসব নারীদের অবদানকে মলাটবন্দি করে অপূর্ব প্রমান করেছেন মুক্তিযুদ্ধে নারীরাও পিছিয়ে ছিলেন না।  
              ৫. মুক্তিযুদ্ধে চা শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিষয়টি এতকাল ছিলো লোকচক্ষুর অন্তরালে। একাত্তরে পাকিদের নিধনযজ্ঞে রক্তাক্ত হয়েছিল চা বাগানের সবুজভূমি। চায়ের পাতায় লেগে থাকা সেই রক্তগাথাকে অপূর্ব আবিস্কার করে তা উপস্থাপন করেছেন মহত্তমমাত্রায়। একক প্রচেষ্ঠায় এমন শ্রমসাধ্য কাজ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিরল।  

প্রশ্নের জিজ্ঞাসু পাঠকের সামনে সূত্রগুলোকে বিন্যন্ত করাই আমাদের কাজ। অনুসন্ধিৎসুজন অবশ্যই বইগুলো পড়ে দেখবেন। পরম্পরাভাবে মহান মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে সাহসিকতার সংস্কৃতিকে বিন্তার করেছে তার খোঁজ পাওয়া যাবে অপূর্বের এসব গবেষণাগ্রন্থে।

শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধই নয় সিলেট বিভাগের সংগীত গুণীদের কথাও অপূর্ব শর্মার গবেষণামূলক প্রবন্ধে বিধৃত হয়েছে। নির্মলেন্দু চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, চন্দ্রবর্তী বর্মন, বিদিত লাল দাস, রাম কানাই দাস প্রমুখ সংগীত সাধকের কথা তিনি যেমন লিখেছেন তেমনি সিলেটের সাহিত্যরথি অনেকের কথাই তার লেখায় উঠে এসেছে। কবি অশোক বিজয় রাহা, প্রজেশ কুমার রায় ও কবি দিলওয়ার প্রমুখের জীবন ও কাব্যঅস্মিতা সম্পর্কে অপূর্ব যে বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ লিখেছেন এতে তার বহুমুখী অবলোকনের মুদ্রাকে আমরা খুঁজে পাই। তার আরেকটি বিশিষ্টতার দাবিদার বই আছে। সম্ভবত সিলেট অঞ্চলকে এই বিষয়ে আর কেউ কোন বই লিখেননি। বিপ্লবী অসিত ভট্টাচার্য সম্পর্কে তার তথ্যে উপাত্যে পূর্ণ বইটি ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামের এক সূর্য সন্তানকে ঐশ্বর্যবান করে প্রকাশ করেছে।

তার জীবন পাত্রের আরেকটি মঙ্গলঘাট আছে। যেখানে তার মনস্বীতার আলাদা দরজা হল সাংবাদিকতা। চা পাতার কচি কলাপাতা রং আবেগকে ছড়িয়ে সংবাদ পরিবেশন করা যায়, আবার হলুদ রংয়ের জার্সি গায়ে দিয়েও লিলিপুটের দেশে যাত্রী হওয়া যায়। এই দুই মার্গকেই পেছনে ফেলে অপূর্ব সমাজমনস্ক  দায়িত্ববান সাংবাদিক হতে চেয়েছেন। এজন্য রাজলাঞ্চনার গৌরবটিকাও তিনি ধারণ করেছেন তার কপালে। আবার মিডিয়ার বরপুত্র না হয়েও তিনি পেয়েছেন জাতীয় গৌরবজনক পদক। কিন্তু তার কাছে দুটাই তুল্যমূল্য। যদি কোন কিশোরী তার সামনে একটি নোট বই তুলে ধরে তিনি যা লিখবেন তা হল- ‘ শব্দই আমার ভালোবাসা, শব্দই আমার প্রেম ’।

লেখক : অধ্যাপক, কবি ও গবেষক

আপনার মন্তব্য