রুদ্র ফিরে আসুক

 প্রকাশিত: ২০১৮-০৬-২৬ ১৮:১৯:৫৮

জহিরুল হক মজুমদার:

১৯৯১ সালের ২১ জুন মারা গেলেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। জন্ম ১৯৫৬ সালে।বয়স হয়েছিল মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর। এরশাদের দীর্ঘ সামরিক শাসনের বেড়াজাল পেরিয়ে তাঁর প্রজন্ম বন্ধুরা সদ্য জীবনে প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। এমন সময়ই চলে গেলেন তিনি।বিশ্ববিদ্যালয়ে চারদিকে বলাবলি হতে থাকল যে রুদ্র মারা গেছেন।

আমরা তখন নব্বই এর গণআন্দোলনের উত্তাপ মেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য প্রথম বছর পার করেছি।আমরা বিপ্লবক্লান্ত।হেলাল হাফিজ এবং রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ছিলেন নব্বই বিপ্লবের কবি একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। আমাদের শ্লোগানে এবং দেয়াল লিখনে ছিল তাঁদের কাব্যাংশ।

এবার আত্মবিপ্লবের প্রথম ধাপে ঢাকা শহরের নাগরিক হয়ে উঠার বাসনায় মফস্বলি ভাব কাটানোর চেষ্টা করছি।নীলক্ষেত এর ফুটপাতের পুরনো বইয়ের দোকান থেকে দু’চার খানা ব্যতিক্রমী বই কিনে হল রুমমেটদের চমক দিচ্ছি।কেউ কেউ টাকা জমিয়ে জিন্স প্যান্ট কিনছে।কেউ কেউ যোগ দিয়েছে টি এস সি এর আবৃত্তি কিংবা নাট্য সংগঠনে।

তখন তসলিমা নাসরিন খুব আলোচিত ব্যক্তিত্ব। তাঁর কবিতার বই খুব বিক্রি হচ্ছে। রুদ্রের সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে তারও অনেক দিন হয়ে গেছে।তসলিমা জীবনবাদী মানুষ ছিলেন নিঃসন্দেহে। একটি বিয়ে সফল হয়নি তো তিনি আরেকটি বিয়ে করেছেন।বিয়ে করেছিলেন নাঈমুল ইসলাম খান এবং মিনার মাহমুদকেও।

নব্বই এর দশকে ঢাকার কিংবা বৃহৎ অর্থে বাংলাদেশের সমাজে তসলিমার সামাজিক চিত্রায়ন ছিল একটি “বখে যাওয়া মেয়ে মানুষের”। কিন্তু তসলিমাকে যারা সামনা সামনি দেখেছেন তাঁরা নিঃসন্দেহে বলবেন যে তিনি একজন ভদ্র সজ্জন মানুষ। এরশাদ পতনের পরও একটা বিপ্লবী পরিবেশে তসলিমা কেন সমাজের সমালোচনার মুখে পড়লেন?উর্দির পরাজয়ই যে সমাজ বিপ্লব কিংবা সামাজিক অগ্রগতি নয় তা তসলিমাকে নিয়ে কটু বিতর্কের ভিতর দিয়ে বুঝা যায়।

বিদ্রোহী তসলিমা ঘর থেকে বের হয়েছেন প্রবল সাহসে। নারী বিষয়ে ধর্মের অবস্থানের সমালোচনা করে কলাম লিখেছেন। সেই কলাম জনপ্রিয় হয়েছে। তাঁর বইও বিক্রি হয়েছে প্রচুর। অধুনা বিলুপ্ত “আজকের কাগজ” গ্রুপের সাপ্তাহিক পত্রিকা “খবরের কাগজ” এর পাঠকপ্রিয়তার একটি প্রধান কারণ ছিল তসলিমা’র লেখা।

তসলিমার যে লেখাটি আমাদের অনেকেরই হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল তা হচ্ছে রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এর মৃত্যুতে তাঁর জন্য লেখা তসলিমার শোকাবহ কলামটি।শিরোনাম ছিল “রুদ্র’র জন্য ভালোবাসা”।

রুদ্র ছিলেন তসলিমার সত্যিকারের প্রেম। এটা স্পষ্ট বুঝা যায়। তসলিমার জীবন ছিল রুদ্রের সাথে গাঁথা। আর বাকিদের সাথে তাঁর ছিল শুধু জীবন যাপন।মিনার মাহমুদ কিংবা নাঈমুল ইসলাম খান তসলিমা এর জীবনে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছেন তা জানা যায়না।কিন্তু তসলিমা’র জীবন জুড়ে ছিল রুদ্র, এটা তসলিমা’র লেখাতে স্পষ্ট।স্বামী ও প্রেমিকের পার্থক্য স্পষ্ট করেছেন তসলিমা তাঁর লেখায় এবং জীবনাচরণে।

তসলিমা’র “রুদ্র ফিরে আসুক” হাহাকারের মধ্যে যে কান্না ও আকুলতার প্রকাশ তা আমাদের ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমরা সেইসব সদ্য তরুণ যাদের জীবনে প্রেম আসি আসি করছিল সেই নব্বই এর সূচনা পর্বে। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ সদ্য প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কাঁদতে শিখেছি।কিন্তু তসলিমা’র কান্না শব্দের অলিন্দে অলিন্দে যেভাবে গুমরে গুমরে উঠেছিল, শুধু একটি কলামে, কেবলমাত্র ঐশ্বরিক নিষ্ঠুরতায়ই তার সামনে স্থির থাকা সম্ভব।তসলিমা যেন আমাদের প্রিয়জন হারানোর কান্নার এক নিবিড় পাঠ দিয়ে গেলেন।

তসলিমা দ্বিধাহীনভাবে রুদ্রের জন্য কেঁদেছেন।রুদ্রের দুর্বলতাগুলোর কথা বলেছেন। প্রথম বাসরে আবিস্কার করেছেন রুদ্র “গোপন রোগে” আক্রান্ত। তসলিমা নিজের কাছে, সমাজের কাছে রুদ্রকে গোপন করেন নি। কারণ, রুদ্র যে কবি। রুদ্র যে সকলের। আমাদের সবাইকে জানিয়ে দিয়েছেন তোমাদের কবি আক্রান্ত, গোপন সংক্রামক ব্যধিতে। ছুটে গিয়েছেন নিজের শিক্ষক চিকিৎসকের কাছে দাওয়াই নেওয়ার জন্য। রুদ্রকে জীবনে ফিরিয়ে এনেছেন।সেই রুদ্র জীবন থেকে বিদায় নেওয়ায় তসলিমা’র শোক আমাদের সকলের শোক হয়ে উঠেছিল।

রুদ্র-তসলিমাই ছিলেন বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি জুটি।এর আগে আর কোন কবি জুটির কথা শোনা যায় না।কাব্যের সহচর-সহচরী হওয়াই হয়তো তাঁদের জীবন যাপনের মধ্যে এক ধরণের বাউলিয়ানার অনুষঙ্গ যোগ করেছিল। যদিও রুদ্রের কবিতাকে উত্তর বা পূর্ব তসলিমা কিংবা তসলিমার কবিতাকে উত্তর বা পূর্ব রুদ্র এমন বিভাজনে সমালোচকরা চিহ্নিত করেন নি।

রুদ্রের প্রয়ানের কয়েক বছর পর টি এস সিতে রুদ্র মেলা হতে দেখেছি।মনে পড়ে প্রথম রুদ্র মেলার উদ্বোধন করেছিলেন কামাল লোহানী। গত কয়েক বছর আর রুদ্র মেলা হতে দেখিনা। রুদ্রকে স্মরণে কোথাও যেন আমরা কার্পণ্য আক্রান্ত হয়েছি।

শাহবাগের বইয়ের দোকানগুলোর অধিকাংশই যখন কাপড়ের দোকানে পরিণত হয় তখন কে কবি আর কে পাঠক এই পরিচয় নিয়ে কেই বা মাথা ঘামায়। সবই ক্রেতা আর বিক্রেতা। এই বাজারে রুদ্রের কিছু কেনার নেই। আমাদেরও না। তাই এই আকালের যুগে তসলিমার সেই আকুলতাই আমাদের প্রার্থনা হোক –রুদ্র ফিরে আসুক।

আপনার মন্তব্য