প্রকাশিত: ২০১৮-০৭-০৪ ১৬:২৯:২৩
জহিরুল হক মজুমদার:
গত ২৯ জুন পার হয়ে গেল কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত’র মৃত্যুবার্ষিকী। যশোরের কপোতাক্ষ নদীর পাড়ে সাগরদাঁড়ি গ্রামে তাঁর জন্ম। বর্তমানে জায়গাটি কেশবপুর থানার অন্তর্ভুক্ত। রাজনারায়ণ দত্ত এবং জাহ্নবী দেবীর পুত্র তিনি। বাংলার একমাত্র কবি যার জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে যাত্রাপালা। জীবনকে একটি মহাকাব্যিক মাত্রা দিতে না পারলে কারো পক্ষে যাত্রাপালার চরিত্র হয়ে উঠা এত সহজ নয়। মাইকেল এটা পেরেছিলেন।
সাগরদাঁড়ি গ্রামে কবি ছিলেন তাঁর তের বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর কোলকাতা নিবাসী হন। প্রথমে পড়েছেন মায়ের কাছে- রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণ। তারপর গ্রামের মৌলভীর কাছে পড়েছেন বাংলা, আরবি এবং ফার্সি। গ্রামের মৌলভীর কাছে পড়া থেকে দত্ত পরিবারের অসাম্প্রদায়িক মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু পুত্র মধু যখন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তখন পিতা রাজনারায়ণ দত্ত সেটি মানতে পারেন নি। তিনি তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেন। মধু’র খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ সেসময় সমাজে বেশ আলোড়ন তুলেছিল।
তিনি ছিলেন হিন্দু কলেজের ছাত্র। কিন্তু খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর তাঁকে হিন্দু কলেজ ছাড়তে হয়। কারণ সম্ভবত হিন্দু কলেজে খ্রিষ্টান ছাত্রদের পড়ার নিয়ম ছিলনা। উপনিবেশিক ইংরেজ শাসকদের শিক্ষা সুবিধাগুলোও সাম্প্রদায়িকভাবে বিভক্ত ছিল। যেমন হিন্দু কলেজ কিংবা মুসলিমদের জন্য কোলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা। মাইকেল মধুসূদন দত্ত শিবপুর এর বিশপস কলেজ থেকে লেখাপড়া চালিয়ে যান। সেখানে তিনি গ্রিক, লাতিন এবং সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। এভাবেই তিনি প্রচলিত পড়াশুনার পাশাপাশি বহুভাষী হয়ে উঠেন।
আমরা স্কুল জীবনে কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সাথে পরিচিত হয়েছিলাম তাঁর “কপোতাক্ষ নদ” কবিতাটির মাধ্যমে। সতত হে নদ তুমি পড় মোর মনে-----। মাইকেল আমাদের কাছে কঠিন কবি ছিলেন। সব শব্দের মানে বুঝতাম না। তখনো নদ ও নদীর পার্থক্য বুঝতাম না। মাইকেলের কবিতার শব্দমালা তুলনামূলক কঠিন ছিল আমাদের কাছে। তবুও নদীর জন্য লেখকের কান্নাটি বুঝতে পারতাম।
আমাদের বাড়ির পাশে ছিল কাঁকড়ি নদী। ভারতের ত্রিপুরা থেকে উৎপত্তি হয়ে এই পাহাড়ি নদী আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গেছে। আমাদের কারোরই কাঁকড়ির জন্য কোন কান্না ছিলনা। আমাদের গ্রাম থেকে যারা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে চাকুরী করতে গিয়েছিলেন সেই সময় তাঁদের কারোর মধ্যেই কাঁকড়ি নিয়ে কোন বিশেষ আবেগ দেখিনি। আমরা অবাক হতাম নদীর জন্য কবির এই কান্না দেখে। মাইকেলের আগে বা পরে বাংলা সাহিত্যের কোন লেখক নিজের প্রিয় নদীর জন্য এমন স্মৃতিকাতরতায় আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানা নেই। এটাও হয়তো তাঁর পশ্চিমের সাহিত্য প্রভাবিত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই আবেগ বিশুদ্ধ, এতে কোন সন্দেহ নেই।
মাইকেল আমাদের কাছে একটি মিথের চরিত্রের মত ছিলেন। আমার পিতামহ যিনি পেশায় ছিলেন হোমিও ডাক্তার এবং একজন পীরের মুরিদ, তিনিও মাইকেল এর --- দাঁড়াও পথিক বর জন্ম যদি তব বঙ্গে, তিষ্ঠ ক্ষণকাল--- এই কবিতাংশ উচ্চারণ করতেন। নজরুল এবং মাইকেল নিয়ে কথা বলতেন। বাঙালির বিদ্রোহের প্রতীক ছিলেন মাইকেল এবং নজরুল। তাই হয়তো জনমানসে তাঁরা মিথে পরিণত হয়ে গিয়েছেন।
আর আমরা সেই গণ্ডগ্রামের স্কুলের ছাত্ররা অবাক হয়ে এক অদ্ভুত মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা ভাবতাম যিনি খ্রিস্টান হয়েছেন, শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে বিয়ে করেছেন, দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে গিয়ে থেকেছেন, আর শেষ জীবনে কী কষ্ট পেয়েই না মারা গেছেন। অন্য দিকে আমাদের আলোচনায় ছিল নজরুলের জীবন। তাঁর বাড়ি ছেড়ে পলায়ন, রুটির দোকানে কাজ নেওয়া, নার্গিসের কাছ থেকে চলে যাওয়া এইসব আমাদেরকে মুগ্ধ করে রাখত।
আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায় ----, এই কবিতা দিয়ে জীবনানন্দ দাশ আমাদের কিশোর মানসকে প্রভাবিত করেছিলেন। আবার কিছুটা আবৃত্তির সুবাদে ‘বনলতা সেন’ কবিতা দিয়ে প্রভাব রেখেছিলেন। ‘কবর’ আর ‘পল্লী জননী’ কবিতার সুবাদে পল্লীকবি জসীম উদ্দিনও প্রভাব রেখেছিলেন আমাদের জীবনে।
কিন্তু আমাদের যে কৈশোর তা সব বাধা ভেঙে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যেতে চাইত। একটু দূরের মাঠে গিয়ে খেলতে পারলে মনে হত আজকে পৃথিবীর অনেকখানি পথ পাড়ি দেওয়া হল। টেলিভিশনে সিনেমা আছে বলে গ্রামের বাজারে একটু বেশী রাত থেকে যাওয়া কিংবা গ্রামের মেলায় একটু রাত কাটানো, এইসব সীমানা ভাঙা পদক্ষেপের স্বীকৃতি ছিল মাইকেল আর নজরুলের জীবনের মধ্যে। আর তাই আর কারো জীবন নয়, শুধু মাইকেল আর নজরুলের জীবনই আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল কিশোর বেলায়।
উচ্চমাধ্যমিকে উঠার পর আমাদের পাঠ্য ছিল “মেঘনাদ বধ” কাব্যের অংশবিশেষ। শিরোনাম ছিল “সমুদ্রের প্রতি রাবণ”। পড়াতেন সাহিত্যের শিক্ষক আমীর আলী চৌধুরী। স্যার এর কথার ছত্রে ছত্রে থাকত মাইকেল এর প্রশংসা। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাহিত্যের শিক্ষকদের নাম করতে গেলে আমীর আলী চৌধুরী’র নাম করতেই হবে। রামায়ণের ধারণার বাইরে গিয়ে মাইকেল কীভাবে রাবণকে সামনে নিয়ে এসেছেন তা পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের। ‘রাম’ মহত্ব আর বীরত্ব প্রভাবিত আর্য মহাকাব্য ‘রামায়ণ’ এর বিপরীতে ‘রাবণ’ এর বেদনা প্রভাবিত ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য যে অনার্যদের সাহিত্যিক বিদ্রোহ তা স্যারের আলোচনা থেকেই প্রথম বুঝতে পারি। এ ছাড়া স্যার প্রশংসা করেছিলেন ‘খেদাইছে’ এরকম একটি গ্রাম্য শব্দ মাইকেল কীভাবে মহাকাব্যে চমৎকার করে ব্যবহার করেছেন।
মাইকেল সম্পর্কে যে কথাটি জনসাধারণের মাঝে খুব বেশী প্রচলিত ছিল তা হচ্ছে তিনি ভিক্ষা বা সাহায্য দেওয়ার সময় টাকা গুনতেন না। একমুঠ টাকা বা পয়সা ভিক্ষা বা সাহায্য দিয়ে দিতেন কেউ চাইলেই। এই সত্য কিংবা কিংবদন্তি আমাদের আলোড়িত করেছিল।
আমাদের ছোটবেলায় গ্রামীণ দারিদ্র ছিল চোখে পড়ার মত। ছোটদের পকেটে একটি টাকা থাকাই বিরাট ব্যাপার ছিল। আর গ্রামে মেলা হলে বরাদ্দ ছিল পাঁচ টাকা। গ্রামের মহিলারা অনেকেই আঁচলে কিছু পয়সা বেঁধে রাখতেন। সে সময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামে এক জমিদার পুত্রের এই গল্প, যে সামনে এসে দাঁড়াচ্ছে তাকেই মুঠি ভর্তি করে টাকা দিচ্ছেন। মনে হয় যেন দারিদ্র ভুলে থাকার এক রূপকথার গল্প হিশেবে একটু জানাশোনা লোকেরা এই আলোচনা করতেন মাইকেলের মৃত্যুর এক শতাব্দী পরেও।
নজরুল বা মাইকেল, তাঁদের কোন পূর্ণ জীবনী সেই বয়সে পড়ে উঠতে পারিনি। গ্রামের বাজারে খুব বেশী “আউট বই” পাওয়া যেত না। আবার শহর ছিল অনেকখানি দূরে। তবে কলেজে উঠে কুমিল্লা শহরে এসে “বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র” এর সুবাদে পড়েছিলাম হায়াৎ মামুদ এর লেখা নজরুল জীবনী।
আমাদের সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘পূর্বপশ্চিম’ এবং “সেই সময়” খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল তরুণদের মাঝে। “সেই সময়” উপন্যাসের মাধ্যমেও ‘মধু’ চরিত কিছুটা জানতে পারি। সেটাও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ দিকে এসে পড়েছিলাম প্রমথনাথ বিশী’র লেখা মাইকেল জীবনী। প্রমথনাথ বিশী ভাষার কারিগর। তাঁর ভাষাশৈলী এবং বর্ণনা ভঙ্গীতে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম-এই ছোট্ট পরিসরের বই খানি পড়ে। জেনেছি অনেক কিছু। ততদিনে গোলাম মুরশিদ এর “আশার ছলনে ভুলি” বের হয়ে গেছে। কিন্তু এত বড় বই কেনার পয়সাও ছিলনা, পড়ার সময়ও ছিলনা।
প্রমথনাথ বিশী রচিত জীবনী থেকে জানতে পারি যে মাইকেল বিলেতে ব্যারিস্টারি পড়তে যাওয়ার আগে মহাদেব নামে একজনের কাছে তাঁর সম্পদ বুঝিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। কথা ছিল কবিকে মাসে মাসে টাকা পাঠাবে। কিন্তু মহাদেব কথা রাখেনি। এই খেদ জানিয়ে বিদ্যাসাগরকে চিঠি লিখেছিলেন মধু কবি। বিদেশ বিভূঁইয়ে বিদ্যাসাগরের অর্থ সাহায্য মধু কবির কাছে পৌঁছেছিল। এমনকি ফ্রান্সে এ প্রবাস জীবন যাপনের সময়ও।
দেশে ফিরে আসার পর সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার ছিল বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোর্টে ব্যারিস্টার মাইকেল মধুসূদন দত্তের ওকালতি। মাইকেল উকিল হিশেবে তাঁর মক্কেল এর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন আর ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ারে বঙ্কিমচন্দ্র। বাংলা সাহিত্যের দুই দিকপাল আইনি ভাষায় পরস্পরকে বুঝে নিচ্ছেন। এই দৃশ্য আদালতের জন্য স্বাভাবিক হলেও ভাবীকালের জন্য এক অসাধারণ গল্পের উপকরণ হয়ে থাকলো।
মাইকেল ওকালতি করেও প্রচুর অর্থ কামাতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেন নি। বন্ধুদের মামলায় তিনি সাধারণত অর্থ গ্রহণ করতেন না। এমনটিই জানা যায় প্রমথনাথ বিশী রচিত মাইকেল জীবনী থেকে। কোন কোন বন্ধু তাঁকে অর্থ গ্রহণ করতে বলতেন। কিন্তু মাইকেল বলতেন যে, তুমি বন্ধু মানুষ, তোমার কাছ থেকে কী অর্থ গ্রহণ করব। তুমি পাঁচটি বিয়ার দিয়ে যেও। আর তোমার বৌদিকে জিজ্ঞেস করে দেখ, তাঁর পাঁচটি টাকা লাগলেও লাগতে পারে।
মাইকেলের এক মহাকবি হয়ে উঠার বাসনা ছিল। আর তা তিনি হয়েছেনও তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের সাহিত্য চর্চায়। ইউরোপের জীবনও সংস্কৃতির প্রতি ছিল তাঁর গভীর অনুরাগ। তিনি মনে করতেন সমুদ্রের ওপারেই তাঁর বিকাশের প্রকৃত জায়গা। বিলেতে গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারি পড়ার সুবাদে। আর তাছাড়া থেকেছেন বিলেতের বাইরে ফ্রান্সে। যতক্ষণ নিজ দেশে ছিলেন ততক্ষণ এক অস্থিরতায় ভুগেছেন ইউরোপের জন্য। কিন্তু শেষ কান্না তিনি কেঁদেছেন তাঁর মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির জন্য।
উনিশ শতকে সারা বাংলা জুড়ে চলছে চলছে কৃষক বিদ্রোহ। আর কোলকাতা জুড়ে চলছে কথিত “বেঙ্গল রেনেসাঁ”। কৃষক বিদ্রোহের আঁচ কোলকাতায় লাগেনি। আবার বেঙ্গল রেনেসাঁও কোলকাতা ছেড়ে গ্রামে ছড়িয়ে পড়েনি। এমন এক অদ্ভুত বিচ্ছিন্নতার মধ্যেও এক বিদ্রোহী মাইকেল এর কথা ছড়িয়ে পড়ে বাংলার গ্রাম গ্রামান্তরে। ছড়িয়ে পড়ে মাইকেল আর বিদ্যাসাগরের বন্ধুত্বের গল্প। এই গল্প ছড়িয়ে থাকবে হয়তো আরও হাজার বছর।
বর্তমানে কবির জন্মস্থান সাগরদাঁড়িতে প্রতিবছর জয়ন্তীতে উদযাপিত হয় “মধু মেলা”। এই মেলার মাধ্যমেই হয়তো একজন মধু কবি হাজার বছর পর এমনভাবে লোকজীবনে মিশে যাবেন যে মানুষ ভুলে যাবে তিনি হিন্দু না খ্রিষ্টান ছিলেন। শুধু মনে রাখবে, এই কপোতাক্ষ তীরে, এই সাগরদাঁড়িতে তিনি ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। শরীরের সমাধি যেখানেই হোক, মধু কবির আত্মার সমাধি এই কপোতাক্ষ তীরেই, যেখানে হাজার মানুষের সমাগম এবং নিঃশব্দ স্মরণ এক গভীর প্রার্থনা হয়ে উঠে।
আপনার মন্তব্য