ছড়াসাহিত্যে ঈদ, ঈদে ছড়াসাহিত্য

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-১৭ ১৮:৩৭:৩৬

 আপডেট: ২০১৫-০৭-১৭ ১৮:৩৮:১৯

বশির আহমদ জুয়েল:

‘আজ ঈদ মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ’ এ লেখাটি পড়ার পর বুঝতে আর বাকী থাকে না যে ঈদ মানেই আনন্দ। কিন্তু এ লাইনটি যখন আমরা মুখস্ত করেছি বা পড়েছি তখন ঈদের আনন্দ মদিনায়ই সীমাবদ্ধ ছিলো না। বিশ্বের প্রতিটি মুসলিম ঘরে ঘরেই আনন্দ বলা যেতো। তারপরও এ লেখাটি ছিলো হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর একটি জীবন্ত কাহিনী বা ঘটনা নিয়ে।

সুতরাং ঈদের সেই আনন্দের পথ ধরেই আজ সারা বিশ্বের মুসলিম ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে ঈদের আনন্দ। আর এ আনন্দের ধারাবাহিকতা চলমান থাকবে আজীবন। সারা বিশ্বের ন্যায় আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশেও ঈদের আনন্দ বয়ে আনে ভেদাভেদ ভুলে থাকার মন্ত্র। আমির-ফকির কিংবা গরীব-ধনীকে দাঁড় করায় এক কাতারে।

মুসলমান হিসেবে আমরা বছরে দু’টি ঈদ পালন করি। একটি রমজানের ঈদ অপরটি কোরবানীর ঈদ। এই ঈদ নিয়ে সাধারণ মানুষের চেয়ে যেনো একটি বেশিই ভেবে থাকেন সাহিত্যিকরা। তাঁরা তাদের কোনো কোনো রচনায় বিশেষভাবে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন ঈদকে। কেউ কেউ কালজয়ী রচনাও করেছেন কেবল ঈদকে নিয়ে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন কালজয়ী গান- ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ....’।

আমরা এটিকে কেবল গান না বলে যদি সাহিত্যের কঠিনতম বিষয় ছড়াও বলি ভুল হবে না। ছড়ার ব্যাকরণগত সব বিষয়ই লিপিবদ্ধ আছে এ গানটিতে।

কবি তাঁর শিষ্য শিল্পী আব্বাস উদ্দিন আহমদ-এর অনুরোধে ১৯৩১ সালে এই গান রচনা ও সুরারোপ করেন। গানটি লেখার মাত্র চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। গ্রামাফোন কোম্পানি এর রেকর্ড প্রকাশ করে। রেকর্ডের অপর গান ছিল কবির ‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয় আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেকর্ড নম্বর এন- ৪১১১। প্রকাশকাল ফেব্রুয়ারী ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দ। প্রায় শত বছর পূর্বের এ গানটির আবেদন এখনো ফুড়িয়ে যায়নি। বরং দিন দিন বেড়েই চলেছে এ গানের গ্রহনযোগ্যতা।

এভাবেই ঈদ ও ঈদের আনন্দকে ধরে রাখতে কবি সাহিত্যিকরা চেষ্টা চালিয়ে গেছেন যুগে যুগে। কারো গানে, কারো কবিতায় অথবা কারো কারো ছড়ায় আমরা ঈদের বা ঈদ আনন্দের বিস্তর বর্ণনা খুঁজে পাই। বাংলা সাহিত্যের কঠিনতম অংশ নিয়ে নাড়াচাড়া করে থাকেন ছড়াসাহিত্যিকরা। সেই ছড়াসাহিত্যেও রয়েছে ঈদ বিষয়ক অনেক রচনা। প্রবীণের পথ ধরে নবীনেরাও পিছিয়ে নেই এসব রচনায়।

সাহিত্যের এ কঠিনতম অধ্যায় ছড়ার মাধ্যমে খুব সহজভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন ঈদের নানা কর্মকান্ড। ঈদের আনন্দের পাশাপাশি গরীব দুঃখীদের মনের দুঃখ কষ্টের কথাও ছড়াসাহিত্যিকরা বলেছেন আপন মনে। ঈদের কেনাকাটা, গরীব-ধনীর তফাৎ এ রকম অনেক বিষয়ই ফুটে উঠেছে ছড়ায়। ঈদের আসল আনন্দটাই বিরাজ করে কেনাকাটায়। আর এতে বড়দের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আনন্দ পায় ছোটরা। এ বিষয়গুলোও স্থান পায় ছড়াসাহিত্যে।

আর ছড়াসাহিত্যিকরা তা ফুটিয়ে তুলেন এভাবে-

‘শুরু হলো ঈদের বাজার চলছে সবার কেনা কাটার ধুম

নতুন জামা নতুন জুতায় নিচ্ছে কেড়ে খোকা খুকুর ঘুম।’

এর পরেই ছড়াসাহিত্যিক কেনাকাটা করতে গিয়ে শিশু মনের বিরক্তিকর দিকগুলোও তুলে ধরেছেন ঠিক অন্য রকমভাবে-

‘ফুটপাতে আর যায় না হাটা ঈদের বাজার নিচেছ দখল যেনো

খোকা খুকু বলছে এবার হাটার পথে দোকান কোঠা কেনো?

নাই জানা নাই কোনো জবাব হয়তো নেতা আছে তাদের পিছু

কোন সে নেতার দাপট এমন করছে দখল রাস্তা উচু নিচু।’

ধনী গরীব সবাই নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী কেনাকাটা করে থাকেন। তারপরও গরীব দুঃখীদের মনে না পাবার বেদনা আর ধনীদের উল্লাসে যেনো কেউ কেউ হয় হতবাক। আকাশে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে, ধনীদের ঘরে শুরু হয় ঈদের অন্যরকম আমেজ। আর গরীবরা যেনো নিরবে বসে বসে চোখের জল ফেলে যায় অবিরাম। এ রকম কিছু পার্থক্যের ইঙ্গিতই করা হয়েছে নিম্নোক্ত ছড়াটিতে-

‘তোমার বাড়ি চাঁদ উঠেছে আমার বাড়ি ফাঁকা তাই-

তোমার জন্য ঈদ এসেছে আমার কোনো দুঃখ নাই।

তোমরা থাকো দালান কোঠায় আমরা থাকি বস্তিতে

তোমরা খাবে পোলাও পায়েস আমরা খাবো রস তিঁতে।

ঈদের চাঁদে তোমরা হাসো আমরা ঝরাই চোখের জল

গরীব দুঃখীর ঈদ হিসাবে সবাই জানে এমন ফল।’

এভাবেই ছড়াসাহিত্যিকরা অবিরাম চেষ্টা করে যাচ্ছেন সকল মানুষের জন্য কিছু না কিছু লিখে যেতে। ছোট্ট এক খুকি, ধনী পিতার সন্তান। কিন্ত স্কুলে তার প্রিয় সহপাঠীটির পিতা অত্যন্ত গরীব। বড়লোক পিতার কাছে এই খুকির ব্যতিক্রম একটি বায়না নিয়ে এবার চমৎকার একটি ছড়া উল্লেখ করা যেতে পারে-

‘ঈদ এসেছে ঈদ এসেছে তাইতো খুকির বায়না

নতুন জামা নতুন জুতা এসব খুকি চায় না।

ঈদ এসেছে ঈদ এসেছে তাই তো খুকির দাবী

ঈদের দিনে দিতে হবে হাসি খুশির চাবি।

চাবিটা তার খেলার সাথী সে যে জনম দুঃখী

ঈদের দিনে তাকে পেলেই খুকি ভীষণ সুখী।

এমন বায়না এমন দাবী হলে সবার ঘরে

ঈদ আনন্দে থাকবে সবাই জনম জনম ধরে।’

ছড়া বাংলা সাহিত্যের আদি ঠিকানা। ছড়া এমন একটি বিষয় যেখানে কোনো কিছুই বাদ পড়ার সম্ভাবনা নেই। ধনী পিতার আদরের কণ্যার চমৎকার বায়না আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখায়। ঠিক তেমনিভাবে আরেক গরীব ঘরের কোনো সন্তান যখন বলে-

‘তোমরা থাকো দালান বাড়ি থাকো ভিষণ স্বস্থিতে

আমরা থাকি ড্রেনের পাশে বসত করি বস্তিতে।

তোমরা পরো নতুন জামা আরো ধরো বায়না

আমরা যে কি কাপড় পরি দেখতেও নাই আয়না।

আজ দিনে যা ঈদ দিনেও তা সারা বছর সমান

হায় ভগবান আল্লাহ ঈশ্বর এসব তফাৎ কমান।’

তখন আমাদের ভাবনায় কিছুটা হলেও ছেদ পরে। তারপারও আমাদের জীবন চলমান। কঠিন বাস্তবতার মাঝেও চিরসত্য হলো যে, ঈদের আনন্দ আমরা প্রত্যেকেই পেয়ে থাকি। কেউ কম কেউ একটু বেশি। তাই আমরা সবাই বলতে পারি-

‘বছর ঘুরে ঈদ এলো অনেক খুশি তাই,

নতুন রঙিন জামা পরে ঈদগাহেতে যাই।

ফিরনি পায়েশ পোলাও খাওয়ার পড়ে গেছে ধুম,

ঈদের খুশি দু'টি চোখের কেড়ে নিল ঘুম।’

হ্যাঁ এভাবেই ঈদের আনন্দকে ছড়ায় ধরে রাখা হয়েছে। ঈদের আনন্দের মতো সারা বছর যদি থাকতো। তা হলে কারো মনেই কোনো কষ্ট থাকতো না। এ কথা হয়তো সবাই স্বীকার করবেন। আর এরকম চিরসত্য একটি আবেদনকে ফুটিয়ে তুলে ধরা হয়েছে ছড়াসাহিত্যে-

‘দাওনা প্রভু সবার মনে ঈদ আনিয়া রোজ

হর্ষে যেন নিতে পাড়ি দুঃখীর ঘরে খোঁজ।

নিত্য দু'হাত বাড়িয়ে দিয়ে টানবো দুঃখীরে বুকে,

হরেক রকম খাবার করে তুলে দিব মুখে।

সুখ হারিয়ে ভাবছে যারা জীবন কাঁটা-কাঁটা

সুখ দিয়ে সেই জীবনটাতে দুঃখে দিব ভাটা।

এমন দিনটি দাওনা প্রভু সবার মনে তুমি,

সুখ বসন্ত হইবে তবে ধূসর মরুভূমি।’

ঈদের দিনে সবাই এক কাতারে মিলে যাওয়ার দৃশ্যটা কখনোই ভুলার নয়। সারা বছরের হিংসা বিদ্বেষ ভুলে যখন আমরা বুকে বুক রেখে কোলাকোলি করি তখন সবার হৃদয় যেনো মিশে যায় শান্তি ও কল্যানের সাথে। সেদিন সবাই ভুলে যাই কে গরীব আর কে ধনী। ঈদগাহে সৃষ্ঠি হয় অন্যরকম এক মিলন মেলার। নিস্পাপ একটি বাগানে যেনো পরিনত হয় গোটা ঈদগাহ। সহজ এ বর্ণনাটি আমরা দেখতে পারি সাহিত্যের কঠিনতম মাধ্যম ছড়ায়-

‘ঈদগাহে আজ ঈদের খুশি খুশি ঘরে ঘরে

যে যাকে পায় ভেদ ভুলে সব কোলাকুলি করে

ক্ষীর পায়েসের সৌরভে আজ গৌরবে গায় পাখি

এত হাসি, এত খুশি কোথায় বল রাখি

ঈদের দিনে ঘুরে বেড়ায় খোকা-খুকু যত

ঠিক যেন ঐ ফুল বাগিচার প্রজাপতির মত

ঈদ এলে হয় সবাই খুশি রয় না দুঃখ জ্বালা

ঈদ এলে এই দেশটাতে হয় মধুর মিলন মেলা

ফুল ভেবে তাই নীল ভোমরা সুর করে গায় গান

ঈদগাহটা আজ হয়ে যাবে ফোটা ফুলের বাগান।’

বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি মাধ্যমেই রয়েছে ঈদের রয়েছে পৃথক এক গুরুত্ব বা ব্যতিক্রম মূল্যায়ন। তবে সকল মাধ্যমকে দূরে রেখে সাহিত্যের কঠিন মাধ্যম ছড়ায় সহজভাবে মানুষের কাছে পৌঁছা সহজ। কঠিন এ মাধ্যমটির ভাষা খুব সহজ বলেই কারো বুঝতে কোন সমস্যা হয় না।

সুতরাং ঈদের আনন্দকে যেনো আমরা সারা বছর ধরে রাখতে পারি। এটিই হতে পারে আমাদের সকলের প্রত্যাশা। বিশেষ করে বছরে দু’টি ঈদের মধ্যে রমজানের ঈদের মূল্যায়নটা একটু বেশিই। কারন এক মাস রোজা রাখার পর আসে এ ঈদের আনন্দ। তাই ছড়াসাহিত্যেও আমরা দেখতে পাই এ রকম আবেদন-

‘রোজার শেষে ঈদ এসেছে সবার মুখে হাসি তাই

ঈদ আনন্দে ভাসছে সবাই হাসি খুশির সীমা নাই।

গরীব ধনী এক কাতারে সবাই যেনো আপন ভাই

দৃশ্য এমন সারা বছর বাংলাদেশে দেখতে চাই।

কে যে গরীব কে যে ধনী মাটির নিচে সবার ঠাঁই

হিংসা বিদ্বেষ ভুলে আমরা সুখের ঘাটে ছুটে যাই।

আপন মনে আমরা যেনো শান্তি সুখের গানটা গাই

ঈদ খুশিতে সারা জীবন সবাই যেনো মিলে খাই।’

ছড়াসাহিত্যের এই আবেদনের মতোই হতে পারে এবারের ঈদে সকলের প্রত্যাশা। আর সকলের সাথে আমার প্রত্যাশাটাও এর ব্যতিক্রম নয়।

লেখক : বশির আহমদ জুয়েল, সম্পাদক- ছন্দালাপ (ছড়াসাহিত্যের ছোটকাগজ)

আপনার মন্তব্য