ভোগান্তির ঈদ কিংবা ক্রিকেট প্রেমের গল্প!

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-১৮ ০২:২৪:৫০

হাসান মো. শামীম:

২০০৩ সালের কোরবানি ঈদের আগের রাত। চলছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে বাংলাদেশ বনাম কানাডার ম্যাচ। আগের বিশ্বকাপে পাকিস্তান কে হারানো বাংলাদেশ ততোদিনে টেষ্ট স্ট্যাটাস পেয়ে আমাদের চোখে অনেক বড় শক্তি।পক্ষান্তরে কানাডা যে বিশ্বকাপ বলেই বাংলাদেশের সাথে খেলার সুযোগ পেয়েছে, না হলে ১০০ বছরেও খেলতে পারতো না..আমাদের মনোভাবের মাঝে ছিল ঠিক এরকমই তাচ্ছিল্য! বাংলাদেশ জিতবে জানা কথা,কে সেঞ্চুরি করবে বা ৫ উইকেট পাবে আমাদের ছিল সেই গবেষনা!

সে ম্যাচে বাংলাদেশ কি করেছিলো জানেন! ২০০ রানের কম টার্গেট ধাওয়া করতে নেমে অল আউট হয়েছিল মাত্র ১২০ রানে! বাঙালি জাতির রক্তে মিশে যাওয়া ক্রিকেট সে রাতে শোকে স্তব্দ করে দিয়েছিল সবাইকে! মাটি হয়ে গিয়েছিল পরদিনের ঈদ আনন্দ! নতুন জামা কাপড় পরেও বুকের ভেতর অব্যক্ত বেদনা! হেরে গেছে বাংলাদেশ! তাও কার সাথে!কানাডা..যে দেশ আমদের হিসেবে ভাল করে ব্যাট ধরাও শিখেনি! তবে সেলুনে বসে চুল কাটতে কাটতে একবারও মনে হয়নি বাংলাদেশ হারবে। টপ অর্ডার ব্যার্থ হলেও মনে হচ্ছিল পাইলট,সুজন,রফিক এরা রান করে দলকে জিতাবে।কারন সে সময় টপ অর্ডারের থেকে এই লোয়ার অর্ডার ছিলো আমাদের বেশি বিশ্বাসের জায়গা। তবে সেদিন আর কেউ প্রতিরোধ গড়তে পারেনি! ফলাফল হার এবং আমাদের অন্তহীন দুঃখ!
এর ঠিক ১২ বছর পরের গল্প টা সবারই জানা! প্রত্যাশার সীমানা কে অতিক্রম করে দঃ আফ্রিকা কে হারিয়ে টাইগার দের সিরিজ জয়! তাও সময় টা দেখুন.. একেবারে ঈদুল ফিতরের ঠিক আগ মুহুর্তে! তাও কার নেতৃত্বে? বর্তমান দলে ২০০৩ সালের দুঃস্বপ্ন বিশ্বকাপ খেলা একমাত্র ক্রিকেটার মাশরাফি বিন মর্তুজার হাত ধরে! ঈদের আনন্দ তাই বেড়ে গেল হাজার গুন!
কানাডার সাথে সেই হার ম্যাশের মনে আছে কিনা জানিনা। তবে এবার জয় পেয়েই তিনি একটা উপহার চেয়েছেন প্রধান মন্ত্রির কাছে! না নিজেদের জন্য বোনাস,গাড়ি,কিংবা ফ্ল্যাট নয়! শুধু চেয়েছেন দেশের মানুষের জন্য একটা বাড়তি ছুটির দিন! সাপ্তাহিক ছুটির গেড়ে ঈদের ছুটি পড়ে যাওয়ায় ম্যাশের এমন দাবি। স্যালুট বস! বিজয়ের মঞ্চে দাড়িয়ে এইরকম একটি চিন্তা তুমি ছাড়া কেউই করতে পারবেনা। ঈদ শেষ করেই সাউথ আফ্রিকার সাথে আবার বাংলাদেশ দল নেমে পড়বে টেষ্ট লড়াইয়ে। বাড়তি দিন ছুটি কাটানোর সময় কোথায় ক্রিকেটার দের! তবু সত্যিকারের একজন নেতাই যেন ভাবতে পারেন এইরকম! বাজি ধরে বলতে পারি মাশরাফির সেই বক্তব্য যারা সরাসরি শুনেছেন বুকের ভেতর তাদের দলা পাকিয়ে ঊঠেছিল ভালোবাসাময় আবেগ! পরম শ্রদ্ধায় ঝুকে পড়েছিল মাথা..কিন্তু মুখে ছিল স্নেহের হাসি! এরকমই আমাদের ক্রিকেট প্রেম! এরকমই আমদের ক্রিকেট সংস্কৃতি। সারা বছর পরে দুইটা ঈদ কিংবা আরো অনেক উৎসবের চেয়েও আমাদের নিত্য দিনের উৎসবের নাম ক্রিকেট। ক্রিকেট যেন আমাদের সাধারন একটা দিনকেই করে দেয় অসাধারন! গরম হাওয়ার দিনে ছড়িয়ে দেয় সুবাশিত স্নিগ্ধ পরশ!!!
ঈদ সংক্রান্ত ভয়ংকর একটা কান্ডের কথা বলে লেখার ইতি টানছি! এই শতাব্দির শুরুর দিকের ঘটনা।সাল টা খুব সম্ভবত ২০০১-০২ হবে। ২৯ রমজান চলছে।যথারীতি মাগরিবের নামায পরে আকাশের পানে চেয়ে চিকন চাদের খোজে ব্যস্ত সবার দু চোখ। ঈদের চাদ কেন যানি খুব বেয়াড়া হয়! সবাই মিলে খুজেও যেন কোথাও পাওয়া যায়না! পরিশেষ দেখা যায় তিনি লুকিয়ে আছেন দুরান্তের কোন গাছের পাতার ফাকে।তবে সেবার আর সেরকম হলো না। চাদের খোজ না পেয়ে টেলিভিশনেও ঘোষনা করা হলো আগামিকাল ঈদ হচ্ছেনা! সেই অনুযায়ী মসজিদে মসজিদে আদায় করা হলো তারাবির নামায। ঘরে ঘরে প্রস্তুতি রমজানের শেষ সেহেরি করার।মুসল্লিরা খুব খুশি,ছোট বাচ্চারা ততোধিক দুঃখিত। এই রকম শান্ত নিরুব্দেগ অবস্থার মাঝে গঠলো সেই অঘটন!
বিটিভির রাত দশ টার ইংরেজি খবরের সংবাদ পাঠিকা নিউজের শেষ দিকে ইংরেজি পড়তে পড়তে হঠাৎ করে আজব বাংলা ভাষায় বলে উঠলেন "শাওয়াল মাসের চাদ দেখা গেছে! আগামি কাল পবিত্র ঈদুল ফিতর!" দাবানলের মত সেই ঘোষনা ছড়িয়ে পড়লো বাংলাদেশ! ওই রাতেই পাগলের মত মানুষ ছুটে পড়লেন শেষ মুহুর্তের কেনাকাটায়। টাকা পয়সার টানাটানিতে কেউবা বেরিয়ে পড়লেন ধারের খোজে।রাস্তা ঘাট অচল হয়ে গেলো আচমকা সৃষ্টি হওয়া মানুষ, গাড়ির জ্যামে! কিন্তু কারো মাঝেই নেই সরকার বিরোধি বক্তব্য কিংবা দুঃখ বোধ! হঠাৎ পাওয়া এই আনন্দ যেন ছাপিয়ে গিয়েছিল সকল ভোগান্তি,দুঃখ,অনুযোগ কে!

বাংলাদেশের মানুষ আসলে এরকমই! সব কিছু ভুলে গিয়ে ভালোবাসাতে আবদ্ধ হওয়াটাই যেন আমাদের রীতি! সেটা ক্রিকেট হোক বা উৎসব!সব কিছুতেই আমরা আছি প্রবলভাবে! ঈদ মোবারাক!

আপনার মন্তব্য