প্রকাশিত: ২০১৫-০৭-১৯ ০১:৫৯:২৯
প্রচ্ছদ: মোবাশ্বির আলম মজুমদার
বসনা উপন্যাস মূলত ইতিহাস প্রধান। বসনিয়া যুদ্ধ ও জীবন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। লেখার পরতে পরতে ফুটে:
২২ নভেম্বর ১৯৬৩
তার্কিশ এয়ারলাইন্সে দীর্ঘ বাঁইশ ঘণ্টার জার্নি। প্রথমে কাঠমান্ডু টু ইস্তাম্বুল। পরে কানেক্টিং ফ্লাইটে ইস্তাম্বুল টু বেলগ্রেড। কাঠমান্ডু’র চেয়ে বেলগ্রেডে’র বাতাস অনেক বেশি হিম। অনেকটা কাঠমান্ডু’র ডিসেম্বর-জানুয়ারি’র মত ঠান্ডা। নভেম্বর মাসেই এখানে তুষার পড়ার লক্ষণ স্পষ্ট।
গতকাল সন্ধ্যায় যখন কাঠমান্ডু’র ত্রিভূবন বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়েছিলাম, তখনো মনে হয়নি নভেম্বরেই বেলগ্রেডে এমন শীত পড়ে। এ কারণেই হয়তো ইউরোপ শীতপ্রধান দেশ। বেলগ্রেড স্কুল অব মেডিসিনের একটি মাইক্রোবাস এয়ারপোর্টে আমাকে নিতে এসেছিল। একজন ড্রাইভার আর একজন স্কুল অব মেডিসিনের অফিসিয়াল। তাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করে মাইক্রোবাসে উঠলাম।
বেলগ্রেডের রাস্তা কাঠমান্ডু’র চেয়ে বেশ প্রসস্ত। বেলগ্রেড অনেক পুরাতন শহর। কিন্তু নগরের সবকিছু বেশ পরিপাটি। বেলগ্রেড স্কুল অব মেডিসিনের ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে আমাদের মাত্র চল্লিশ মিনিট লাগল। অফিস বিল্ডিংয়ে কিছু অফিসিয়াল ফরমালিটিস শেষ করে আমাকে হোস্টেলে নিয়ে গেলেন অন্য আরেকজন অফিসিয়াল।
হোস্টেলের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীরা তখন হলরুমে টিভি দেখছিল। আমার সঙ্গে যিনি হোস্টেল পর্যন্ত আসলেন, তিনিও টিভি রুমে যাবেন। আমিও টিভি দেখব কিনা, তিনি জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে জানতে চাইলাম, এতো সকালে সবাই টিভিরুমে ওমন ভীড় করে কি দেখছে?
সারা পৃথিবীর মানুষ টেলিভিশন আর রেডিওতে যে খবর শোনার জন্য ভারী উৎসুক অথচ আমি তার কিছুই জানি না। অফিসের লোকটি তখন বুঝলেন, আমি সম্ভবত খবরটি জানি না। বললেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডিকে মেরে ফেলেছে। আমি বড় ধরনের একটা ধাক্কা খেলাম। এতোবড় একটা খবর অথচ আমি একদম জানি না।
লোকটির সঙ্গে আমিও তখন হলরুমে গেলাম। টেলিভিশনে মাত্র তিন মিনিটের ফুটেজ বারবার দেখাচ্ছে। টেক্সাসের ডালাস লাভ ফিল্ড এয়ারপোর্ট থেকে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি, ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডি, ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বাইনেস জনসন, সেকেন্ড লেডি বার্ড টেলর জনসন, টেক্সাস গভর্নর জন কোনালি, গভর্নরের স্ত্রী নেলি কোনালি মটর শোভাযাত্রা করে ডালাস ট্রেড মার্ট যাচ্ছিলেন। ট্রেড মার্টে টেক্সাসের সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট মধ্যাহ্নভোজে মিলিত হবেন।
ডালাস লাভ ফিল্ড থেকে ট্রেড মার্টের দূরত্ব মাত্র দশ মাইল। কিন্তু ডালাসের সকল স্তরের মানুষ যাতে প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাতে পারে, সেজন্য মটর শোভাযাত্রা খুব ধীরে ধীরে যাচ্ছিল। আর এজন্য সময় বরাদ্ধ মাত্র ৪৫ মিনিট।
টেক্সাসের প্রচলিত প্যারেডের নিয়ম হল- মটর শোভাযাত্রা ডাউন টাউনে প্রবেশের পর মেইন স্ট্রিটের কান্ট্রি ক্রিমিনাল কোর্ট বিল্ডিং ও ওল্ড কোর্ট হাউজের মাঝখান থেকে একটু সামনে গিয়ে সোজা মেইন স্ট্রিট ধরে না গিয়ে ডানে টার্ন করে।
তারপর হিউস্টন স্ট্রিট ধরে টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আবার বামে টার্ন করে। তারপর এলম স্ট্রিট ধরে আবার মেইন স্ট্রিট দিয়ে যায়। অনেকটা পশ্চিম দিক থেকে বৃত্তের কেন্দ্রে এসে হিউস্টন স্ট্রিট ধরে দক্ষিণের একেবারে টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আবার বামে টার্ন করে। এরপর এলম স্ট্রিট ধরে বৃত্তাকার পথে উত্তরে এগিয়ে আবার মেইন স্ট্রিটে গিয়ে সোজা পূর্বের দিকে চলে যাওয়ার মত।
হিউস্টন স্ট্রিটে প্রবেশের পর প্রেসিডেন্টের মটর শোভাযাত্রা মাঠের একেবারে শেষ প্রান্তের টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিংয়ের সামনে এসে বামে টার্ন করার জন্য অনেকটা স্লো হয়েছিল। ঠিক যেখানে হিউস্টন স্ট্রিট ও এলম স্ট্রিটের টর্নিং পয়েন্টে টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিং। তার ঠিক উল্টোপাশে অর্থ্যাৎ হিউস্টন স্ট্রিটের ডানপাশের কর্নারের বিল্ডিং হল ডিলে প্লাজা। টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিং আর ডিলে প্লাজা ঠিক মুখোমুখি।
প্রেসিডেন্টের মটর শোভাযাত্রার একেবারে সামনের গাড়িটি একটি সাদা ফোর্ড গাড়ি। সেই গাড়িতে ড্রাইভিং সিটে ডালাসের পুলিশ চিফ জ্যাসি কারি। ডান পাশের সিটে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট উইন স্টন লাসোন। পেছনের সারিতে বামপাশের সিটে ডালাসের কাউন্টি শেরিফ বিল ডেকার ও ডানপাশের সিটে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট ফরেস্ট সরেলস। দ্বিতীয় গাড়িতে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি।
প্রেসিডেন্টশিয়াল লিমুজিন যার লিংকন কনটিনেন্টাল কোড এসএস-১০০-এক্স। প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি’র গাড়িতে একেবারে সামনের সারিতে বামপাশের ড্রাইভিং সিটে সিক্রেট সার্ভিস এজেন্ট উইলিয়াম গ্রিয়ার ও ডানপাশের সিটে অ্যাডভান্স এজেন্ট ও স্পেশাল এজেন্ট ইন চার্জ মিস্টার রয় কেলারমান। মাঝখানের সারিতে বামপাশের সিটে টেক্সাসের ফার্স্ট লেডি নেলি কোনালি ও ডানপাশের সিটে টেক্সাসের গভর্নর জন কোনালি। একেবারে পেছনের সারিতে বামপাশের সিটে ফার্স্ট লেডি জ্যাকুলিন কেনেডি ও ডানপাশের সিটে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি।
প্রেসিডেন্টের লিমুজিন গাড়ির হুড ছিল খোলা। রাস্তার উভয় পাশের মানুষ প্রেসিডেন্টের উদ্দেশে হাত নাড়ছিল। প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি হাত নেড়ে নেড়ে তাদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করছিলেন। প্রেসিডেন্টের গাড়ির উভয় পাশে মটর সাইকেল এসকর্ট। প্রতিপাশে দুটি করে মটর সাইকেল।
প্রেসিডেন্টের লিমুজিনের বামপাশে সামনের মটর সাইকেলে ডালাস পুলিশ অফিসার বিলি জয় মার্টিন ও পেছনের মটর সাইকেলে ডালাস পুলিশ অফিসার রবার্ট ডব্লিউ ববি হারগিস। প্রেসিডেন্টের লিমুজিনের ডানপাশে সামনের মটর সাইকেলে ডালাস পুলিশ অফিসার জেমস এম চ্যানে ও পেছনের মটর সাইকেলে ডালাস পুলিশ অফিসার ডগলাস এল. জ্যাকসন।
তৃতীয় গাড়িটি প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা ফলো-আপ গাড়ি। যার কোড নাম হাফব্যাক। যার ড্রাইভার এজেন্ট সাম কিনে, ডানপাশের সিটে অ্যাডভান্স এজেন্ট ও এসিসট্যান্ট স্পেশাল এজেন্ট ইন চার্জ মিস্টার ইমোরি রবার্টস। লেফট ফ্রন্ট রানিং বোর্ড এজেন্ট ক্লিন্ট হিল ও লেফট রিয়ার রানিং বোর্ড এজেন্ট উইলিয়াম টি. ম্যাকইনটায়ার। রাইট ফ্রন্ট রানিং বোর্ড এজেন্ট জ্যাক রেডি ও রাইট রিয়ার রানিং বোর্ড এজেন্ট পল লান্ডিস। গাড়ির মাঝের সারিতে বামপাশের সিটে প্রেসিডেন্টিয়াল এইড কেনেথ ও’ডোনেল ও ডানপাশের সিটে প্রেসিডেন্টিয়াল এইড ডেভিড পাওয়ারস। গাড়ির একেবারে পেছনের সিটের বামপাশে ড্রাইভার এজেন্ট জর্জ হিকে ও ডানপাশের সিটি এজেন্ট গ্লেন ব্যানেট।
এরপর ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসনের ভাইস প্রেসিডেন্টশিয়াল লিমুজিন গাড়ি। যার একেবারে সামনে বামপাশের ড্রাইভিং সিটে পুলিশম্যান হার্সেল জ্যাক ও ডানপাশের সিটে এজেন্ট রুফুস ইয়ংব্ল্যাড। পেছনের সিটে বামপাশে সিনেটর রালফ ইয়ারবারাঘ, মাঝখানের সিটে সেকেন্ড লেডি বার্ড টেলর জনসন ও ডানপাশের সিটে ভাইস প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন।
এরপর ভাইস প্রেসিডেন্টের ফলো-আপ গাড়ি, যার কোড নাম ভার্সিটি। যার ড্রাইভিং সিটে একজন টেক্সাস স্টেটের পুলিশম্যান, সামনের সিটের মাঝখানে ভাইস প্রেসিডেন্টশিয়াল এইড ক্লিফ কার্টার ও ডানপাশের সিটে এজেন্ট জেরি কিভেট। পেছনের সারিতে বামপাশে এজেন্ট উডি টেলর ও ডানপাশের সিটে এজেন্ট লেম জন্স।
এরপর প্রেস পুল কার। যার ড্রাইভিং সিটে টেলিফোন কোম্পানির ড্রাইভার। সামনের সারির মাঝখানের সিটে ইউপিআই ম্যারিম্যান স্মিথ ও সামনের ডানপাশের সিটে হোয়াইট হাউজের এসিস্ট্যান্ট প্রেস সেক্রেটারি ম্যালকম কিলডুফ। পেছনের সারিতে বামপাশের সিটে এপি’র সাংবাদিক জ্যাক বেল, মাঝখানের সিটে ডালাস মর্নিং নিউজের সাংবাদিক রবার্ট বাসকিন ও ডানপাশের সিটে এবিসি’র সাংবাদিক বব ক্লার্ক।
আর মটর শোভাযাত্রার একেবারে পেছনের গাড়িটিও প্রেসের। ডালাস টাইমস হেরাল্ডে’র বব জ্যাকসন, ডালাস মর্নিং নিউজের টম ডিলার্ড ও ডব্লিউএফএএ টিভি’র মাল কোচ।
টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিং আর ডিলে প্লাজা’র সামনে থেকে এলম স্ট্রিট ধরে মটর শোভা যাত্রা মেইন সড়কে যাবে। জায়গাটা অনেকটা ইংরেজি ওয়াই অক্ষরের মত। মটর শোভাযাত্রাটি ওই পয়েন্টে টার্ন করার সময় আরো স্লো হল। ঠিক তখনই ডিলে প্লাজা থেকে প্রেসিডেন্টের উপর স্নাইপার রাইফেল দিয়ে গুলি চালানো হল।
২২ নভেম্বর ১৯৬৩ সালের দুপুর ১২ টা ২৯ মিনিটে প্রেসিডেন্টের মটর শোভাযাত্রা ৯০ ডিগ্রি এঙ্গেলে মেইন স্ট্রিট থেকে টার্ন করে হিউস্টন স্ট্রিটে পৌঁছাল। দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিটে প্রেসিডেন্টের লিমুজিন টেক্সাস স্কুল বুক ডিপোজিটরি বিল্ডিংয়ের সামনে টার্ন নেবার জন্য আরো স্লো হল। আর ঠিক তখনই ডিলে প্লাজা থেকে প্রেসিডেন্টের উপর গুলি চালানো হল। প্রথম গুলি লাগে প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি’র ডান চোয়ালে। আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড পরের গুলিটি লাগে প্রেসিডেন্টের মাথার ঠিক ডানপাশে। প্রেসিডেন্টের গাড়ি থেকে ডিলে প্লাজার দূরত্ব মাত্র ২৭০ ফুট।
বেলগ্রেড নেমেই যেখানে আমার দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের জন্য একটু ঘুম নেবার কথা, সেখানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডিকে হত্যা করার সেই ফুটেজ দেখতে বসলাম টিভির সামনে। এভাবে যুগোশ্লাভিয়ায় আমার জীবনের প্রথম দিন শুরু হল।
ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা প্রথম পর্ব || ধারাবাহিক উপন্যাস: বসনা দ্বিতীয় পর্ব
আপনার মন্তব্য