মাসকাওয়াথ আহসান’র গল্প: চেয়ার চরিত

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-০২ ১৮:১১:৫৫

হাবুলের পত্রিকার গল্প লেখক গল্প লিখে চলে, রাগান্বিতার ব্যক্তিগত জীবনের কাসুন্দি যার সঙ্গে হাসপাতালের:

একটি চেয়ার ঘুরে ফিরে গ্রামবাসীর স্বপ্নের মধ্যে আসে। শোনা যায় এ গ্রামে একবার এক বৃটিশ সাহেব এসেছিলো। তারজন্য হাতির পিঠে করে একটি চেয়ার এসেছিলো। সেই প্রথম গ্রামবাসী পাটজাত ছালায় বসে চেয়ার দেখেছিল।

ছালার নীচে যেমন খড় বিচালী ছিলো; ঐ চেয়ারেও তেমনি গদি ফিট করা ছিলো। কিন্তু চেয়ার তো চেয়ারই; গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়ে এর উপকথা। বসতেও গদি, হেলানেও গদি, হাত রাখার হাতলেও গদি। সেই খানে পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে এক লাল-টমেটোর মত সাহেব বসেছিলো।

গরীব চাষী হাবুলুদ্দী জিজ্ঞেস করে হরেন হলদারকে, আল্লাহর আরশের মতন দ্যাখতে।
হরেন মাথা নেড়ে বলে, ঐ সাহেবই তো ভগবান। তুমি গোলার ধান পিইষা চাইল দিলা; আমি মাছ ধরলাম, আর ঠ্যাঙ্গের ওপর ঠ্যাং তুইলা চেয়ারে বইসা খাই্লো সাহেব। ভগবান খুশী হইলো; কিছু খাজনা মাফ হইলো; কিছু থাকলো। এতো ভগবানের লীলা।

সাহেব যাবার পরপরই গ্রামের ছুতারকে দিয়ে একটা চেয়ার বানিয়ে নেয় চেয়ারম্যান সাহেব। আগে সে শেতল পাটিতে বসতো। এখন চেয়ারে বসে। চেয়ারটা দেখতে সাহেবের চেয়ারের মতো অতো সুন্দর হয়নি। কিন্তু চেয়ার তো চেয়ারই।

গ্রামটা বৃটিশ শাসনমুক্ত হয়। কিন্তু চেয়ারে চেয়ারে ভরে যায় চারিদিকে। চেয়ারগুলো বৃটিশদের চেয়ারগুলোর মতই পায়ের ওপর পা তুলে বসে থাকা গম্ভীর মানুষে ভরে যায়। এই গ্রামখানি পড়েছিলো পূর্ব পাকিস্তানে। সেইখানে চেয়ার ছিলো কম। এই গ্রামের গাছ কেটে নিয়ে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চেয়ারের পর চেয়ার তৈরী হয়। ভারতেও থেমে নেই চেয়ার বিপ্লব।

পূর্ব পাকিস্তান চেয়ারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ারবাজদের ভাগিয়ে দেয়, দূরে গিয়া মর।
আপদ বিদায় হলে গ্রামের মানুষ হাফ ছেড়ে বাঁচে। যাক স্বাধীন বাংলাদেশে এবার হয়তো চেয়ারের অত্যাচার কমবে। কারণ একটু লেখাপড়া শিখলেই মানুষ চেয়ারে বসে, একটু টেকাটুকা হলে মানুষ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে। দুইদিন আগের গরীব চাষা হাবুলুদ্দী কটা পয়সার মুখ দেখে এখন চেয়ারের গরম দেখায় গ্রামবাসীকে। সে তার স্ত্রী জ্যোতস্নার জন্যেও একটা চেয়ার বানায়। জ্যোতস্না স্নো-পাওডার মেখে সেজেগুঁজে চেয়ারে বসে থাকে। হাবুলুদ্দী বলে, আমি তো ব্যবসা বাণিজ্য করি; তোমারে ভাবতেছি ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বর কইরা দিমু। জ্যোতস্না আনন্দ লুকাতে ঘরে গিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখে। চোখ দুটো ভরত নাট্যমের মত এদিক-ওদিক ঠেলে দেয় কর্ণিয়াগুলোকে।

হরেনের দিনও বদলেছে। সে আর মাছ ধরেনা। এখন মাছের ব্যাপারী হয়েছে সে। মেয়েকে ডাক্তারী পড়িয়েছে। এখন সে কী একটা পরীক্ষা দিলেই গ্রামের হাসপাতালে একটা চেয়ার পেয়ে যাবে। চেয়ারে বসা প্র্যাকটিসের জন্য একটা চেয়ার কিনেও দিয়েছে। মেয়ে সারাদিন চেয়ারে বসে থাকে। অন্য কারো সেখানে বসতে মানা। সবাই কী চেয়ারে বসতে পারে!

দেখতে দেখতে গ্রামটা একটা ছোট শহর হয়ে ওঠে। আর শহরজুড়ে শুরু হয় চেয়ারের দাপট। চেয়ারতন্ত্রে চেয়ারম্যান মেম্বর ইলেকশনকে কেন্দ্র করে শহরে নানারঙ্গের পলিটিক্যাল পার্টি হয়। সেই পার্টি ক্যাডাররা লোকের জমি দখল করে পার্টি অফিস খুলে সেখানে চেয়ার পেতে পা ফাঁক করে বসে থাকে। পায়ের কাছে বসে থেকে তার অনুসারীরা ভাবে, চেয়ারে বসছে, কিন্তু চেয়ারে বসার কেতা শেখে নাই।

হাবুলুদ্দী চালাক মানুষ। যুগের ভাও সে বোঝে। একটা পত্রিকা অফিস খুলে। সেখানে সাংবাদিকের চেয়ারে বসিয়ে দেয় কিছু লোক যারা খুব পেট বানিয়ে বানিয়ে গল্প বলতে পারে। সাংবাদিকদের চাকরীর ইন্টারভিউ নেবার সময় ধারাবাহিক পেট বানিয়ে গল্প বলাটাই ছিলো পরীক্ষার বিষয়।

হাবলুর টেকাটুকা আছে, সংবাদপত্র আছে, সুতরাং জ্যোতস্নাকে চেয়ারসভার মেম্বর বানিয়ে দিতে খুব অসুবিধা হয়না তার। জ্যোতস্না আনন্দে আকাশে উড়তে থাকে যেন একটা চেয়ারসহ।
জীবন সবসময় সুখের হয়না। দলের ক্যাডারদের অন্তর্দ্বন্দ্বে এক চেয়ারঅলা ক্যাডার আহত হয়ে হাসপাতালে যায়।
হরেনের মেয়ে ডা রাগান্বিতা হাসপাতালে ডাক্তার হয়ে এসে একটা চেয়ারে বসেছে। সে গম্ভীর থাকে। শিক্ষিত মানুষকে গম্ভীর থাকতে হয়।

হুড়মুড় করে ক্যাডাররা একটা চেয়ারে বসিয়ে আহত ক্যাডারকে হাসপাতালের জরুরী বিভাগে নিয়ে আসে। তবে ডা রাগান্বিতার চোট পাটে চুপসে যায়। ডাক্তারের হাতে রোগীর জীবন। সুতরাং এইখানে মাস্তানী দেখাইয়া লাভ নাই।
ডা রাগান্বিতা ওয়ার্ডে চলে যায় অসুস্থ রোগীটিকে দেখতে।

এরমধ্যে মেম্বর জ্যোতস্না হাসপাতালে আসে। তাকে দেখেই ক্যাডারগুলোর চুপসে যাওয়া মুখগুলো আবার উদ্ধত হয়ে ওঠে।
কে একজন চিৎকার করে, নেত্রীরে বইতে দে।
ডাক্তারের চেয়ারে বসে মেম্বর অপেক্ষা করে ডাক্তারের জন্য। একজন ক্যাডার একটু ফুলিয়ে দিতে বলে, নেত্রী আপনে ডাক্তার হইলেও খুব মানাইতো।
জ্যোতস্না মেম্বর হাসে। একটু পরে মনে পড়ে হাসপাতালে সে একজন রোগী দেখতে এসেছে। সুতরাং গম্ভীর হয়ে যায়। আর চেয়ারে বসলে গম্ভীর তো হতেই হবে।

এর মধ্যে ডা রাগান্বিতা এসে জ্যোতস্না বেগমকে চেয়ারে দেখেই চটে যায়। মনে হয় যেন তার শাশুড়ী এসে বসে আছে তার চেয়ারে। এতো বড় কথা! ডাক্তারের চেয়ারে অন্য কেউ বসবে কেন!
জ্যোতস্না বেগম বলে, আমি মেম্বর; আমার আরো বড় চেয়ার আছে; এতো গোস্বা হও কা!
শুরু হয়ে যায় টেলিভিশন নাটকের বউ-শাশুড়ী ঝগড়ার এপিসোড।
জ্যোতস্না বেগম মুখ ঝামটা দিয়ে ক্যাডার ডাকে, আমার পত্রিকার সাংবাদিকগুলি মরছে নাকি! অগো লেলাইয়া দে; দেহি এই রাগান্বিতা বেয়াদ্দপের চাকরী থাকে ক্যামনে!

পত্রিকার বার্তা সম্পাদকের চেয়ার নড়ে ওঠে; ডোমিনো এফেক্টে একজন গল্প প্রতিবেদক ঘটনাটি নিয়ে একটি গল্প লেখে। এই গল্পের ভিলেন ডাক্তার রাগান্বিতা আর অপমানিত মহল্লার মুরুব্বাইন জোতস্না মেম্বর।
পত্রিকায় ঝগড়া-ফিকশান প্রকাশিত হলে, হাসপাতালে এসে রাগান্বিতাদের ধমক খাওয়া রোগীরা আক্রোশে ফুঁসে ওঠে। তাদের চেয়ার নেই। কিন্তু রাগ তো থাকতেই পারে। কতই আর ডাক্তারের ‘ঝাড়ি’ শোনা যায়।

শহরের শিক্ষিত ডাক্তার সমাজ যে যার চেয়ারে বসে বলে, রোগীরা অশিক্ষিত ওদের ঝাড়ি দেয়া দরকার আছে। রাগান্বিতার দোষ নেই। সব দোষ জ্যোতস্না বেগমের। এইরকম গরীব শহরে এতো লোকের চিকিতসা করা অসম্ভব। তবে ক্লিনিকে আসলে চেষ্টা করে দেখা যাবে, এটা তারা অবশ্য মনে মনে বলে।

এক ডাক্তার ঝাড়ি দিয়ে বলে, এরা সমালোচনা করার নর্মস জানেনা। এরা সিভিলাইজড হবে কবে; আমি কী দেখে যেতে পারবো!
ওদিকে বসে নেই জ্যোতস্না মেম্বর। ভাইস চেয়ারম্যানের কাছে নালিশ দেয়, কাছিম ভাই, একটা ডাক্তার আমার লগে বেদ্দপি করছে।
কাছিম ভাই তার বৃহদাকার চেয়ারের হাতলের বাঘের মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বলে, বরখাস্ত!

বরখাস্ত হয়ে যায় রাগান্বিতা সাময়িকভাবে। ডাক্তাররা ক্রোধে অভিমানী হয়। এতো কষ্ট করে থ্যাংকলেস জব করি, তার ওপর এই অপমান! ভুলে যায় গরীব কৃষক-শ্রমিকের টাকায় তারা ডাক্তার হয়; তাই এদের ঝাড়ি না দিয়ে চিকিতসা দেয়াকেই থ্যাংকস গিভিং বলা হয়।

হাবুলের পত্রিকার গল্প লেখক গল্প লিখে চলে, রাগান্বিতার ব্যক্তিগত জীবনের কাসুন্দি যার সঙ্গে হাসপাতালের চেয়ার বিষয়ক বচসার কোনই সম্পর্ক নেই; সেগুলো লিখে জ্যোতস্না বেগমকে খুশী করে। রাগান্বিতা বরখাস্ত হবার পর জ্যোতস্না মেম্বরের রাগ খানিকটা কমে। কিন্তু ছোট্ট শহর আর নিকটবর্তী গ্রামাঞ্চলে এটা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়, বাঘে ছুঁলে ছাড়ে, কিন্তু মেম্বর-চেয়ারম্যান ছুঁলে ছাড়ে না।

শিশুদের তখন চেয়ারের ভয় দেখালে তারা ঘুমিয়ে পড়ে। চেয়ার দেখলেই কেউ বসে থাকুক বা না থাকুক; মানুষ তাকে সালাম দেয়।

আপনার মন্তব্য