পথিক বাঘ, তুমি কী পথ হারাইয়াছো!

মাসকাওয়াথ আহসান

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-০৫ ১২:২৩:০৮

 আপডেট: ২০১৫-০৮-০৫ ১৩:১৬:০২

অভিবাসী বাঘের দলটি বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে শেষবার তাকিয়ে চোখ মুছে ভারতে চলে যায়। ভারতের বাঘেরা তাদের:

দীর্ঘদিন ধরে বাঘ সম্প্রদায়ের মাঝে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছে। সুন্দরবনের বাঘ সম্প্রদায়ের সভাপতি একটি জরুরী বৈঠক ডাকে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম প্রাণী বাঘ গোত্রটিই বিলুপ্ত হবে। সব কিছুর একটা সীমা আছে। এবার একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবেই। বৈঠকে যোগ দিতে বাঘেরা সবাই আসে।

বাঘদের একজন ইতিহাসবিদ কী নোট পেপার উপস্থাপন করে। সৌদী আরবের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্কই বাঘ বিলুপ্তির প্রধান কারণ। সৌদী শেখদের শখ তাদের বাড়ীতে একটি বাঘের চামড়া টাঙ্গানো থাকবে দেয়ালে। আর যেহেতু তাদেরকে হারেমে পারফর্ম করতে হয়, তাই বাঘের শরীরের একটি বিশেষ অংশ তারা খায়। এজন্য পুরুষ বাঘদের হত্যার প্রবণতাই বেশী দেখা গেছে। দক্ষিণপন্থী দল ক্ষমতায় থাকার সময় নিয়মিত সৌদী আরবে ব্যঘ্র চামড়া ও ব্যঘ্র শরীরের বিশেষ একটি অংশ বয়েমে করে উপহার হিসেবে পাঠানো হতো। কখনো কখনো জ্যান্ত বাঘ দিয়ে এসেছে নজরানা হিসেবে।

পরে দিন বদলের সরকার ক্ষমতায় এলে বাঘ সমিতির আশা ছিলো এবার আর ভয় নেই। কীসের কী। অরণ্যমন্ত্রী ছোট সৌদী আরব হাটহাজারীতে নজরানা পেশ করা লোক। উপরন্তু এমন এক গুণধর নৌমন্ত্রী তার ঠিক করে দেয়া রুটে করে পণ্য বহন করতে গিয়ে পুরো সুন্দরবন মাখিয়ে ফেললো পেট্রোলে। পেট্রোলবাহী নৌযান ডুবে একাকার কান্ড। সুন্দরবনের খালগুলোর বিশুদ্ধ পানি দূষিত হয়ে গেলো। সেই দূষিত পানি পান করে বেশ কিছু ব্যঘ্র শিশুর মৃত্যু হলো। অনেক বাঘিনীই বললো, অনেক হয়েছে। বাচ্চাদের এমেরিকা-ক্যানাডায় পাঠানোর ব্যবস্থা করো। এতোদিন বাঘগিরি করেছো। এবার সন্তানদের জন্য কিছু করে দেখাও।

কিন্তু সেতো সহজ কথা নয়। এমেরিকা-ক্যানাডায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ওপর কতজন এমফিল-পিএইডডি করলো। দাতাদের টেকাটুকায় পরিবেশ বিষয়ক এনজিও দোকান হলো। সেই দোকানের টাকায় এনজিও মালিকেরা বড়লোক হয়ে গেলো। কাজের মধ্যে দুইটা ডকুমেন্টারী বা কিছু ফটো শ্যুট। ‘বাঘ বাঁচাও আন্দোলনে’ বড় বড় লেকচার দিয়ে, টিভি-টকশোতে বাঘের জন্য কেঁদেকেটে অনেকে আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেলো।

এদিকে আরেক লঞ্চডুবিতে ইউরিয়া সার মাখামাখি হয়ে যায় সুন্দরবনের খালগুলোতে। এবার বিষাক্ত পানি পান করে কিছু বাঘিনীর মৃত্যু ঘটে। বাঘদের তো আর হারানোর কিছু রইলো না।

ওদিকে সুন্দরবনের কাছাকাছি কয়লা বিদ্যুৎ উতপাদন কেন্দ্র তৈরীর কাজ চলছে। বিদ্যুৎ উতপাদন করছে করুক। কিন্তু এই বিদ্যুৎ উতপাদনের জন্য কয়লা আসবে সুন্দরবনের মাঝ দিয়ে। তখন নিয়মিত কয়লা নৌকাডুবি হবে এটা বুঝতে তো আর বিদ্যুৎ উপদেষ্টা হওয়া লাগে না। ওদিকে এমেরিকা-ক্যানাডায় পিএইচডি করা লোকেরা সরকারের সুবাতাস পেতে যুক্তি দেখাচ্ছে, কয়লা খেলে বাঘের ক্ষতি হয়না; বরং চামড়ার ডোরাকাটা দাগের কালো রঙ ঘন হবে। ছবি সুন্দর আসবে।

পরিবেশ আন্দোলনের লোকজন কিছুদিন হৈ চৈ করেছে এ নিয়ে; তারপর চলে গেছে অন্য ইস্যুতে। ফলে বাঘদের চরম এই ক্রান্তিকাল অতিক্রমে বাঘদের নিজেদেরকেই কিছু করতে হবে।

মহল্লার মুরুব্বী বাঘেরা পরামর্শ দেয়, আমরা বুড়ো হয়ে গেছি; কদিন আর বাঁচি। কিন্তু যাদের বয়স কম তাদের এখন কেটে পড়াই ভালো। আগের অরণ্যমন্ত্রী বদলে নতুন যে অরণ্যমন্ত্রী হয়েছে সে ঝানু লোক। বাঘশুমারী সে করতে দেবে না। কারণ যে জানে টাইগার হলোকস্ট সম্পন্ন হয়েছে। বাঘিনী ও তাদের সন্তানরা কেউ বেঁচে নেই।
মুরুব্বীরা দুঃখ করে বলেন, আমাদের রয়েল বেঙ্গল পরিবারে বংশের বাতি দেবার আর যে কেউ-ই রইলো না।
সিদ্ধান্ত হয় শ’খানেক বৃদ্ধবাঘকে তাদের নিজ ভিটাতে স্বেচ্ছামৃত্যুর সুযোগ দিয়ে বাকী বাঘেরা ভারতের সুন্দরবনে চলে যাবে। এর আগে উভয় দেশের বাঘদের যৌথ সম্মেলনগুলোতে ভারতের বাঘদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছে। তারা বাংলাদেশের সুন্দরবনের খালে তেল ছড়িয়ে পড়ার পরেই অনেককে ভারতের সুন্দরবনে আশ্রয় নেবার অনুরোধ করেছিলো। তখন তাদের কথা শুনলে এতোগুলো বাঘ শিশু আর এরপর বাঘিনীদের মৃত্যু ঘটতো না।

অভিবাসী বাঘের দলটি বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে শেষবার তাকিয়ে চোখ মুছে ভারতে চলে যায়। ভারতের বাঘেরা তাদের স্বাগত জানায়। বাংলাদেশ থেকে আসা মন খারাপ করে বসে থাকা এক বাঘ দূরের পৈতৃক ভিটা আর শৈশব স্মৃতির দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়। এমন সময় এক স্নিগ্ধ বাঘিনী আচম্বিতে জিজ্ঞেস করে, পথিক বাঘ, তুমি কী পথ হারাইয়াছো!
দুখী বাঘ উত্তর দেয়, পথ ভুললে পথিক আর পথিক থাকে না হয় ক্লান্ত মানুষ।
বাঘিনী বাঘটাকে বলে, যা হারিয়ে গ্যাছে তা নিয়ে ভেবে যা আছে তাকে হারিয়ে ফেলোনা পথিক।
বাঘিনী রিনি হাসতে হাসতে চলে যায়। বাঘের বুকের মধ্যে একটা ভালো লাগার ভূ-কম্পন হয়।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঘদের সঙ্গে ভারতের বাঘদের জমপেশ আড্ডা হয়। পশ্চিমবঙ্গের এক বাঘদাদা বলেন, মানুষের জগতটাই যত ফোর টোয়েন্টি বুঝলে। এতো যে শক্তিশালী হয়েছে, আসুক না বন্দুক ছাড়া ওয়ান টু ওয়ান ফাইটে।
আরেকজন বলে, আমাদের বাঘেদের মাঝে যদি ধর্ম থাকতো, তাহলে কিন্তু বাংলাদেশের বাঘগুলো হিন্দুত্ববাদীদের কাছ থেকে পাঁচ লাখ রুপি করে কামিয়ে নিতে পারতো মুসলমান থেকে হিন্দু হবার একটা ঘোষণা দিয়ে।
সব বাঘ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
এক বিপ্লবী বাঘ বলে, ইচ্ছে করে লোকালয়ে ঢুকে সবগুলোকে কামড়ে দিয়ে আসি।
বিজ্ঞানী বাঘ বলে, মানুষ খুব বিষাক্ত প্রাণী। আজ পর্যন্ত যত বাঘ মানুষ খেয়েছে তারা অজানা ব্যাধিতে মারা গেছে; বা হিংসুটে মানসিক রোগের স্বীকার হয়েছে।

ঢাকায় বিশ্ব বাঘ দিবসে অরণ্য মন্ত্রীকে চেপে ধরে সাংবাদিকরা, সুন্দরবনে বাঘ বলতে আর কিছু নেই। শ’খানেক বাঘ আছে কীনা সন্দেহ!

অরণ্য মন্ত্রী স্ট্রিটস্মার্ট লোক। বিশ্বের হেন প্রশ্ন নেই; যার উত্তর উনার জানা নেই। দীর্ঘদিন নানা সরকারের মন্ত্রী হয়ে এটাকে সরকারী চাকরীর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন প্রায়। তাই তার ধারণা প্রেস হ্যান্ডলার হিসেবে তিনি অনন্য। একগাল হেসে বলেন, বাংলাদেশের বাঘেরা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে গেছে। বেড়িয়ে টেড়িয়ে আবার তারা ফিরে আসবে।

ওদিকে বাংলাদেশের পথিক বাঘ তখন প্রেমিক বাঘ। ভারতের প্রেমিকা বাঘিনীর সঙ্গে বসে কবিতার ছন্দে ছন্দে গল্প করে।
তুমি আছো তাই আমি আছি; বাকী জীবনটা যেন তোমার প্রেমের সান্নিধ্যে বাঁচি।
বাঘিনী মুখটা ভার করে বলে, তোমাদের অরণ্যমন্ত্রী বলেছে এ কেবলি বেড়াতে আসা; তবে কেন মিছে এই ভালোবাসা!
- বুড়ো মানুষ অনেক ভুলভাল বকে, তা নিয়ে তুমি কেন আকুল এ শোকে।
- কথা দাও যাবে না আমাকে ছেড়ে; এই ভূগোল এই মানচিত্র নেবে না তোমাকে কেড়ে!
- অরণ্যমন্ত্রীর পরী সংখ্যার বাঘ থাকবে ক্রিকেটারের জার্সিতে, ক্রিকেট ফ্যানের মুখমন্ডলে, পটে আঁকা বিলবোর্ডের ছবিতে, বিজ্ঞাপনে, চিড়িয়াখানায়, সবশেষে যাদুঘরে।
- আর তুমি থাকবে আমার ভালোবাসায়, সুখ-দুঃখ সবেতে আমার জীবন আলো করে।

বাঘিনী ম্যানগ্রোভ ফরেস্টে, সবুজ ছায়ার স্বচ্ছ খালের জলে সাঁতার কেটে আনন্দে সাংগ্রেই খেলে। বাঘকে মনোবাঘিনী লাস্যে জিজ্ঞেস করে, তুমি আসবে না; নেমে এসো বলছি।
বাঘ একটু ভয় পেয়ে যায়, কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে, খালের পানিতে পেট্রোল বা ইউরিয়া সার নেই তো!

আপনার মন্তব্য