প্রেম, দ্রোহ আর অসাম্প্রদায়িকতার কবি নজরুলের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

 প্রকাশিত: ২০১৫-০৮-২৭ ০২:৪৩:১৯

 আপডেট: ২০১৫-০৮-২৭ ১৯:২৯:৫০

সিলেটটুডে ডেস্ক:

‘মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান/মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ/এক সে আকাশ মায়ের কোলে/যেন রবি শশী দোলে/এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।’

'পুজিছে গ্রন্থ ভন্ডের দল! ...মুর্খরা সব শোনো/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ,- গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো’।

প্রেমের কবি, বিদ্রোহের কবি,সাম্যের কবি, অসাম্প্রদায়িকতার কবি, মানবতার কবি নজরুলকে বোঝার জন্য কিংবা বোঝানোর জন্য উৎকৃষ্ট উদাহরণ তার সৃষ্টি অসংখ্য এমন চরণ।

তার এক হাতে ছিল ‘বাঁকা বাঁশের বাঁশরী/ আর হাতে রণ-তূর্য।’ বিশ্ব মানবতার জয়গানে তার কণ্ঠ ছিল উচ্চকিত। মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাঁড়ি/চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি/ ভূ-লোক, দ্যুলোক, গোলক ভেদিয়া/ খোদার আসন আরশ ছেদিয়া’- ওঠার সংকল্প ঘোষণা করেছিলেন।

দ্রোহে ও প্রেমে, কোমলে-কঠোরে বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতে খুলে দিয়েছেন বিস্ময়কর নতুন দিগন্ত। প্রেম দ্রোহ সাম্য মানবতার কবি তিনি। তিনি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

বিস্ময়কর এই তূর্যবাদকের ৩৯তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৭৬ সালের এই দিনে চিকিত্সাধীন অবস্থায় তত্কালীন পিজি হসপিটালের ১১৭ নম্বর কেবিনে অনন্তের পথে যাত্রা করেন। সে দিন ছিল বাংলা ১২ ভাদ্র, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ।
 
দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও নজরুল কখনো আপস করেননি। ‘চির বিদ্রোহী বীর’, ‘চির উন্নত শির’-এর কবি মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ, বিত্ত-বৈভবের কাছে। আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন মানবতা আর শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য।

মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি ও চিন্তার পক্ষে কলম ধরেছেন নির্ভীক চিত্তে। ধূমকেতুর মতো উদয় হয়েছিলেন তিনি বাংলা সাহিত্য গগনে। মানবতার জয়গানে তিনি ছিলেন অভাবনীয় কণ্ঠ। লিখেছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান্...’। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্’ গানটি আমাদের রণসঙ্গীত।
 
অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে দুরন্ত এক শিশুর জন্ম ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ মে)। বাবা কাজী ফকির আহমেদ, মা জাহেদা খাতুন। নজরুল হয়ে উঠেছিলেন গোটা উপমহাদেশের মানুষের মুক্তি ও চেতনার কবি।

বঞ্চিত মানুষের পক্ষে কথা বলে, শোষকের রক্তচক্ষুকে ভ্রুকুটি করে অজেয় শক্তির লেখনী দিয়ে প্রতিবাদ গড়ে জেল খেটেছেন। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সব অবিচার-অনাচার-অন্যায়ের বিরুদ্ধে। কোনো কিছুই তাকে দমাতে পারেনি। ৪৩ বছর বয়স পর্যন্ত লিখেছেন দুহাতে। যেমন লেখাতে বিদ্রোহী, তেমনি জীবনেও।

১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসে নজরুল দুটি বৈপ্ল¬বিক সাহিত্যকর্মের সৃষ্টি করেন। একটি হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ও অপরটি ‘ভাঙ্গার গান’। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই বাংলা কাব্যে নতুন বাঁক, নতুন ধারা, নতুন মাত্রার বিস্ময় সৃষ্টি করেছিল। শুধু কবিতাতেই নয়, বাংলায় সঙ্গীত সৃষ্টিতে নজরুল অভূতপূর্ব প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি প্রায় পাঁচ হাজার সঙ্গীত রচনা ও সুর করেছেন। নিজেকে সম্পৃক্ত করেছেন ধ্রুপদী ধারার সঙ্গে। রাগনির্ভর গানকে ভেঙেচুরে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য ও শ্রুতিমধুর করেছেন। এক রাগের সঙ্গে অন্য রাগের মিলন ঘটিয়ে সঙ্গীতে এক নতুন ধারার সৃষ্টি করেছেন।

ছোটগল্প, উপন্যাস, গান, নাটক লিখলেও কবি হিসেবেই তিনি বিশ্ব পরিচিতি, বিশ্ব খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার অনন্য সৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছে। সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে কাজী নজরুল ইসলাম তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেননি।
 
নজরুল তদানীন্তন পূর্ববাংলায় তথা আজকের বাংলাদেশে এসেছেন অনেকবার। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুরে কৈশরের অনেকটা সময় কেটেছে তার। জীবনের মধ্যপথে তেজোদ্দীপ্ত কবি অকস্মাত্ নির্বাক হয়ে যান। চিরতরে মূক হয়ে পড়েন গানের পাখি। সময়টা ১৯৪২ সালের শেষার্ধ।
 
১৯৭২ সালের ২৪ মে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদ্যোগে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। তাঁকে দেয়া হয় জাতীয় কবির মর্যাদা। ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কাজী নজরুলকে ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে দেয়া হয় একুশে পদক।

কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তত্কালীন পিজি হাসপাতালে। ৭৭ বছর বয়সে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয় এ কবিকে।

আপনার মন্তব্য