বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-০৯ ০২:৪০:২৬

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

১২
দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই টমাস যদি এই সুইস ডাক্তারের প্রস্তাব বাতিল করে থাকে, সেটার কারণ আসলে তেরেজা। সে ধরেই নিয়েছিল, তেরেজা কখনোই দেশ ছেড়ে যাবে না। রুশ আগ্রাসনের প্রথম সপ্তাহ তেরেজা যেন একটা ঘোরের মধ্য দিয়ে তার সময় কাটিয়েছে, কারো সেটা মনে হতে পারে প্রায় সুখের মত। সারাদিন ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিল সে, ছবি তুলে তুলে রোল রোল ফিল্ম সে পাচার করেছে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে, আক্ষরিক অর্থেই, সেগুলো পাবার জন্য যারা যুদ্ধ করেছে নিজেদের মধ্যে। একবার তেরেজা বেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল, এক দল প্রতিবাদী জনতার দিকে পিস্তল তাক করা এক রুশ অফিসারের একটা ক্লোজ আপ ছবি তোলে তেরেজা। তাকে বন্দী করা হয় সাথে সাথেই এবং রুশ সামরিক হেডকোয়ার্টারের জেলে তাকে রাত কাটাতে হয় সেদিন। সেখানে তারা তাকে হুমকি দেয়, এরপর তাকে গুলি করে হত্যা করা হবে বলে, কিন্তু ছাড়া পাওয়ার পর পরই তেরেজা তার ক্যামেরা নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে পড়েছিল।

সে কারণে টমাস খুবই অবাক হয় যখন রুশ আগ্রাসনের দশম দিনে তেরেজা তাকে জিজ্ঞাসা করে, ‘তুমি কি কারণে সুইজারল্যান্ড যেতে চাচ্ছো না?’
‘আমি কেন যাবো?’
‘তোমার জন্য এখানে থাকাটা ওরা কঠিন করে ফেলবে’।
‘ওরা যে কারো জন্য এখানে থাকাটা কঠিন দিতে পারে’, টমাস হাত নাড়িয়ে কথাটার উত্তর দেয়, ‘আর তুমি’? ’তুমি বিদেশে থাকতে পারবে’?
’কেন না?’
’তুমি দেশের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছো প্রতিদিন, তুমি কিভাবে নির্বিকারভাবে দেশটাকে ছেড়ে যেতে চাচ্ছো?’
‘এখন যেহেতু দুবসেক (২০) ফিরে এসেছে, অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে’, তেরেজা বলে।

সত্যি, সপ্তাহের বেশী প্রাথমিক এই উল্লাস আর টেকে নি, রুশ সামরিক বাহিনী দেশের জনগণের প্রতিনিধি সব নেতাদের দল বেধে ধরে নিয়ে যায় অপরাধীদের মত। কেউ জানেনা তারা কোথায় এখন, ধারণা করা হচ্ছিল তারা বেঁচে নেই, রুশদের প্রতি ঘৃণা মানুষগুলোকে মাতাল করে রেখেছিল, মদের মত। সেটা ছিল মদমত্ত ঘৃণার উৎসব। চেক শহরগুলোর দেয়ালে শোভা বাড়িয়েছিল হাজার হাজার হাতে আঁকা পোষ্টার, যার মধ্যে ছিল ব্রেজনেভ ও তার সৈন্যদের অশিক্ষিতদের সার্কাস আখ্যা নিয়ে নানা তির্যক মন্তব্য, ব্যঙ্গাত্মক কবিতা আর কার্টুন। কিন্তু কোনো কার্নিভালই আসলে চিরকাল চলতে পারেনা। ইতিমধ্যেই রুশরা মস্কোতে ধরে নিয়ে যাওয়া চেক প্রতিনিধিদের জোর করেই একটা সমঝোতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করানো হয়। দুবসেক তাদের নিয়ে প্রাহাতে ফিরে আসার পর রেডিওতে একটি ভাষণ দেন, ছয় দিনের বন্দিত্ব তাকে স্পষ্টতই এক বিধ্বস্ত করেছিল, তিনি কোন শব্দ উচ্চারণ করতেই পারছিলেন না। বার বার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল তার, যেন শ্বাস নিতে পারছেন না, প্রতিটি ধীরে ধীরে উচ্চারিত বাক্যের মধ্যে ছিল দীর্ঘ বিরতি, কখনো প্রায় আধা মিনিট।

এই সমঝোতা দেশটিকে একটি খারাপ পরিস্থিতি এড়াতে সহায়তা করেছিল: কারণ সম্ভাব্য গণহারে হত্যা এবং সাইবেরিয়ায় লেবার ক্যাম্পে প্রেরণ করার সম্ভাবনা সবাইকেই আতঙ্কে রেখেছিল। কিন্তু একটা জিনিস স্পষ্ট হয়েছিল অবশেষে, সেটা হল, দেশকে এবার তার শক্তিশালী রুশ দখলকারীর প্রতি নতমস্তক হতে হবে। এবং চিরকালই হোঁচট খেয়ে চলতে হবে, তোতলাতে হবে, আলেক্সান্ডার দুবসেক এর মতই শ্বাস নেবার জন্য বাতাসের সংকটে পড়তে হবে। কার্নিভালের আনন্দ শেষ, দৈনন্দিন জীবনের অপমানের সূচনা হলো।

তেরেজা টমাসকে পুরো বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এবং টমাস জানে সব সত্যি। কিন্তু টমাস জানতো, এই সবকিছুর নীচে লুকানো আছে অন্য একটি, আরো মৌলিক সত্য, যে কারণ তেরেজা প্রাহা ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে: আসলে আগে এখানে সে কখনোই সুখী ছিলো না। যে দিনগুলোতে প্রাহার রাস্তায় রাস্তায় হেটে যে রুশ সৈন্যদের ছবি তুলেছিল সব বিপদের শঙ্কাকে তুচ্ছ করে, সেই দিনগুলোই ছিল তার জীবনের সেরা কয়টি দিন। সেই সময়টায় সেই টেলিভিশন সিরিজগুলোর মত তার দুঃস্বপ্নের ধারা ব্যাহত হয়েছিল এবং কিছু সুখের রাত অবশেষে সে কাটাতে পেরেছিল। রুশরা যেন তাদের ট্যাঙ্ক নিয়ে তার জীবনের ভারসাম্যও ফিরিয়ে দিয়েছিল, এখন যেহেতু এই কার্নিভাল শেষ, আবার দুঃস্বপ্নের ভয় তাকে আতঙ্কিত করে তুলছে, তেরেজা সেই পরিস্থিতি থেকে পালাতে চাইছিল। সেই পরিস্থিতিগুলোকে তেরেজা এখন চিনতে পেরেছে, যখন সে নিজেকে শক্তিশালী আর পূর্ণ অনুভব করে, এবং সে মনে

প্রাণে চাইছিল, দেশ ছেড়ে পৃথিবীর মুখোমুখি হয়ে অন্য কোথাও সেই পরিস্থিতিগুলোকে আবার খুঁজে নিতে।
টমাস শুধু জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার অস্বস্তি লাগছে না যে, সাবিনাও সুইজারল্যান্ডে চলে গেছে?’
‘জেনেভা তো আর জুরিখ না’, তেরেজা বলে, ‘প্রাহাতে সে যতটা ছিল ওখানে তার চেয়ে অনেক কম ঝামেলার কারণ হবে’।

যে মানুষটি তার বসবাসের জায়গা ছেড়ে চলে যাবার জন্য ব্যাকুল হয়, সে একজন দুঃখী মানুষ। একারণেই টমাস তেরেজার দেশ ছাড়ার ইচ্ছাটাকে মেনে নেয়, একজন অপরাধী যেমন তার শাস্তি মাথা পেতে নেয় এবং একদিন সে, তেরেজা এবং কারেনিন সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহরটিতে নিজেদের আবিষ্কার করে।

১৩
তাদের খালি ফ্ল্যাটের জন্য প্রথমে একটি বিছানা কেনে টমাস (তখনও তাদের অন্য কোনো আসবাব কেনার মত সঙ্গতি ছিল না) এবং চল্লিশ বছর বয়স্ক একজন মানুষের নতুন জীবন শুরু করার উন্মাদনায় তার পেশাগত কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

জেনেভাতে সে বেশ কিছু টেলিফোন করে। রুশ আগ্রাসনের এক সপ্তাহ পর ঘটনাচক্রে সেখানে সাবিনার একটি প্রদর্শনীরও উদ্বোধন হয়েছিল, এবং তার ছোট দেশের প্রতি সমবেদনার ঢেউ এ জেনেভার শিল্প রসিকরা তার সব চিত্রকর্মও কিনে ফেলেছিলেন।

টেলিফোনে হাসতে হাসতে সাবিনা বলে, ‘রুশদের কল্যাণে আমি এখন একজন ধনী মহিলা’; সে টমাসকে তার তার নতুন স্টুডিও দেখার আমন্ত্রণ জানায়, তাকে নিশ্চিত করে, প্রাহাতে সে যেমনটা দেখেছে, তার থেকে নতুন স্টুডিওটির খুব একটা ব্যতিক্রম হবে না। সাবিনার ওখানে বেড়াতে যেতে পারলে টমাস নিঃসন্দেহে খ্বুবই খুশী হত, কিন্তু তেরেজার কাছে তার হঠাৎ অনুপস্থিতির জন্য কোন অজুহাত খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছিল। আর সেকারণে সাবিনাই জুরিখে এসে থাকার জন্য একটি হোটেলে উঠেছিল। হাসপাতালের কাজ শেষে টমাস তার সাথে সেখানে দেখা করতে যায়। নীচের রিসেপশন ডেস্ক থেকেই প্রথমে সে উপরে ফোন করে জানায় সে এসেছে, তারপর তার রুমে যায়। যখন দরজা খোলে সাবিনা, টমাস তার সামনে সুন্দর দীর্ঘ পায়ের উপর সোজা হয়ে দাড়িয়ে থাকা সাবিনাকে দেখে , অন্তর্বাস ছাড়া যার পরণে আর কিছু নেই এবং একটি কালো বোওলার হ্যাট তার মাথায়।

সাবিনা নিশ্চুপ, স্থির হয়ে দড়িয়ে থাকে টমাসের দিকে একপলকে তাকিয়ে। টমাসও তাই করে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে, সাবিনা তাকে কত গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। সাবিনার মাথা থেকে বোওলার হ্যাটটি খুলে বিছানার পাশের টেবিলে রাখে সে,তারপর তারা সঙ্গমের গভীরে ডুবে যায় আর কোনো কথা না বলে।

হোটেল থেকে বের হয়ে তার ফ্ল্যাটে যাবার পথে (ততদিনে সেখানে কিছু চেয়ার, একটি টেবিল, কাউচ এবং কার্পেট যোগ হয়েছে) টমাস বেশ খুশীমনে ভাবছিল, শামুক যেমন তার খোলস রুপী বাসা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সেও তার নিজের জীবন ধারণের পন্থাকেও তার সাথে বহন করে নিয়ে বেড়াতে পারছে। তেরেজা এবং সাবিনা তার জীবনের দুটি বিপরীত মেরুকে নির্দেশ করছে, পৃথক এবং অসমন্বয়যোগ্য, অথচ সমানভাবে কাঙ্ক্ষিত।

কিন্তু সে যে তার জীবন ধারণের পন্থাকে তার শরীরের অংশর মতই তার সাথে সবজায়গায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এই সত্যটির আরেকটি অর্থ হলো তেরেজাও তার দুঃস্বপ্ন দেখা থেকে পরিত্রাণ পায়নি।

তখন জুরিখে তাদের ছয় বা সাত মাস হয়েছিল, একদিন যখন টমাস এক সন্ধ্যায় দেরী করে বাসায় ফেরে, সে টেবিলের উপর একটি চিঠি খুঁজে পায়, তেরেজা সেখানে তাকে জানায় সে প্রাহাতে ফিরে যাচ্ছে। সে চলে যাচ্ছে কারণ বিদেশে বসবাস করার মত শক্তি তার নেই। সে জানে তার উচিৎ ছিল টমাসকে সাহায্য করা, কিন্তু সে জানেনা কিভাবে সে কাজটা করবে। সে তার নির্বুদ্ধিতাকে স্বীকার করে নেয়, যখন সে ভেবেছিল, দেশের বাইরে গেলে হয়তো সে বদলে যাবে। সে ভেবেছিল রুশ আগ্রাসনের সময় তার অভিজ্ঞতা তাকে হয়তো বদলে দিয়েছে, ছেলেমানুষির খোলস থেকে বেরিয়ে এসে আরো বুদ্ধিমান এবং সাহসী, দৃঢ়চেতা হয়েছে সে, কিন্তু সে নিজের সম্বন্ধে শুধু উচ্চ ধারণাই পোষণ করেছে কেবল। টমাসের বোঝা সে বাড়িয়ে দিয়েছে, আর সে এই কাজটা করবে না। খুব বেশী দেরী হয়ে যাবার আগেই প্রয়োজনীয় এই উপসংহারটি সে টেনে দিতে চায় তাদের সম্পর্কে। সে ক্ষমা চায়, কারেনিনকে তার সাথে নিয়ে যাবার জন্য।

বেশ কিছু ঘুমের ঔষধ খাবার পরও সকালের আগে টমাসের ঘুম হয় না। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন ছিল শনিবার, সে বাসায় থাকতে পেরেছিল। প্রায় দেড়শ বার সে পুরো পরিস্থিতিটা নিয়ে সে ভাবে: তার নিজের দেশ এবং সারা পৃথিবীর মধ্যবর্তী সেই সীমানা আর আগের মত উন্মুক্ত নেই। কোনো টেলিফোন বা টেলিগ্রাম পারবেনা তেরেজাকে ফিরিয়ে আনতে। কর্তৃপক্ষ দেশের বাইরে আর কোথাও তাকে যেতে দেবে না। তেরেজার বিদায় ভয়াবহ রকমের সুনিশ্চিত।

[চলবে...]

আপনার মন্তব্য