গ্রন্থ আলোচনা- যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর বিচার : রায়ের পূর্ণ বিবরণ

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-১০ ০১:৩৬:৩২

রাজেশ পাল:

সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী।এদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বিতর্কিত যে কয়জন ব্যক্তি ছিলেন তাদের একজন ছিলেন তিনি।বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে চরম আপত্তিকর অশালীন উক্তি করে বারবার সংবাদ শিরোনাম হন তিনি। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরাজ্ঞান করা এই ব্যক্তিটির সম্প্রতি ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে। না, রাজনৈতিক কোন অপরাধ বা অপকর্মের কারণে নয়।তার ফাঁসি হয়েছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।

দেশের সবচেয়ে অভদ্র রাজনীতিবিদের তকমা পাওয়া এই ব্যক্তিটি জড়িত ছিলেন ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা খুন, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ প্রত্যেকটি অপরাধের সাথে জড়িত ছিলেন এই ব্যক্তিটি। কনভেনশনাল মুসলিম লীগের প্রবল প্রতাপশালী নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ২২ বছর বয়েসী এই জ্যেষ্ঠ সন্তান সেদিন পরিণত হয়েছিলেন মূর্তিমান এক আতংকে।সমগ্র চট্টগ্রামে কায়েম করেন এক ত্রাসের রাজত্ব।

স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে মুসলিম লীগ কনভেনশন মুসলিম লীগ, জামায়েতে ইসলামী, নেজামে ইসলামীর মতো ডানপন্থী দলগুলো পাকিস্তানের পক্ষ নেয়।রাজাকার,আলবদর,আলশামস,পিস কমিটি গঠন করে নির্যাতনের স্টিম রোলার চালায় মুক্তিকামী জনতার উপর। আর কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রধান নেতা ও আইয়ুব খানের বিশ্বস্ত সহচর ফকা চৌধুরীর ছেলে সাকা চৌধুরী পিতার রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী হিসেবে পাক বাহিনীর সহায়তায় হিন্দু সম্প্রদায় ও আওয়ামীলীগের নেতা কর্মীদের উপর মধ্যযুগীয় বর্বরতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। হিন্দুদের উপর তাঁর বিদ্বেষ ছিল পুরোপুরি রাজনৈতিক হিংসা প্রসূত। কেননা ৭০ এর নির্বাচনে তাঁর পিতা ফকা চৌধুরী এক তরুণ আওয়ামীলীগ নেতার কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।আর এই পরাজয়ের জন্য তাঁর পিতা দায়ী করেন তাদের নির্বাচনী এলাকার হিন্দু সম্প্রদায়কে।ভবিষ্যতে যাতে আর কোন নির্বাচনে পরাজিত হতে না হয়, সেই লক্ষ্য নিয়ে পুরো অঞ্চল হিন্দু নির্মূলে মেতে উঠেন তিনি।

নিজের হাতে গুলি করে হত্যা করেন কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের প্রতিষ্ঠাতা দানবীর নূতন চন্দ্র সিংহকে,গহিরার বনেদি বিশ্বাস পরিবারের ছেলে কলেজ ছাত্র হরি বিশ্বাস,চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শেখ মোজাফফর ও তাঁর ছেলে শেখ আলমগীরকে।মধ্যগহিরা হিন্দু পাড়া,গহিরা,জগতমোল্লাপাড়া,বণিকপাড়া,সুলতানপুর,উনসত্তরপাড়া,রাউজান পৌরসভা এলাকা,খাগড়াছড়ি রাঙামাটি সংযোগস্থলের তিন রাস্তার মোড়,হাজারী গলি, মোহরা গ্রাম, চট্টগ্রাম শহর ও বৃহত্তর চট্টগ্রামের অসংখ্য জায়গায় খুন ,ধর্ষণ, লুটতরাজের নেতৃত্ব দেন তিনি। চট্টগ্রামের গুডস হিলে গড়ে তোলেন টর্চার সেল।যেখানে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয় অসংখ্য মুক্তিকামী বাঙালীকে।

অত্যাচারে অতিষ্ঠ মানুষদের আহাজারিতে ক্ষিপ্ত হন মুক্তিযোদ্ধারা।তাকে হত্যার চেষ্টা চালায় একটি ছোট গ্রুপ।কিন্তু ভাগ্যক্রমে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েও বেঁচে যান তিনি।পালিয়ে যান পাকিস্তানে। ৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক সরকারের আনুকূল্যে আবারো দেশে ফিরে আসেন তিনি। ৭৮ সালে আবারো সক্রিয় হন রাজনীতিতে। অর্থ, বিত্ত, ক্ষমতার প্রভাবে একাধিকার সংসদ সদস্যও নির্বাচিত হন।এমনকি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়ার আনুকূল্যে ওআইসির সেক্রেটারি জেনারেল হওয়ার ও ব্যর্থ চেষ্টা চালান।

বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল ৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করা।নির্বাচিত হয়ে আওয়ামীলীগ সরকার সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে।দীর্ঘ তদন্তের পর জমা দেয়া হয় চার্জশিট।শুরু হয় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের অধীনে বিচারকর্ম।অকাট্য তথ্যপ্রমাণ ও চাক্ষুষ সাক্ষীদের জবানবন্দীর ভিত্তিতে দেয়া হয় রায়।মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় এই কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধীকে। রায়ের বিপক্ষে সর্বোচ্চ আদালতে করা হয় আপীল আবেদন, আপীলের রায়ের বিপক্ষে রিভিউ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাঁর। এতো বেশী সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থিত করে প্রসিকিউশান যে বেনিফিট অফ ডাউটের বিন্দুমাত্র সুযোগ ছিলোনা তাতে।

এদেশের আইনের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে রইবে সাকা চৌধুরীর এই রায়টি। খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্তভাবে এই রায়ের বিভিন্ন অংশ বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলেও পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশের পরে এর সম্পূর্ণ বঙ্গানুবাদ করার দুরূহ কাজটিতে হাত দেন কয়েকজন মেধাবী কলমযোদ্ধা।নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন সাক্ষীদের জবানবন্দী , ক্রস এন্ড কাউন্টার এক্সামিনেশান, আদালতের অবসারভেশন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অংশসমূহ। সম্পূর্ণ অনুবাদ কর্মটিতে সর্বমোট ১০ জন অংশ নেন। এদের মধ্যে ২ জন ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। বাকিরা হলেন আরিফ রহমান, আহমেদ রনি, সাব্বির হোসাইন, সুমিত রায়, সুবর্ণা সেঁজুতি, দেব প্রসাদ দেবু, কেশব কুমার অধিকারী এবং ফরিদ আহমেদ। সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলেন সাব্বির হোসাইন, দেব প্রসাদ দেবু, শারমিন আহমেদ, ইরতিশাদ আহমদ ও ফরিদ আহমেদ। উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন ইরতিশাদ আহমদ এবং প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন মুক্তমনা বাংলা ব্লগের মডারেটর ফরিদ আহমেদ।

বইটির প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী চারু পিন্টু। প্রকাশনায় পাললিক সৌরভ প্রকাশনীর দুই কর্ণধার মেহেদী হাসান শোয়েব ও তামান্না সেতু। বইটি বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ পাঠাগার ও গবেষণা কেন্দ্রের একটি প্রশংসনীয় প্রয়াস।

নুরেমবার্গ ট্রায়ালের উপর ভিত্তি করে রচিত বইগুলোর মতো এই বইটিও “লিগ্যাল ক্লাসিক” এর মর্যাদা পাবে বলেই আমি বিশ্বাস করি। ভবিষ্যতে বাংলা রেফারেন্স এবং ইতিহাস বিকৃতি রোধে বইটি অবশ্যই একটি মাইলফলক হিসেবেই বিবেচিত হবে। বইটিতে আইনগত পরিভাষা বা লিগ্যাল টার্মগুলোকে সঠিক ও সহজবোধ্য ভাষায় যে সুন্দর সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। বাংলাভাষায় এই ধরণের জাজমেন্ট-ভিত্তিক অনুবাদকর্ম খুব বেশী হয়নি।

বইটি উচ্চ আদালত থেকে প্রতিবছর যে লিগ্যাল ডাইজেস্টগুলো বের হয় সেগুলোও ইংরেজিতে হওয়ায় অনেকের কাছেই সুখপাঠ্য হয়ে ওঠেনা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে নির্ভুল আইনি প্রতিশব্দের এই সার্থক প্রয়োগ আসলেই অনন্য সাধারণ। সাক্ষীদের জবানবন্দীগুলো পড়ার সময়ে মনের পর্দায় ভেসে উঠে নূতন চন্দ্র সিংহ বা উনসত্তর পাড়ার শহীদদের বুলেটবিদ্ধ রক্তাক্ত মুখগুলো।কানে ভেসে আসে গুডস হিলের নির্যাতিতদের করুণ আর্তনাদ। নিজের অজান্তেই মন ফিরে যায় ৭১-এর সেই দিনগুলোতে।

পরিশেষে বইটির অনুবাদক, সম্পাদক, প্রকাশক সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শুভকামনা রইলো স্বল্পতম সময়ে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করার জন্য।ভবিষ্যতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মামলার রায়গুলোও তারা একইভাবে আমাদের নিকট উপহার দেবেন, একজন নগণ্য পাঠক হিসেবে সেই প্রত্যাশাই রইলো।

যুদ্ধাপরাধী সাকা চৌধুরীর বিচার : রায়ের পূর্ণ বিবরণ
সম্পাদনা : ফরিদ আহমেদ
প্রকাশক : পাললিক সৌরভ, ঢাকা।
প্রচ্ছদ : চারু পিন্টু
প্রথম প্রকাশ : ডিসেম্বর ২০১৫।

আপনার মন্তব্য