বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, কিস্তি ১৬-১৭

 প্রকাশিত: ২০১৬-০১-১৬ ২০:৩৬:০৩

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]

১৬
পারমেনিডিজ এর চেয়ে ব্যতিক্রমভাবেই বীটহোভেন ভারকে দেখেছিলেন ইতিবাচক দৃষ্টিতে। যেহেতু জার্মান শব্দ Schwer এর অর্থ ’ভার’ এবং ’কঠিন’, বীটহোভেন এর ’সুকঠিন সিদ্ধান্তকে’ অন্যার্থে বলা যেতে ‘ভারী বা গুরুভার’ একটি সিদ্ধান্ত হিসাবে। গুরুভার সিদ্ধান্তটি নিয়তির কণ্ঠস্বরের সাথে যেন একসুরে বলছে (es muss sein!); জরুরী প্রয়োজনীয়তা, ভার এবং মূল্য, এই তিনটি ধারণাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে: শুধুমাত্র জরুরী প্রয়োজনীয়তারই ভার আছে এবং ভার আছে এমন কিছুরই শুধু মূল্য আছে।

বীটহোভেনের সঙ্গীত এমন বিশ্বাসেরই জন্ম দেয় এবং যদিও আমরা ব্যাপারটি ( বা এর সম্ভাবনাকে)উপেক্ষা করতে পারিনা যে, এই ব্যাখ্যার সূত্র বীটহোভেন এর নিজের চেয়ে বরং তার ব্যাখ্যাকারীদের হবার সম্ভাবনাই বেশী, যে মতামত কম বেশী আমাদের সবারই:আমরা বিশ্বাস করি একজন মানুষের বিশালতা বা মহত্ব জন্ম নেয় যে বাস্তবতার মাধ্যমে সেটা হলো,সে তার নিয়তিকে বহন করে, যেমন পুরাণের অ্যাটলাস তার কাঁধে বহন করে এই মহাবিশ্ব। তাই বীটহোভেন এর নায়ক মেটাফিজিক্যাল গুরুভার বহনকারী একজন মানুষ।

টমাস সুইজারল্যান্ডের সীমান্তের নিকটবর্তী হতে থাকে। আমি কল্পনা করছি, বিষণ্ণ, মাথা ভর্তি এলোমেলো চুলের বীটহোভেন, সশরীরে স্থানীয় দমকল বাহিনীর একটি  ব্রাস ব্যান্ডের সঙ্গীত পরিচালনা করছেন, এই অভিবাসনের বিদায় উপলক্ষে, একটি es muss sein মার্চ।

তারপর টমাস একসময় চেক সীমান্ত অতিক্রম করে, তাকে স্বাগত জানায় রুশ বাহিনীর অগণিত ট্যাঙ্কের সারি। গাড়ী থামিয়ে প্রায় আধাঘণ্টা টমাস অপেক্ষা করে রুশ ট্যাঙ্কের সারিটি পার হবার জন্য। ভয়ঙ্কর দর্শন একজন সৈন্য, কালো সামরিক পোষাকে
রাস্তার মোড়ে দাড়িয়ে  ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে, যেন এই দেশে সব রাস্তাই তার, শুধুমাত্র তার একার।

‘ÔEs muss sein!’ টমাস আরো একবার স্বগতোক্তি করে এবং তারপরই সে সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে, সত্যিই কি এটা অবশ্যই করতে হবে?

হ্যাঁ, তার পক্ষে দুঃসহ ছিল জুরিখে থাকা আর কল্পনা করা তেরেজা একা একা প্রাহাতে থাকছে।

কিন্তু কতদিন ধরে সে এই সমবেদনার যন্ত্রণায় অত্যাচারিত হত? তার সারা জীবন? এক বছর? বা এক মাস? বা শুধু এক সপ্তাহ?

কিভাবে টমাস তা জানবে? কিভাবে সে এর পরিমাপ করতে পারতো ? যে কোনো স্কুলের ছাত্রই পারে পদার্থ বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক হাইপোথিসিস পরীক্ষা করে দেখতে; কিন্তু মানুষ, যেহেতু মাত্র একটি জীবনই পায় বাঁচার জন্য,  কোন পরীক্ষা পরিচালনা করে সে তা যাচাই করে দেখার সুযোগ পায়না,তার কি আবেগকে (সমবেদনা) অনুসরণ করা উচিৎ,নাকি, না।

এই ভাবনাটা মনের মধ্যে নিয়ে টমাস প্রাহাতে তার ফ্ল্যাটের দরজা খোলে, ঘরে ফিরে আসাটা খানিকটা সহজ করে কারেনিন, তার গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মুখ চেটে দিয়ে। তেরেজার আলিঙ্গনের স্বাদ পাবার কামনাটা (জুরিখে তার গাড়ীতে ওঠার সময়ও সে স্পষ্ট অনুভব করছিল) পুরোপুরি চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। বরং সে কল্পনা করে, বরফ ঢাকা প্রান্তরে সে তেরেজার মুখোমুখি দাড়িয়ে, দুজনেই তীব্র শীতে কাঁপছে।

১৭
দেশ দখলের সেই শুরুর দিন থেকেই,  সারারাত জুড়ে প্রতিদিনই রুশ যুদ্ধ বিমানগুলো প্রাহার আকাশে উড়ছে; টমাস, সেই আওয়াজে আর অভ্যস্ত না হওয়ায় ঘুমাতে ব্যর্থ হয়।

ঘুমন্ত তেরেজার পাশে অস্থির বিনিদ্র রাত কাটে তার, তার মনে পড়ে অনেকদিন আগে খুব সাধারণ কোন কথোপকথনের মধ্যে, তেরেজা একটা হঠাৎ মন্তব্য। তারা টমাসের বন্ধু জেডকে নিয়েই কথা বলছিল, তখন তেরেজা বলেছিল, ‘আমার যদি তোমার সাথে দেখা না হত, আমি নিশ্চয়ই তার প্রেমে পড়তাম।

এমনকি সেদিনও তেরেজার এই কথা তাকে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় আক্রান্ত করেছিল; আর এখন সে অনুধাবন করে, তেরেজা তার বন্ধু জেডকে ভালো না বেসে যে তাকে ভালোবাসে ব্যাপারটা আসলেই একটি দৈবাৎ ঘটনা মাত্র। টমাসের জন্য তার তীব্র সর্বগ্রাসী ভালোবাসা ছাড়া, অবশ্যই সম্ভাবনার জগতে, অসীম সংখ্যক পুরুষের প্রতি তার অপূর্ণ  ভালোবাসা ছিল।

আমাদের জীবনের ভালবাসা হালকা কিংবা নির্ভার কিছু হতে পারে, এমন কোনো ধারণা আমরা সবাই একবাক্যে বাতিল করে দেই;  আমারা আগে থেকে ধরে নেই, আমাদের ভালোবাসার যা হওয়ার দরকার, এটি অবশ্যই সেটি। এবং এই ভালোবাসা ছাড়া আমাদের জীবন কখনোই একই রকম থাকে না; আমরা যেন অনুভব করি স্বয়ং বীটহোভেন,বিষণ্ণ, বিস্ময় মেশানো সম্ভ্রম জাগানো, যেন নিজেই আমাদের মহান ভালোবাসার উদ্দেশ্যে Es muss sein বাজাচ্ছেন।

তার বন্ধু জেড সম্বন্ধে টমাস মাঝে মাঝে তেরেজার মন্তব্যটা নিয়ে ভেবেছে এবং সে যে উপসংহারে পৌঁছেছে তা হলো, তার জীবনের ভালোবাসার কাহিনীর বর্ণনা করতে পারে, es muss sein! না বরং es konnte auch anders sein বা ’এটা অবশ্যই অন্য যে কোন কিছুই হতে পারতো’।

ঘটনাক্রমে সাত বছর আগে জটিল স্নায়ুরোগে আক্রান্ত এক রোগীর সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল তেরেজার নিজের শহরের একটি হাসপাতালে। সেই হাসপাতাল থেকে টমাসের হাসপাতালের প্রধান নিউরোসার্জনকে অনুরোধ করা হয়, তার বিশেষজ্ঞ মতামত দেবার জন্য, কিন্তু টমাসের হাসপাতালের প্রধান সার্জন ঘটনাক্রমে তখন সায়াটিকায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং যেহেতু তিনি নড়াচড়া করতে পারছিলেন না, তার বদলে তিনি টমাসকে সেই প্রাদেশিক শহরে রোগীটিকে দেখতে পাঠান। সেই শহরে বেশ কয়েকটি হোটেল আছে, কিন্তু ঘটনাক্রমে টমাসের থাকার ব্যবস্থা হলো, তেরেজা যেখানে কাজ করে, সেখানে। ঘটনাক্রমে টমাসের হাতে যথেষ্ট অবসর ছিল, ট্রেন ছাড়ার আগে, যে কারণে টমাস হোটেলের রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল। তেরেজা ঘটনাক্রমে সেদিন কাজ করছিল, এবং ঘটনাক্রমে টমাসের টেবিলেই পরিবেশনের দায়িত্বে ছিল। প্রায় ছয়টি দৈব ঘটনা বা সুযোগ টমাসকে ঠেলে দিয়েছে তেরেজার দিকে, অর্থাৎ তার নিজের ইচ্ছাটা যেন কম ছিল তেরেজার প্রতি এগিয়ে যাবার ক্ষেত্রে।

প্রাহাতে আবার তার ফিরে আসার কারণও তেরেজা। এরকম একটি দৈবাৎ ঘটা ভালোবাসার উপর ভর করে এত বিশাল নিয়তি নির্ধারক কোন সিদ্ধান্ত সে নিয়েছে; যে ভালোবাসার অস্তিত্বই তো থাকতো না, সাত বছর আগে যদি টমাসের হাসপাতালের প্রধান সার্জন সায়াটিকায় আক্রান্ত না হতেন। এবং এই নারী, চূড়ান্তভাবে আকস্মিক একটি ঘটনার প্রতিভূ, এখন ঠিক আবারো তার পাশে শুয়ে আছে,গভীরভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে।

অনেক রাত তখন, প্রচণ্ড মানসিক চাপে যেমন হয়, পেটের মধ্যে তেমন একটা অনুভূতি  টের পায় টমাস। একবার বা দুবার, তার নিশ্বাস হালকা নাক ডাকার মত হয়। টমাস কোনো সমবেদনা অনুভব করেনা। সে শুধু অনুভব করে তার পেটের মধ্যে বাড়তে থাকা চাপটাকে এবং আর ফিরে আসার বিষণ্ণ হতাশাটাকে।

[প্রথম পর্ব সমাপ্ত]

আপনার মন্তব্য