বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ১০-১১

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৫ ১১:৪৮:৪১

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
১০
টমাস তাকে আবার ডেকেছিল কনিয়াকের মূল্য পরিশোধ করতে। সে তার বইটি বন্ধ করে (গোপন ভ্রাতৃসংঘের সেই প্রতীক) এবং তেরেজা ভেবেছিল তাকে জিজ্ঞাসা করবে, সে কি পড়ছিল।

টমাস জিজ্ঞাসা করে, ‘এর দামটা কি আমার রুমের বিলের সাথে তুমি যোগ করে দিতে পারবে ’।
‘হ্যাঁ’, তেরেজা বলে, ’তোমার রুম নাম্বারটা কত’?

টমাস তাকে তার চাবিটা দেখায়, চাবিটা আটকানো এক টুকরো কাঠের সাথে, যার উপর লাল রঙ দিয়ে লেখা ছিল ছয় সংখ্যাটি।
‘অদ্ভুত তো’, তেরেজা বলে, ‘ছয়’।
টমাস জানতে চায়,  ‘অদ্ভুত কেন ব্যাপারটা’?

হঠাৎ করেই তেরেজার মনে পড়েছিল, তার বাবা মার ছাড়াছাড়ি হয়ে যাবার আগে, প্রাহাতে যে বাসায় তারা থাকতো, তার নাম্বারও ছিল ছয়। কিন্তু সে ভিন্ন একটি উত্তর দিয়েছিল ( যার কৃতিত্ব আমরা তার  কূটকৌশলকে দিতে পারি): ‘তোমার রুম নম্বর ছয় আর আমার কাজও শেষ ছটায়’।

আগন্তুক বলে, ‘বেশ, আমার ট্রেন ছাড়ছে সাতটায়’।
তেরেজা জানতো না, এই প্রশ্নের সে কিভাবে দেবে, তাই টমাসের সই এর জন্য সে বিলটা এগিয়ে দেয় এবং সেটা নিয়ে রিসেপশন ডেস্কে ফিরে আসে। যখন তার কাজ শেষ হয়, আগন্তুকটিকে আর সেই টেবিলে দেখা যায়না। সে কি তেরেজার সতর্ক গোপন বার্তাটি বুঝতে পেরেছিল? একটা উত্তেজনার রেশ নিয়েই তেরেজা রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে আসে।

হোটেলের উল্টোদিকেই ছিল প্রায় খালি ছোট একটা পার্ক, অপরিষ্কার ছোট শহরে কোনো অবহেলিত পার্ক যেমন হতে পারে, কিন্তু তেরেজার জন্য এটি সবসময়ই ছিল সৌন্দর্যের  ছোট একটি দ্বীপের মত: এখানে ঘাস ছিল, চারটা পপলার গাছ, বেঞ্চ, একটা উইপিং উইলো আর কিছু ফরসাইথিয়ার ঝোপ।

একটা হলুদ বেঞ্চে বসেছিল টমাস, যেখান থেকে হোটেলটির রেস্টুরেন্টে ঢোকার দরজাটি স্পষ্ট দেখা যায়। এই বেঞ্চে একদিন আগেই তেরেজা বসেছিল তার কোলে একটা বই নিয়ে! সে তখনই বুঝতে পারে (দৈব ঘটনার পাখিগুলো তার কাঁধের অবতরণ করতে শুরু করে) এই  আগন্তুকটি আসলে তার নিয়তি ; আগন্তুকটি তাকে ডাকে, এবং তার পাশে বসার জন্য নিমন্ত্রণ করে।(তার আত্মার বাহিনীর সদস্যরা শরীরের উপরে দৌড়ে আসে)। এরপর তার সাথে সে হেটে স্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিল এবং টমাস বিদায় ইঙ্গিত হিসাবে তার একটি ভিজিটিং কার্ড দেয় তেরেজাকে, ‘যদি তুমি কখনো প্রাহাতে বেড়াতে আসো….’ ।

১১
সেদিন সেই শেষ মিনিটে কার্ডের চেয়ে আরো অনেক বেশী কিছু টমাস তার হাতে তুলে দিয়েছিল, তা হলো সেই সব দৈবক্রমে ঘটা ঘটনাগুলোর ডাক (বই, বীটহোভেন, ছয় নম্বর, হলুদ পার্কের বেঞ্চ), যা বাসা থেকে বের হয়ে এবং তার নিয়তিকে বদলে দেবার জন্য তেরেজাকে সাহস যুগিয়েছিল। হতে পারে এই সব অল্প কিছু দৈব ঘটনাই (যাই হোক, খুব সাদামাটা, এমনকি অনাকর্ষণীয়, যেমনটা কেউ এরকম কোন নিষ্প্রভ শহরে আশা করতে পারে) হয়তো তার ভালোবাসার সূচনা করেছিল  এবং  সেই প্রাণশক্তি তাকে দিয়েছিল, যা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অবশিষ্ট ছিল।

আমাদের দৈনন্দিন জীবন এরকম অসংখ্য দৈব ঘটনার নীরব সাক্ষী বা আরো সঠিকভাবে বলতে চাইলে, নানা মানুষের সাথে আকস্মিক দেখা হওয়া বা নানা ঘটনায় ভরা, যেগুলোকে আমরা কো ইনসিডেন্স বা যুগপৎ ঘটা ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত করি। যুগপৎ ঘটনা মানে, দুটো ঘটনা অকস্মাৎ একই সাথে যখন ঘটে; তাদের দেখা হলো: টমাস হোটেলটির রেস্টুরেন্টে যখন আবির্ভূত হয়েছিল, ঠিক সেই সময় রেডিওতে বীটহোভেন বাজছিল। বেশীর ভাগ এধরনের যুগপৎ ঘটনা আমরা প্রায়শ খেয়ালই করিনা; যে টেবিলে টমাস বসেছিল যদি স্থানীয় কসাই এসে সেখানে বসতো, তেরেজা হয়তো খেয়াল করতো না রেডিওতে বীটহোভেনের সঙ্গীত বাজছে (এখানে বীটহোভেন এবং শহরের কসাই এর সাক্ষাৎকারও  একটা কৌতূহলোদ্দীপক যুগপৎ ঘটনা হতো নিশ্চয়ই)। কিন্তু তার অঙ্কুরিত ভালোবাসা, তার সৌন্দর্য অনুভব করার ক্ষমতাকে আরো বেশী সংবেদনশীল করে তুলেছিল এবং সে কখনোই এই সংগীতটাকে ভুলতে পারবে না। যখনই সে শুনেছে, এটি তাকে স্পর্শ করেছে। তার চারপাশে যা ঘটছিল সেই মুহূর্তে সবকিছু সংগীতের মূর্ছনায় আর এর সৌন্দর্যকে ধারণ করে উদ্ভাসিত হয়েছিল।

প্রাহাতে টমাসের সাথে দেখা করতে যাবার সময়, তেরেজার বাহুর নীচে যে উপন্যাসটি ছিল, তার শুরুতে আনা এবং ভ্রনস্কির প্রথম দেখাও হয়েছিল খানিকটা অদ্ভুত একটা পরিস্থিতিতে: তারা দুজনেই রেলওয়ে স্টেশনে উপস্থিত ছিল, যখন ট্রেনের নীচে পড়ে কেউ মৃত্যুবরণ করে। উপন্যাসটির শেষে, আনা ট্রেনে সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। এই প্রতিসাম্যময় সুশৃঙ্খল সজ্জা- একই মোটিফ উপন্যাসের শুরুতে এবং শেষে আবির্ভূত হওয়া – আপনাদের কাছে এটি বেশ ‘উপন্যাসীয়’ চরিত্রের মনে হতে পারে এবং আমিও একমত হতে রাজী আছি, কিন্তু শুধুমাত্র একটি শর্তে, আপনারা এই ‘উপন্যাসীয়’ চরিত্রে শব্দটি ‘কাল্পনিক’, ‘বানানো’ বা জীবন ‘অঘনিষ্ঠ’ এধরনের কোন ধারণা নিয়ে পড়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকবেন। কারণ মানুষের জীবন ঠিক এই ধাঁচেই সাজানো থাকে।

সংগীতের মতই তাদের সৃষ্টি করা হয়েছে । তার নিজস্ব সৌন্দর্যবোধ দিয়ে পরিচালিত হয়ে, কেউ একটি দৈবক্রমে ঘটা কোনো ঘটনাকে (বীটহোভেন এর সংগীত, ট্রেনের নীচে মৃত্যু) রূপান্তরিত করে একটি মোটিফে, যে মোটিফটি পরবর্তী কারো জীবনের সঙ্গীত সজ্জায় স্থায়ী জায়গা করে নেয়। আনা কারেনিনার আনা, অন্য যে কোনো ভাবে আত্মহত্যা করতে পারতো, কিন্তু মৃত্যুর মোটিফ আর রেলওয়ে স্টেশন, অবিস্মরণীয়ভাবে যুক্ত হয়ে আছে আনার ভালোবাসার জন্মের সাথে, তার জীবনের দুঃসময়ে যা তাকে তার অন্ধকার সৌন্দর্য দিয়ে প্রলোভিত করেছিল। বিষয়টি অনুধাবন না করেই, একজন ব্যক্তি তার জীবনটাকে সৃষ্টি করে সৌন্দর্যের সূত্র মেনেই, এমন  কি তার চরম দুঃসময়ে।

এজন্যই, রহস্যময় সব যুগপৎ ঘটনাগুলোর প্রতি উপন্যাসের অতি আকর্ষণকে তিরস্কার করাটা আসলে ভুল (যেমন আনা, ভ্রনস্কির দেখা হওয়াটা, রেলওয়ে স্টেশন এবং মৃত্যু বা বীটহোভেন, টমাস, তেরেজা আর কনিয়্যাক) তবে দৈনন্দিন জীবনে এসব ঘটনাগুলোর প্রতি মানুষের এই অন্ধ থাকার জন্য তাকে তিরস্কার করা ঠিকই আছে। কারণ এভাবে সে তার জীবনকে সৌন্দর্যের একটি নতুন মাত্রা থেকে বঞ্চিত করছে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য