মধুর আমার মায়ের ভাষা

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-০৫ ১৫:১৫:০৫

অহী আলম রেজা:

‘কী জাদু বাংলা গানে,গান গেয়ে দাঁড় মাঝি টানে,গেয়ে গান নাচে বাউল,গান গেয়ে ধান কাটে চাষা।’ মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষা করতে গিয়ে ১৯৫২ সালের এই মাসে বাঙালি জাতি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেয়। স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয় এ জাতি। ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই আমরা অর্জন করি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

আমরা উদযাপন করি স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবস,শহীদ দিবস। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষার মর্যাদা লাভ করে। এর পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। কিন্তু আমরা কি জানি বাংলা ভাষা কীভাবে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার মর্যাদা লাভ করলো। এর নেপত্যে ছিলেন রফিকুল ইসলাম নামের এক কানাডা প্রবাসী বাঙালি। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে এক রফিক পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়ে একুশে ফেব্র“য়ারিকে অমর করেছিলেন। তার ৪৬ বছর পরে আরেকজন রফিক সুদূর কানাডায় বসে আরেক দুঃসাহসী কাজ করে ফেললেন । 

১৯৯৮ সালের ৯ জানুয়ারি রফিক জাতিসংঘের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি কফি আনানকে একটি চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতে রফিক ১৯৫২ সালে ভাষা শহীদদের অবদানের কথা উল্লেখ করে কফি আনানকে প্রস্তাব করেন ২১শে ফেব্রুয়ারিকে ‘মাতৃভাষা দিবস’হিসেবে যেন আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

সে সময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে এ চিঠিটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিককে অনুরোধ করেন তিনি যেন জাতিসংঘের অন্য কোন সদস্য রাষ্ট্রের কারো কাছ থেকে একই ধরনের প্রস্তাব আনার ব্যবস্থা করেন। সেই উপদেশ অনুযায়ী রফিক তার সহযোদ্ধা আব্দুস সালামকে সাথে নিয়ে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজিভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তারা আবারো কফি আনানকে ‘এ গ্রুপ অব মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্যা ওর্য়াল্ড’-এর পক্ষ থেকে একটি চিঠি লেখেন, এবং চিঠির একটি কপি ইউএনওর ক্যানাডিয়ান এম্বাসেডর ডেভিড ফাওলারের কাছেও প্রেরণ করেন।

এর মধ্যে একটি বছর পার হয়ে যায়। ১৯৯৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে হাসান ফেরদৌস রফিক এবং সালামকে উপদেশ দেন ইউনেস্কোর ভাষা বিভাগের জোশেফ পডের সাথে দেখা করতে। তারা জোশেফের সাথে দেখা করার পর জোশেফ তাদের উপদেশ দেন ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সাথে দেখা করতে। এই আনা মারিয়াই রফিক-সালামের কাজকে অনেক সহজ করে দেন। আনা মারিয়া রফিক-সালামের কথা মন দিয়ে শোনেন এবং তারপর পরামর্শ দেন তাদের প্রস্তাব ৫ টি সদস্য দেশ ক্যানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে। সে সময় বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী , শিক্ষা সচিবসহ অন্য অনেকেই জড়িত হয়ে পড়েন। তারা দিন রাত ধরে পরিশ্রম করেন আরো ২৯ টি দেশকে প্রস্তাবটির স্বপক্ষে সমর্থন আদায়ে।

অন্যান্য বাংলাদেশি এবং প্রবাসীদের কাছে ব্যাপারটা অগোচরেই ছিল- পর্দার অন্তরালে কি দুঃসাহসিক নাটক চলছিলো সে সময়। এই উচ্চাভিলাসী প্রজেক্টের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা এবং ক্যানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের কিছু লোক কেবল ব্যাপারটা জানেন, এবং বুকে আশা নিয়ে তারা সেসময় স্বপ্নের জাল বুনতে থাকেন প্রতিদিন।

১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর। ইউনেস্কোর প্রস্তাব উত্থাপনের শেষ দিন। তখনো প্রস্তাব এসে পৌঁছায়নি। রফিক সালামেরা ব্যাপারটি নিয়ে বিনিদ্র রজনী অতিক্রম করে চলেছেন। টেলিফোনের সামনে বসে আছেন, কখনো চোখ রাখছেন ইমেইলে। প্রস্তাবটির পেছনে প্রধাণমন্ত্রীর একটি সই বাকি ছিলো। আর প্রধানমন্ত্রী তখন পার্লামেন্টে। পার্লামেন্টের সময়সূচীর পরে সই করতে করতে প্রস্তাব উত্থাপনের সময়সীমা পার হয়ে যাবে। সেটা আর সময় মত ইউনেস্কো পৌঁছুবে না। সব পরিশ্রম জলেই যাবে বোধ হয়।

প্রধানমন্ত্রীকে ফোন করে অনুরোধ করা হলো তিনি যেন প্রস্তাবটি সই করে ফ্যাক্স করে দেন ইউনেস্কোর দপ্তরে। অফিসের সময়সীমা শেষ হবার মাত্র একঘণ্টা আগে ফ্যাক্সবার্তা ইউনেস্কোর অফিসে এসে পৌছে। ১৬ নভেম্বর কোন এক অজ্ঞাত কারণে বহুল প্রতাশিত প্রস্তাবটি ইউনেস্কোর সভায় উত্থাপন করা হলো না। রফিক সালামেরা আরো একটি হতাশ দিন পার করলেন।

পর দিন ১৭ নভেম্বর, ১৯৯৯। এক ঐতিহাসিক দিন। প্রস্তাব উত্থাপন করা হলো সভার প্রথমেই। ১৮৮ টি দেশ এতে সাথে সাথেই সমর্থন জানালো। কোন দেশই এর বিরোধিতা করলোনা ।

সর্বসম্মতিক্রমে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে গৃহীত হলো ইউনেস্কোর সভায়। এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারি একটি আন্তর্জাতিক দিনে পরিণত হলো।

আপনার মন্তব্য