ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ৮

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১১ ১৪:২৬:৩৮

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২২
রাতে আজ ঘরে কথা হচ্ছে। নিচু স্বরে। সালাউদ্দিন কথার সূত্র ধরিয়ে দিয়ে গেছেন। বাচ্চারা ঘুমন্ত। এক ঘর অন্ধকারে দুই বিছানায় তারা   দুজন বসে আছে। একটু একটু করে রাত পার হচ্ছে। সুপ্রভার প্রশ্নের উত্তরে রবীন্দ্রবাবু মাঝে মাঝে নিশ্চুপ। উত্তর যেন মাঝে মাঝে নিজেকেই দিচ্ছেন।--সবাই ভাবে ইন্ডিয়া স্বর্গ। সেখানে গেলে  প্রাণ বাঁচে ঠিকই। মান আর বাঁচে কই। গোনা পয়সায় খাওয়া। সব কিছুইত কিনে খেতে হয়। যারা একসময় সব বিক্রি বাটা করে যেতে পেরেছে তারা হয়তো একটু মানুষের মতো আছে। তা না হলেত রিফিউজি ক্যাম্পের নরক বাস। ক’জন পারে। চলে যাওয়াটা খুব সহজ কথা নয়। জমি নির্ভর মানুষের চলমানতা থাকেনা। সুপ্রভা যখন ছেলেদের ইন্ডিয়ায় পাঠানোর জন্য ব্যস্ত তখন তিনি এসবে বাধা দিতে চাননি ঠিকই । হয়তো ভাবতেন কিছু একটা সুরাহা হবে ঠিকই, ভরসা বড় ছেলেটা যখন আগে থেকেই আছে সেখানে। কিন্তু কোন পরিষ্কার ধারণা সুপ্রভার কেন, তার নিজেরও ছিলনা। পরে যখন একবার গিয়ে নিজে কিছুটা আঁচ পেয়ে এলেন তখন আর কিছু করার উপায়ও নেই। জমি বেচে টাকা পাচারের মত ধুরন্ধর কাজ কি আর তিনি করতে পারেন। বরং ততদিনে হিন্দুদের পক্ষে জমি বেচাই মুস্কিল হয়ে গেছে। তার উপর যদি কেউ সরকারের কাছে রিপোর্ট করে যে তার সন্তানেরা ইন্ডিয়ায় আছে তা হলে এই অজুহাতেই তার সমস্ত সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হয়ে যেতে পারে । এক হতে পারতো সম্পত্তি বিনিময় করে চলে যাওয়া। তারও নানা অসুবিধে। শরিকরা রাজি হয়নি। নিজে বয়োজ্যেষ্ঠ হওয়ার কারণে একা একা বিনিময় করে গায়ে লাগা শরিকি বাড়িতে অচেনা কোন মুসলমান পরিবারকে বসিয়ে দিয়ে চলে যাওয়াটাও তার কাছে নেহাত অধর্ম বলেই মনে হয়। তা ছাড়া তিনি জমি জোতের ব্যাপার স্যাপার বোঝেনও কম। একা একা কোথায় গিয়ে কী অবস্থায় পড়বেন—ভেবেই তিনি সব সময় পিছিয়ে  থাকেন। অনেকক্ষণ কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে সুপ্রভা এক সময় বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন কখন সকাল হবে।

নিয়তি রওনা হয়ে গেছে আজ দুদিন হয়ে গেছে। কতদিন মেয়েটা বাড়িতে রইল—কীভাবে যে সময় পার হয়ে গেল—আর এখন সে নৌকায়। নৌকা এখন কোথায়, কী ভাবে যাচ্ছে,কী করছে—সুপ্রভা ভাবতে গেলে কেমন যেন কাতর হয়ে পড়েন। এত নিরুপায় অবস্থায় জীবনে কখনো পড়েছেন বলে মনে করতে পারছেন না। বেশিক্ষণ ভাবনাটা মাথায় রাখতেও পারেন না। শরীরে মনে খুব শক্তপোক্ত মানুষ তিনি, কিন্তু মেয়েটার কথা ভাবলে এখন আর স্থির থাকতে পারেন না। কেমন দুর্বল বোধ করেন।

এর তার মুখে শুনে দেশটার অবস্থা তারা কেউই সম্যক ধারণা করতে পারেন না। কিন্তু ভয়টা কেমন যেন চুঁইয়ে চুঁইয়ে তাদের এই প্রান্ত পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলেছে। নিয়তির সঙ্গে সুপ্রভার কথাবার্তা এখন পর্যন্ত তৃতীয় কেউ জানে না। দিবাকরও জানে না। তার সন্দেহ তাদের মা মেয়ের মধ্যে বিবাদ হয়েছে। বিবাদ একটা হয়েছিল । সেটা যতটা সরবে তার চেয়ে অনেক বেশি নীরবে। কিন্তু বিবাদের আড়ালে তারা দুই নারী একদিন এক চূড়ান্ত সহমতে পৌঁছোতে পারলো।  

নিয়তিই একদিন তার মাকে প্রস্তাবটা দেয় যে সে মুক্তাগাছায় ফিরে যাবে। তার আশা সে ফিরে গেলে হয়তো ঘর বাড়ি ফেলে রেখে সুপ্রভাও বাড়ি ছাড়ার জন্য চাপ দেবে রবীন্দ্রবাবুকে। কিন্তু বাস্তবতা কি তাই?--নিয়তি ফিরেই বা কোথায় যাবে। খবর যতটুকু সংগ্রহ  করা গেছে তাতে জানা যাচ্ছে ঘরবাড়ির  কাঠামো আছে,কিন্তু ভেতরে কিছু আছে কিনা জানা যাচ্ছে না। শুরুর দিকের একতরফা অত্যাচার এখন আর এক তরফা হচ্ছে না। মাঝে মাঝে সেখানে সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। একটানা মার খেয়ে কোথাও কোথাও একটা স্বাভাবিক প্রতিরোধের বাতাবরণ যেন তৈরি হচ্ছে। নিয়তির প্রস্তাবে সুপ্রভা বিমূঢ়। কোন কথা তিনি বলতে পারছেন না। নিয়তি হঠাৎ করে এখানে আসাতে তিনি অস্বস্তি লুকোতে পারেন নি। মৃত্যু-ভয়ের মুখে দাঁড়িয়ে বিপদে পড়া মা আর সন্তান,তারা কেউই জানে  না কী করা উচিত । আত্মরক্ষার উপায় কী, কে তাদের ঠিক দিশা দেখাবে। বাড়ির পুরুষদের উপর প্রাথমিকভাবে উষ্মা জন্মালেও এখন মনে হয় কেইবা কী করবে। কারই বা কী করার ক্ষমতা আছে। নিয়তি ভাবে যে মুক্তাগাছায় ভয় ছিল এই মারে সেই মারে, আজ মারে কাল মারে—কিন্তু এখানে তো মারা, মেরে ফেলা,মৃত্যু, এসব দৃশ্যমান না হলেও এসবের সাথে, সাথে ঠিক নয়, একটু আগে, আছে এক  চরম উৎকণ্ঠা—যার চাপ সহ্য করা কখনো মনে হয় মৃত্যুরও অধিক। ভয়ার্ত পশুদের স্তরে নেমে যাওয়া জীবন কত আর টানা যায়।

তাই নিয়তি যাবেই। বাবা মায়ের রাজি অরাজি হওয়া এখন আর বিষয় নয়। যে আশা নিয়ে সে এখানে এসে ছিল সেটাত প্রথমেই ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল বাবা ,মায়ের নানা বিষয়ে মতান্তরের কারণে। এখন মাও আর চান না তার সন্তানসম্ভবা মেয়ের প্রসব এখানেই হউক। আসলে মায়ের শিকড় শ্রীমন্তপুরের মাটি থেকে ছিন্ন হয়ে গেছে। এই ক’মাস একজন ছিন্নমূল মাকেই সে দেখেছে। এই মাটিতে দাঁড়িয়ে মা’যে একজন ছিন্নমূল হতে পারেন তা প্রায় অবিশ্বাস্য। জন্মাবধি মায়ের জীবন যতটুকু দেখা গেছে তাতে সত্যি তাকে চেনার অনেক বাকি ছিল বোধ হয়। আর সেই অজানা মানুষটিই আজ তার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। অচেনাত লাগবেই।
২৩
মেয়েদের ছকে বাঁধা এক জীবন ছিল এখানে। ছকের বাইরে গেলে মেয়েরা বাঁচতোনা। বাঁচা সম্ভব ছিল না। প্রকৃত অর্থেই জলের ধর্ম তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। যে পাত্রে তাকে ঢালা হবে সেই পাত্রের আকার তাকে নিতেই হবে। বলাবাহুল্য পাত্রটি ছিল লিঙ্গ পরিচয়ে একজন পুরুষ। নিয়তির এবারকার ধারণা তার মা ততখানি জল-ধর্মী ছিলেন না। এবার মাকে একটু নতুন করে চিনলো যেন সে। একটু কম জল-ধর্মী হওয়ার কারণে মায়ের প্রভাব এই সংসারে অনেক বেশি ছিল। বাবার বিষয়-বিমুখতার কারণও মায়ের এই ব্যক্তিত্ব  নির্মাণে সহায়ক হয়েছিল। এই সবই ঠিক আছে। মায়ের মত একজন মহিলা এই সংসারে এসেছিলেন বলেই এতগুলো প্রাণ এখন পর্যন্ত টিকে থাকতে পেরেছে  । কিন্তু বাস্তবত মা আমাদের আবহমান  সংসারের রীতি অনুযায়ী পুত্রদের জন্য যতখানি যত্নবান ছিলেন ততখানি কন্যাদের জন্য ছিলেন বলে মনে হয় না। বাস্তবতার নিরিখে মায়ের মনোভাবে আমরা কোন অন্যায্যতা দেখিনি। পুরুষ শাসিত এক আবহমানতা হয়তো বাইরের যাবতীয় কর্কশতার মধ্যেও মায়ের অন্তরের নরম মনের হদিশ আমরা কন্যা সন্তানেরাই খুব কাছে থাকার সুবাদে পেতাম। অন্তত আমিত পেয়েছিই। সংসারে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে মা কখনো ক্ষোভ প্রকাশ না করলেও মা কি ভেতরে ভেতরে কাঁদতেন!—মনে হয় কাঁদতেন। কিন্তু সেটা দেখা যেত না। তবে বলতেন যে মেয়েদের কান্নাটা সংসারে খুব স্বাভাবিক। কিছু কিছু সময় সেটা আবশ্যিকও। না হলে সারাজীবনের মতো ঘোর নিন্দা হিসেবে সেটা ঝুলে থাকবে। যেমন বিবাহের পর পতিগৃহে যাত্রার সময়। মা এসব বললেও মায়ের কান্না মোটেও এরকম কিছু ছিল না। মায়ের এই কান্না ছিল এক গভীরতর বোবা কান্না। পুত্র সন্তান রক্ষার কান্না।  বংশ রক্ষার  কান্না। বংশ পুত্রদের দ্বারাই রক্ষিত হয়। পুত্ররা তাই বিকাশমান । বিশ্বাস ছিল—কথা প্রসঙ্গে বলতেনও যে পুণ্যবতী মেয়েদের জীবনে তিন পুরুষের গল্প থাকে। শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্র। এই তিন পুরুষের তিন আশ্রয় তার পুণ্যভূমি। সেই হিসেবে মায়ের এখন পুত্রের অধীনে থাকার কথা। সেই হিসেবেও মায়ের এখন শ্রীমন্তপুরে থাকার কথা নয়।  

মায়ের প্রভাবে আমরাও কমবেশি তাই হয়েছি, বা হতে চেয়েছি। শ্রীমন্তপুরে থাকতে না চাওয়াটা মায়ের পক্ষে অন্যায্য কিছু না। এ তার সারা জীবনের অর্জন—পুত্রদের প্রতিষ্ঠা—সে যেমনই হউক, তিনি তাদের সান্নিধ্য কামনা করতে পারেন। বাঁধা দিচ্ছে শুধু এই সময়টা। সময়ের ঘূর্ণিতে ছিন্ন পাতার মত উড়ে আসা তার এই মেয়েটা। আর এসেই যেন সে এক তীব্র পরীক্ষার মুখে ঠেলে দিল তাকে। এই উচ্ছন্ন সময় না হলে  মায়ের কাছে এ-সব কোন সমস্যাই ছিল না। এই উচ্ছন্ন সময় তাকে নিহত হওয়ার বার্তা দিয়েছে। ওত পেতে বসে থাকা মৃত্যুর ছায়া দেখিয়েছে। দেশান্তরে থাকা সন্তানদের আর চোখের দেখা দেখতে না পাওয়ার কথা শুনিয়েছে। এক কথায় স্বপ্ন নষ্ট হয়ে যাওয়ার মত অবস্থা, যেখানে তার শরীর মন আর কোন ভারসাম্য খুঁজে পাচ্ছে না।–অবশ হয়ে আসছে। ভরা সংসারে সন্তানবতী সুপ্রভা হঠাৎ নিজের কাছে গভীর ভাবে একাকী হয়ে পড়েছে।  ফলে নিয়তির কাছে তাকেত অচেনা লাগবেই।

দিবাকরের ধারণা তাদের মা মেয়ের মধ্যে বিবাদ হয়েছে। সাহস করে একদিন নিয়তির কাছে সে জানতে চেয়েছিল—বিনিময়ে সে ধমক খেয়েছিল। কিন্তু যেটা সে শোনেনি, বা না বললে আর জানবেও না, সেটা হলো বিবাদটা হয়েছিল তার মায়ের সঙ্গে বাবার। নিয়তি সেটা শুনে ফেলে। দেশছাড়ার জন্য সুপ্রভার প্রতিদিনকার চাপের মুখে যখন রবীন্দ্রবাবু তার অনড়-থাকা অবস্থানটা পুনর্বিবেচনা করার কথা ভাবছিলেন তখনই নিয়তি এসে শ্রীমন্তপুরে পৌঁছেছিল। আর নিয়তির অবস্থা বিবেচনা করে তিনি পুনরায় তার না-যাওয়ার সিদ্ধান্তটাই বহাল রাখতে চেয়েছিলেন। বিবাদের কারণটা ছিল এটাই। কথা কাটাকাটি, রাগারাগি—ইত্যাদির পর রবীন্দ্রবাবুর বক্তব্য ছিল ভগবান চাইছেন না আমরা চলে যাই। না হলে মেয়েটাকে এই সময় কেন এখানে টেনে আনবেন। এই অবস্থায় মেয়েকে নিয়ে যে কোথাও যাওয়া যায় না, এটা না বোঝার মত মানুষ সুপ্রভা নয়, তবু কেন যে তিনি সেই এক কথা বার বার বলে যাচ্ছেন—

অদৃষ্টবাদী রবীন্দ্রবাবু এখন আর রাগারাগি করছেন না। মৃত্যু-ভয় কি সুপ্রভার মানবিক প্রবৃত্তিগুলোকে এলোমেলো করে দিয়েছে?—হতে পারে। মাঝখানে নিয়তিকে রেখে মৃত্যুর ছায়ায় ছায়ায় তাদের স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক বলতে যখন আর কিছুই নেই, যখন সকালে ঘুম থেকে উঠেই হিসেব করা হয় একটা দিন বাঁচা হলো, যখন খাওয়া পরা সম্পর্কিত দৈনন্দিনতা প্রায় মানবেতর পর্যায়ে, ঠিক তখনই নিয়তি ঘোষণা করে বসলো সে মুক্তাগাছা ফিরে যাবে।


২৪
খবরটা জব্বারের মারফত গ্রামে এলো। আকবর আলি মিলিটারি ক্যাম্পে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তাকে আনতে যেতে হবে। আগের দিন  লোকটা হেঁটে হেঁটে পুলিশের সঙ্গে গেল আর পরের দিনই এই খবর। সালাউদ্দিন খবরটা শোনার পর দেরি করেনি। জনা পাঁচেক লোক জুটিয়ে নৌকা করে সে মোহনগঞ্জের দিকে রওনা হয়ে গেলো। লোক কি আর সহজে যোগাড় করা যায়! ক্যাম্পের নাম শুনে সবাই ভয়  পায়। তবু যুবকদের বাদ দিয়ে ক’জন মাঝ বয়সী নিয়েই তারা মোহনগঞ্জ গেল। ফিরলো সন্ধ্যের আগে আগে। আসার পথে নৌকা নিয়ে অনেকটা ঘুরে তারা আমিত্তিপুরের ঘাটে এসে উঠলো। প্রায় অর্ধচেতন বিধ্বস্ত আকবর আলি—দেখেই বোঝা যায় যে তাকে শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। মেরে ফেলেনি যে এই ভাগ্য। মিলিটারি ক্যাম্প থেকে প্রাণ নিয়ে ফেরা ভাগ্যের ব্যাপার। আকবর আলির বৃদ্ধা স্ত্রী স্বামীকে দেখে নিজেই প্রায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তাকে শুশ্রূষা করার জন্য গ্রামেরই দুজন মহিলা এলেন। একা আছেন বলে গ্রামের দুজন ছেলে আগের রাতেও আকবর আলির বাড়িতে  ছিল। আজও তারা থাকবে। যোগেশ ডাক্তার একবার গিয়ে দেখে এসেছে। আলাদা করে সালাউদ্দিনকে বলে এসেছে অবস্থা ভালো নয়। রাইতে  খবর টবর লইন যে--।   

পরের দিন সাতসকালে দু দুটো খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো । একটা আকবর আলির ইন্তেকাল আর একটা ঠাকরোকোনার রেলব্রীজ ধ্বংস।  নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ আসার রেলপথ বন্ধ। বর্ষার জল কমলে মিলিটারিদের দৌরাত্ম্য বাড়বে এই আশংকার মধ্যে নতুন এই খবরে  ভয় না অভয় বুঝতে পারছে না মানুষ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে খুব অনাড়ম্বর ভাবে আকবর আলির দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হল। এবারে সমস্যা হলো তার বৃদ্ধা স্ত্রীকে একা বাড়িতে কীভাবে রাখা যায়। তাদের ছেলে মেয়ে এই সময় কে কোথায় আছে কে জানে! দীর্ঘদিনের সঙ্গী স্বামীকে হারিয়ে বৃদ্ধা শোকে প্রায় বোবা হয়ে গেছেন। তবু তিনি যেহেতু গ্রামের মানুষ গ্রামের লোকেরই আপাতত দায়িত্ব তার দেখা শোনা করার।  

আকবর আলির মৃত্যু আর ঠাকরোকোনার রেলব্রীজ ধ্বংস--এই দুই খবরে রবীন্দ্রবাবুর বাড়িতে কোন বাড়তি কথা তৈরি হয় না। শরীর টেনে টেনে জীবন যে-ভাবে চলছিল তাই চলছে। ছেলে সুবল মাঝে মাঝে দুরন্ত গতিতে ছুটে এসে নিচু গলায় মাকে খবরের শিরোনাম জানিয়ে আবার একই গতিতে কোথাও উধাও হয়ে যায়। খবর শুনে ভেতরে ভেতরে কাঁপুনি হলেও সুপ্রভা তা প্রকাশ করেন না বা স্বামীকে কিছু জিজ্ঞেসও করেন না। খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও একবার রবীন্দ্রবাবু মধুসাধুর বাড়ি ঘুরে আসেন। তবে আজ সকালটা তার আমিত্তিপুরেই কেটেছে। বয়সে তার থেকে কিছুটা বড় হলেও আকবর আলির সঙ্গে তার অনেকটা বন্ধুত্বের সম্পর্কই ছিল। শেষ বয়সে তার এই পরিণতি অভাবনীয়। শেষ যাত্রার সঙ্গী হয়ে তিনি সারাক্ষণ শুধু ভাবছিলেন একটা ডুবন্ত দেশের মানুষ আমরা—ঈশ্বর ছাড়া আমাদের আর কে বাঁচাতে পারে---!  

দুই দিন হতে চললো নিয়তিরা রওনা হয়ে গেছে। কোন খবর নাই। অধীর ফিরলেত খবর। এখন কোথায়,কোন জায়গায় আছে, কেমন আছে—ভাবনার আর শেষ নেই। মাথায় সারাদিনই এক ভাবনা। এক টুকরো আশার কথা সালাউদ্দিন আজ এক ফাঁকে শোনালো যে রেলব্রীজ উড়িয়ে দেয়াটা আমাদের অঞ্চলের জন্য ভাল খবর। মুক্তিযোদ্ধাদের নাকি ভাটি অঞ্চলের কোন কোন জায়গায়  দেখা যাচ্ছে। দূরে দূরে কোথাও কোথাও সংঘর্ষের খবরও নাকি পাওয়া যাচ্ছে। যদিও এসব ভালো খবর কোন অর্থে, বুঝতে রবীন্দ্রবাবুর অসুবিধে হচ্ছে । মুক্তিযোদ্ধা, সংঘর্ষ---এসবের সূত্র ধরে মিলিটারির আগমন ঘটলে আমরা যাই কোথায়!  স্থানীয় সাপ্তাহিক বাজারে গেলে এসব তথ্য শোনা যায়। রবীন্দ্রবাবু বহুকাল বাজারে যান না। ফলে খবরাখবর তাকে গ্রাম থেকেই সংগ্রহ করতে হয়। আর কদিনের মধ্যেই আমন ধান কাটা শুরু হবে। গোটা বর্ষাকালটা নানা রকম দুঃসংবাদের স্রোতে কাটাতে কাটাতে কৃষকরা এখন যেন কাজ চাইছে। কাজ পেলে যেন প্রাণের ভয় তাড়ানো সম্ভব হবে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য