বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ১৮-১৯

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-১৯ ১২:৩৯:৩৮

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
১৮
সত্যি, তার বাড়ি ছাড়ার শেষ দিন পর্যন্ত তেরেজা তার মায়ের সাথে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু আমাদের ভুলে যাওয়া চলবে না, তার মাকে ভালোবাসা সে বন্ধ করে দেয়নি কখনোই। মায়ের জন্য যে কোনো কিছুই সে করতে পারতো, যদি তার মা ভালোবাসার স্বরে তার কাছে তা চাইতো। সব কিছু ছেড়ে আসার জন্য তার শক্তি পাবার একমাত্র কারণ সে কোনদিনও তার মায়ের সেই গলার স্বর শোনেনি।

যখন তেরেজার মা বুঝতে পেরেছে যে তার আক্রমণাত্মক আচরণ তার মেয়ের উপর আর কোনই প্রভাব ফেলছে না, সে তাকে নালিশ করার সুরে চিঠি লিখতে শুরু করে, তার স্বামীকে নিয়ে, তার অফিসের মনিব, তার স্বাস্থ্য, তার ছেলেমেয়েকে নিয়ে নানা অভিযোগ এবং তেরেজাকে আশ্বস্ত করা যে একমাত্র সে অবশিষ্ট আছে তার জীবনে। তেরেজা ভাবে, অবশেষে বিশ বছর পর আবার সে তার মায়ের ভালোবাসার কণ্ঠস্বর শুনতে শুরু করেছে এবং তার ফিরে যাবার কথা মনে হয়। আর এখন আরো বেশী করে মনে পড়ার কারণ, সে নিজেকে দুর্বল,ক্ষমতাহীন অনুভব করে টমাসের অবিশ্বস্ততায়। এসব কিছুই উন্মোচন করে দেয় তার অসহায়ত্বকে, ক্রমান্বয়ে যা তাকে নিয়ে যায় সেই ভার্টিগোর দিকে, সেই অনতিক্রম্য পতনের আকাঙ্ক্ষায়।

একদিন তার মা ফোন করে তাকে জানায় তার ক্যান্সার হয়েছে, মাত্র কয়েক মাস সে বাঁচবে। টমাসের অবিশ্বস্ততার  প্রতি তেরেজার মানসিক হতাশাকে এই খবরটি রূপান্তরিত করে বিদ্রোহে। ভাবে, সে তার মার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, সে নিজেকে তিরস্কার করে, এমন একটা মানুষের জন্য, যে তাকে ভালোবাসেনা। তার মা তার সাথে যা কিছু করেছে, সে সব অত্যাচার সে সব ভুলে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠে; এমন একটা পরিস্থিতিতে সে এখন আছে যে তার মাকে সে বুঝতে পারে। তেরেজা যেমন টমাসকে ভালোবাসে, তার মা তার সৎ বাবাকে তেমন করে ভালোবেসেছিল এবং  তার সৎ বাবা তার মাকে অত্যাচার করেছে অবিশ্বস্ততা দিয়ে, ঠিক টমাসও যেমন বিশ্বাসঘাতকতা তাকে তিক্ত করেছে। তার মায়ের প্রতিহিংসা আর তিক্ততার কারণ সে অনেক বেশী যন্ত্রণা সহ্য করেছে।  

তেরেজা টমাসকে জানায় তার মা অসুস্থ এবং সে এক সপ্তাহ ছুটি নিয়ে তাকে দেখতে যাবে। তার কণ্ঠস্বরে ছিল তীব্র ঘৃণা।

মায়ের কাছে ফিরে যাওয়াটা তেরেজার ভার্টিগো হিসাবে বুঝতে পেরে, টমাস তাকে যেতে নিষেধ করে। ছোট শহরের সেই হাসপাতালে টমাস ফোন করেছিল। সারাদেশ জুড়ে ক্যান্সারের নানা উপাত্ত সংগ্রহ করা হয় সযত্নে, সে কারণে তার খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি আসল সত্যটা খুঁজে বের করতে: আসলেই তেরেজার মায়ের ক্যানসার হতে পারে এমন কোনো সামান্যতম সন্দেহই করা হয়নি, উপরন্তু এমনকি গত এক বছরের বেশী সময় তাকে কোনো ডাক্তারের কাছেই যেতে হয়নি।

তেরেজা অবশ্য টমাসের নির্দেশ মেনে নেয় এবং তার মাকে দেখতে যাবার সিদ্ধান্তটা বাতিল করেছিল। এর কয়েক ঘণ্টা পরই সে রাস্তায় পড়ে গিয়ে হাঁটুতে বেশ ব্যথা পায়। এরপর থেকে হাটার সময় সে ভারসাম্যহীন হতে শুরু করে, প্রায় প্রত্যেকদিনই রাস্তায় তার পড়ে যাবার ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়, বা কোনো না কোনো কিছুর সাথে ধাক্কা খাওয়া বা কমপক্ষে তার হাত থেকে নানা জিনিস পড়তে শুরু করার মত ঘটনাগুলো ঘটতে থাকে।
সে আসলে তখন পতিত হবার অনতিক্রম্য সেই তীব্র ইচ্ছায় বন্দী, স্থির একটি ভার্টিগো অবস্থায় সে  বেঁচে ছিল ।

‘আমাকে উপরে টেনে তোলার জন্য ধরো’ হচ্ছে বার বার পতনোন্মুখ কোন ব্যক্তির বার্তা; টমাস তাকে বার বার তুলে ধরেছে ধৈর্য সহকারে।

১৯
 ‘আমি আমার স্টুডিওতে তোমার সাথে সঙ্গম করতে চাই, চারিদিকে মানুষে ঘেরা এটা মঞ্চের মত হবে তা, দর্শকদের কাছাকাছি আসতে অনুমতি দেয়া হবে না, কিন্তু তারা আমাদের দিক থেকে চোখও ফেরাতে পারবে না…..’।

বেশ কিছু সময় পার হয়ে গেলে, এই দৃশ্যটি তার মুল নিষ্ঠুরতার বেশ খানিকটা হারিয়ে ফেলে এবং তেরেজাকে উত্তেজিত করে তুলতে শুরু করে। তাদের সঙ্গমের সময় সে টমাসের কানে কানে এই দৃশ্যটির বিস্তারিত বিবরণ দিত।

‘আমি তাদের নগ্ন করে দেব তোমার জন্য, তাদেরকে গোছল করাবো, তারপর তোমার কাছে নিয়ে আসবো….’ সঙ্গমের অন্তরঙ্গতায় অস্ফুট স্বরে সে টমাসকে বলতো। উভলিঙ্গ মানুষের মতো টমাসের সাথে পুরোপুরি মিশে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা অনুভব করে তেরেজা। তখন অন্য রমণীদের শরীর হবে তাদের দুজনেরই খেলার উপকরণ মাত্র।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য