বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ২০-২১

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৪ ০২:০৭:২৭

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২০
ওহ, তার বহুগামী জীবনের অল্টার ইগো বা দ্বিতীয় সত্তা হওয়া ! না, টমাস বিষয়টা বুঝতে অস্বীকার করে, কিন্তু তেরেজা কিছুতেই বিষয়টি তার চিন্তা থেকে বাদ দিতে পারেনা এবং সাবিনার সাথে সে একটা বন্ধুত্ব গড়ে তোলার চেষ্টা করে। সাবিনাকে তার একটা সিরিজ ফটোগ্রাফ তোলার প্রস্তাব দিয়ে তেরেজা শুরু করে।

সাবিনা তেরেজা তার স্টুডিওতে আমন্ত্রণ করে, এবং অবশেষে সেই বেশ খোলামেলা ঘরটা আর এর কেন্দ্রের সেই বিশাল, চারকোনা, মঞ্চের প্ল্যাটফর্মের মত বিছানাটি দেখার সুযোগ হয় তেরেজার।

‘খুবই খারাপ লাগছে তুমি এর আগে এখানে কখনো আসার সুযোগ পাওনি’, সাবিনা দেয়ালে হেলান দিয়ে রাখা তার ক্যানভাসগুলো তেরেজাকে দেখাতে দেখাতে বলে। এমনকি খুব পুরনো একটা ক্যানভাসও বের করে, নির্মাণাধীন কোন অট্টালিকার ধাতব কাঠামোর, যা সে তার আর্ট স্কুল জীবনে এঁকেছিল। সে সময় যখন একবারে গোঁড়া রিয়ালিজমই শুধু আশা করা হতো শিক্ষার্থীদের কাছে ( বলা হতো যে শিল্পকর্ম বাস্তবসম্মত নয়, সেটি সমাজতন্ত্রের ভিত্তি শুষে খায়);  সেই সময়ের দাবী অনুযায়ী, সে আরো কঠোর হবার চেষ্টা করে তার শিক্ষকদের থেকে, এবং সে তুলি আঁচড়গুলো ঢেকে দিয়ে একটি স্টাইলে চিত্রকর্ম সৃষ্টি করাকে বেছে নেয়; যেগুলো প্রায় রঙ্গিন।

‘এই পেইন্টিংটিতে আমি হঠাৎ করে লাল রঙ এর ফোটা ফেলে দিয়েছিলাম। প্রথম, ভীষণ খারাপ লেগেছিল, কিন্তু এর পরপরই বিষয়টা আমার ভালো লাগতে শুরু করে। এই গড়িয়ে পড়া রঙ এর ফোটাটা দেখতে মনে হচ্ছিল যেন, একটি ফাটল, পুরো দালান তৈরির এই জায়গাটাকে এই ফাটলটা যেন রূপান্তরিত করেছে পুরনো ধ্বংসাবশেষের একটা প্রেক্ষাপটে, যে প্রেক্ষাপটের উপর দালানের এর জায়গাটি যেন পেইন্ট করা হয়েছে। আমি এই ফাটলটা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি, এটাকে পূর্ণ করি, ভাবি এর পেছনে কি দৃশ্যমান হতে পারে। এবং এভাবে আমার প্রথম চক্রের পেইন্টিং এর কাজ করা হয়, আমি যাদের নাম দিয়েছিলাম বিহাইন্ড দি সিন, অবশ্যই আমি কাউকেই এটি দেখাতে পারিনি, দেখালে আমাকে আর্ট অ্যাকাডেমি থেকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়া হত নির্ঘাত। উপরের পৃষ্ঠে, এখানে সবসময়ই নিখুঁত বাস্তব রিয়েলিষ্টিক জগত, যার পিছনে লুকিয়ে থাকে ভিন্ন কোন কিছু,  কোন কিছু রহস্যময়, কোন কিছু বিমূর্ত’।

কয়েক মুহূর্তের জন্য বিরতি নিয়ে, সাবিনা যোগ করে, উপরিপৃষ্ঠে একটি বোধগম্য মিথ্যা, আর গভীরে একটি অবোধ্য সত্য’।

অসাধারণ একটি মনোযোগ দিয়ে তেরেজা তার কথা শোনে, যা খুব কম শিক্ষকই তাদের শিক্ষার্থীদের চেহারায় কখনো দেখেছেন এবং সে সাবিনার সব পেইন্টিংগুলো বুঝতে শুরু করে, অতীত এবং বর্তমানের, সেও এমন ধারণাগুলো  তার মনেও পোষণ করে আসছে। তার প্রত্যেকটি আসলো দুটি থিমের একটি সংযোগের সব বৈশিষ্ট্য ধারণ করছে; দুটো পৃথিবী, বলা যায় যেন তারা প্রত্যেকটি ডাবল এক্সপোজার। একটা ভূদৃশ্য চিত্র যেখানে একটি পুরনো ফ্যাশনের টেবিল ল্যাম্প, এর পেছন থেকে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে আছে। এটা আদর্শ স্টিল লাইফ, আপেল, বাদাম, এবং ক্ষুদ্র মোম আলো জ্বালা ক্রিস্টমাস ট্রি, একটি হাত ক্যানভাস ছিঁড়ে বের হয়ে আসছে।

সাবিনার প্রতি তার মন একটি অদ্ভুত মুগ্ধতায় ভরে যায়, যেহেতু সাবিনা তাকে বন্ধু হিসাবে মর্যাদা দিয়েছে,এটি এমন একটি শ্রদ্ধা যা ভয় এবং সন্দেহ মুক্ত এবং যা খুব দ্রুত রূপান্তরিত হয় বন্ধুত্বে।

সে প্রায় ভুলেই গিয়েছিল, যে সে ছবি তুলতে এসেছিল। সাবিনা তাকে মনে করিয়ে দেয়। অবশেষে তেরেজা পেইন্টিং থেকে চোখ ফেরায়,তার চোখে পড়ে ঘরের মধ্যে মঞ্চের মত পাতা বিশাল বিছানাটি।

২১
বিছানার পাশেই ছিল ছোট একটা টেবিল, টেবিলের উপর মানুষের মাথার একটি মডেল, যেমনটা হেয়ার ড্রেসারের দোকানে পরচুলা দিয়ে সাজানো থাকে। সাবিনার পরচুলা সাজানোর স্ট্যান্ডটিতে পরচুলার বদলে রাখা একটি বোওলার হ্যাট। সাবিনা  হেসে বলে, ’এই হ্যাটটি আমার দাদার’।

এই ধরনের টুপি-কালো,শক্ত, গোলাকৃতি, তেরেজা সিনেমাতে শুধু দেখছে এর আগে, চ্যাপলিন যে ধরনের টুপি পরতেন। সেও পাল্টা হাসে, তারপর হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে বলে, ‘তুমি কি চাও এটা পরা অবস্থায় তোমার একটা ছবি তুলে দেই’?

সাবিনা এই কথা শুনে অনেকক্ষণ ধরে হেসেছিল, তেরেজা বোওলার হ্যাটটা নামিয়ে রাখে, তার ক্যামেরাটা হাতে নেয় এবং ছবি তোলা শুরু করে।

প্রায় এক ঘণ্টা ধরেই সে ছবি তোলায় মগ্ন থাকে, তারপর হঠাৎ করেই সে সাবিনাকে বলে, ‘তোমার কিছু নগ্ন ছবি তুললে কেমন হয়‘?

সাবিনা হাসে, ‘নগ্ন ছবি‘?

‘হ্যাঁ’, তেরেজা বলে; তার প্রস্তাবটাকে আরো সাহসী স্বরে বলে, ‘ন্যুড শট’।

‘তাহলে তো কিছু পান করতে হবে’, সাবিনা একটি মদের বোতল খুলতে খুলতে বলে।

তেরেজা অনুভব করে তার শরীর অসাড় হয়ে আসছে; হঠাৎ করে সে কোনো কথা বলতে পারেনা, ততক্ষণে সাবিনা মদের গ্লাস হাতে নিয়ে ঘরের মধ্যে হাটাহাটি করে তার দাদার গল্প বলে যাচ্ছিল, যিনি একটা ছোট শহরের মেয়র ছিলেন, সাবিনা যাকে কখনো দেখেনি, সাবিনার কাছ তার চিহ্ন হিসাবে তিনি শুধু রেখে গেছেন, তার এই বোওলার হ্যাটটা আর একটা ফটোগ্রাফ, যেখানে একটা উঁচু মঞ্চের উপর দাঁড়ানো শহরের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিদের দেখা যাচ্ছে, যাদের একজন সাবিনার দাদা। যদিও স্পষ্ট না মঞ্চের উপর দাড়িয়ে তারা কি করছেন, হতে পারে, তারা কোন শহরের কোন উৎসবের উদ্বোধন করছেন, বা কোন একজন সন্মানিত ব্যক্তির স্মৃতিসৌধ উন্মোচন করা হচ্ছে, যিনি একসময় এ ধরনের অনুষ্ঠানে বোওলার হ্যাট পরে উপস্থিত থাকতেন।

সাবিনা অনবরত বোওলার হ্যাট আর তার পিতামহ নিয়ে কথা বলে যাচ্ছিল, যতক্ষণ পর্যন্ত না তার তৃতীয় গ্লাস মদ্যপান শেষ না হয়, এরপর, ‘আমি এক্ষুনি আসছি‘ বলে সে বাথরুমে ঢুকে যায়। সাবিনা যখন বাথরুম থেকে বের হয় তার পরনে শুধু বাথ রোব, তেরেজা ক্যামেরা চোখের সামনে তোলে, সাবরিনা তার রোবের সামনের অংশটা খুলে ফেলে।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য