ফিরে দেখা এক জন্মকথা- ১২

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৪ ২২:১৭:৫৩

রাজা সরকার:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
৩৪
এখন রাত কত কে জানে! মা-বাবা-ভাইবোন শূন্য ঘরে আজ শুধু তারা। সন্ধ্যের পর পরেই রওনা হয়ে গেছেন এই বাড়ির সবচেয়ে পুরনো বাসিন্দা দুজন। তারা বট-বৃক্ষের মতই বাড়িটিকে জড়িয়ে রেখেছিলেন এতকাল। আজ তারা নেই। নিয়তির কান্না এখনও চলছে। নিয়তির কাছে এই কান্নার কোন ব্যাখ্যা নেই। বারবার বিদায় দৃশ্যটি তার মনে পড়ছে। দুটি বালক বালিকাসহ মলিন চারটি মানুষের  ছায়া জলপথে ক্রমশ: মিলিয়ে গেল। নাকি ভেসে গেল—কে জানে! বেঁচে থাকলে হয়তো দৃশ্যটি সবারই মনে পড়বে ক্ষণে ক্ষণে। কিন্তু মারা গেলে লক্ষকোটি বেদনাজারিত দৃশ্যের মত হয়তো এই দৃশ্যটিরও মৃত্যু ঘটবে। দিবাকর আজও বিমূঢ় প্রাণ। তার উপর কেউ জ্ঞানত ভরসা করেনা। তবু শ্বশুর শাশুড়ি বলে গেছেন সবাইকে দেখে শুনে রাখতে। বালিশে কান চেপেও নিয়তির ফোঁপানো থেকে এই   অন্ধকারে দিবাকর মুক্ত হতে পারছে না। তাদের সবারই বোধ হয় আবছা একটা কথা বার বার মনে হয় যে এ-জীবন তারা  কেউ চায়নি। কী জীবন তারা চেয়েছিল আজ আর কেউ মনেও করতে পারে না। শুধু চরম অনাকাঙ্ক্ষিত এক জীবনের ভার তাদের বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। কেন, তার কিছুই জানে না তারা। ঘুমের আগে জানে প্রাণ আছে। ঘুম ভাঙলে জানে প্রাণ আছে। তবে সপ্রাণ সকাল  আসবে কি না,  নিশ্চিত কেউ জানে না।

রবীন্দ্রবাবু তার এই বিলম্বিত দেশত্যাগ নিয়ে নৌকায় শুয়ে শুয়ে ভাবছিলেন। শেষ পর্যন্ত সকলের চাপ মেনে নিলেন। নিয়তিও মত দিল। ঠিক তার মায়ের সুরেই। এখন ভগবানের ইচ্ছা। সামনে কেমন দিন পাড়ি দিতে হবে জানেন না। তবু যাচ্ছেন। জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে এতবড় একটি কঠিন কাজের দায় মাথায় নিলেন। মোহনগঞ্জ কিছুটা দূরে রেখে তারা ডিঙ্গাপোতা হাওরে এসে যখন পড়লেন তখন রাত বেশ গভীর। বর্ষার বৃষ্টি থেমে গেছে বেশ কদিন। এখন জলে সরে যাবে। এই অঞ্চলে মূলত বৃষ্টি-অতিরিক্ত  জলটা আসে উত্তরের গারো পাহাড় থেকে। তারা সে দিকেই যাচ্ছে। মনসুর এই পথ অধীরের মতই চেনে। সে তার ভাতিজা কালামকে সহযোগী হিসেবে নিয়েছে। কালাম ভাল গুন টানতে পারে। উজানের দিকে যাওয়া। জায়গায় জায়গায় গুন টানতে হবে কাল থেকে। হাওর পার হলেই তারা মোহনগঞ্জ অঞ্চল পার হয়ে যাবে। রবীন্দ্রবাবু আগে কখনো এদিকে আসেন নি। ঈশ্বর চাইলে তিনি নিরাপদে বর্ডার পার হতে পারবেন।  এখন এই অবস্থায় ঈশ্বর ছাড়া সহায় আর কে আছে! মানুষ দানবের সঙ্গে পারবে কেন! দানবদের হাতে এখন দেশ। আমরা দানবদের  চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি মাত্র। ধরা পড়লে শেষ। এই রকম পরিণতি কত মানুষের হয়েছে। এই সব ভাবতে ভাবতে রবীন্দ্রবাবু শুয়ে ঠিক ঘুমোলেন না, আবার জেগেও থাকলেন না, মাঝামাঝি একটা তন্দ্রামত অবস্থা। সতর্ক কান। ভোরবেলা উনি টের পেলেন আশেপাশের গ্রামের কিছু মানুষও তাদের মতই চলেছেন নৌকা করে। খবরটা প্রথম মনসুরই দিল—কাহা দেখছুইননি---আমরার লাহান আরও নাও চলতাছে---মন লয় হেরাও বর্ডারের দিহেই যাইতাছে।

সুপ্রভার মন পড়ে আছে শ্রীমন্তপুরে। ভাবছেন নিয়তির কথা। ভরা-মাস মাইয়ার, কীভাবে কী করবো—কে জানে। বাড়ি খালি করে তিনিও চলে এলেন। এইসব টান উপেক্ষা করে তার বেরিয়ে আসাটা কি আরো জরুরী ছিল—ছিল কি না--এনিয়ে নিজেকে প্রশ্ন তিনি  কম করেন নি। এখনও করে  চলেছেন। তিনি এটা ভালো করেই জানেন যে তার এই সিদ্ধান্ত জগত-সংসারে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে চিরকাল। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি নিজেকে এই প্রশ্ন করলেও তার দ্বারা তিনি বিদ্ধ হন নি কখনোই। প্রশ্নতো তিনি নিজেকে বারবার করবেন, কারণ নিয়তিও তারই  সন্তান। তাকে ফেলে রেখেই যে আসতে হলো। মৃত্যুমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের কাছে বাস্তবতার ব্যাখ্যা সবসময়ই অচেনা লাগে। এক বিপদ থেকে আরেক বিপদে মেয়েকে নিয়ে আসার কথা ভাবতে পারেন নি। কিন্তু তিনি নিজে কি সত্যিই এই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসতে চেয়ে ছিলেন? কোন বাঁধা বা পিছুটান তাকে আটকাতে পারছিল না? না কি শ্রীমন্তপুর থেকে তার বেরিয়ে  আসাটা তার কাছে অন্য অনেককিছুর তুলনায় বেশি জরুরী হয়ে  পড়েছিল?

তিনি তার স্বামী-সংসার-সমাজ চিনেছেন প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর যাবত। সংসারে একজন নারীর অবস্থান কীরকম তাও জেনেছেন একান্ত ভাবে নিজের জীবন দিয়ে। তিনি লেখাপড়া না জানতে পারেন—দুনিয়ার অনেক বিষয়ে তার অজ্ঞতা থাকতে পারে—কিন্তু মন দিয়ে,  শরীর দিয়ে তিনি সংসারটা করেছেন এতদিন। এর মধ্যে কোন অযোগ্যতা তার কেউ দেখাতে পারেনি। কিন্তু কেউ এটা ভাবেনি যে সার্থকতার একটা  আবছা ধারণা তার মধ্যেও থাকতে পারে। তারওতো জীবন নিয়ে একটা ইচ্ছা অনিচ্ছার কথা থাকতে পারে। কৃষি নির্ভর গৃহস্থ বাড়ির শ্রম আর সন্তানের জন্ম দেয়ার মধ্যেই তার ইচ্ছা অনিচ্ছার সীমা রেখা শেষ হয়ে যায়না। তার যে দুই দেশে দুই সংসারের ডালপালা ছড়ানো—একজন মায়ের এই দ্বিধা বিভক্ত সত্ত্বার কী যন্ত্রণা, কে আর কবে বুঝেছে--কে আর কবে তাকে ছেলেদের কাছে নিয়ে যাবে—এই ভরসা দিয়েছে। না, দেয়নি কেউ। তাই একটা পর্যায়ে এসে স্বামীর মতের বিরুদ্ধে প্রায় নীরব বিদ্রোহ করে বসলেন। তার সংসার জীবনের শেষ পর্যায়ে, যখন গোটা দেশটাই একটা না-দেশের চেহারা নিতে শুরু করলো, যখন বেঁচে থাকার সংকট চোখের সামনেই ক্রমশ: ঘনীভূত হতে শুরু করলো, তখন তিনি এই সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে  স্বামীর মতের বিরুদ্ধে পর্যন্ত গেলেন। যা জীবনে কখনো করেন নি। কারণ তিনি যেন জানতে পারছিলেন যে এই সুযোগে যদি বেরোতে না পারেন তাহলে হয় সপরিবারে জীবন এখানেই শেষ হতে পারে অথবা দেশ কোনদিন শান্ত হলে সংসারের ভার যেমন বয়ে নিয়ে চলছিলেন, তেমনই বয়ে চলতে হবে। দেশান্তরী সন্তানদের মুখ আর কখনো দেখতে পারবেন না।

৩৫
সকাল থেকেই  গন্ধটা বাতাসে ভাসছিল। অনেকক্ষণ থেকেই একটা গা গোলানো একটা ভাব। ছৈএর ভেতর থেকেই প্রথম শোনা গেল কেউ সশব্দে বমি করছে। রবীন্দ্রবাবু মুখ বের করে দেখলেন কালাম পাটাতনের উপর বসে ওয়াক ওয়াক করে যাচ্ছে। মনসুরের নাকে মুখে গামছাটা বাঁধা। তবু কোন মতে বললো—কাহা ভিতরে থাহুইন—বাইরোন্যাযে---জাগাডা ভালা না। ততক্ষণে রবীন্দ্রবাবুর চোখে পড়ে গেছে অন্তত দুটো লাশ। ছোট ছেলে সুবলও ততক্ষণে বমি করে ফেললো। নৌকার সামনের দিকে গিয়ে ঝুঁকে বমি করতে গিয়ে ‘মাগো’বলে ভয়ানক এক চীৎকার করে উঠলো সে। তাড়াতাড়ি তাকে ধরে ছৈয়ের ভেতরে নিয়ে আসা হলো। জায়গাটা পার হয়ে যাওয়ার জন্য মনসুর আপ্রাণ নৌকা  বাইছে। আসলে বর্ষায় খাল বিল নদী একাকার হলে কচুরিপানাও স্থানচ্যুত হয়ে ভেসে যায় বা এখানে ওখানে জমে থাকে । খাল বা নদী ভরাট হয়ে গেলে দেখা যায় মূল একটা স্রোত খাল বা নদীর রেখা ধরেই চলছে। আশেপাশে প্লাবিত এলাকার জল মোটামুটি স্থির থাকে। সেই খানেই জায়গায় জায়গায় কচুরিপানার জমায়েত। স্রোতের উলটা দিকে যেহেতু যাওয়া, মনসুর তাই অপেক্ষাকৃত স্থির জলের পথটাই বেছে নিয়ে ছিল। কিন্তু সেখানেই জমে আছে কচুরিপানার আড়ালে আড়ালে অনেক লাশ। তাদের নৌকা একসময় ধাক্কাও খেয়েছে লাশের সঙ্গে। অভিজ্ঞ মাঝি সে সব সওয়ারী কাউকে বলেনি। কিন্তু কালাম দেখে ফেলেছে।  বোধহয় প্রথম দেখা—তাই বমি করে ফেলেছে। এখন মনসুর আবার মূল নদী-পথেই ফিরে এলো। কষ্ট হলেও স্রোতের উলটা দিকেই নৌকা টানছে। ওর ধারনা এই সব লাশ কিছুটা পুরনো।  

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক যাওয়ার পর গন্ধটা কমে এলো। মাঝে তারানগর বাজারের কাছে এক বাড়ি থেকে খাওয়ার জল নেয়া হলো দুই কলশী।কিন্তু খাওয়া আর বিশ্রামের জন্য নৌকা থামলো আরো এগিয়ে। জায়গাটা রবীন্দ্রবাবুর চেনার প্রশ্ন নেই—মনসুর চেনে। তারানগর বাজার ছাড়িয়ে অনেকটা এগিয়ে ইন্ডিয়ার বর্ডারের কাছাকাছি। মনসুরের কথা অনুযায়ী জায়গাটা মুক্তিযোদ্ধাদের আওতায়। কাছাকাছি পাকিস্তানী মিলিটারির কোন ক্যাম্প নেই। তবে জলপথে হামলা করতে মাঝে মাঝে আসে। মনসুর কীভাবে এত সব জানে রবীন্দ্রবাবুর জানা নেই। জানেন শুধু এই পথে মনসুর আগে আরো বেশ ক’বার এসেছে। তবে তিনি মনসুরের সব কথাই বিশ্বাস করেন। বর্ষার জল চারদিকে। নদী খাল বিল হাওর সব একাকার। খুব  কাছাকাছি ভারতের গারো পাহাড় চোখে পড়ছে। তারা যেখানে থেমে আছে তার খুব কাছাকাছি জনপদ দেখা যাচ্ছে না। তবে গাছগাছালি ভরা একটা ভূ-খণ্ড পাওয়া গেছে। কাছাকাছি আরো কয়েকটা নৌকাও থেমে আছে। সবই ব্যাপারি নৌকা বা মাছ মারার নৌকা মনে হলেও কয়েকটি মনে হচ্ছে তাদের মতই বর্ডার পার হওয়ার উদ্দেশ্যে আসা নৌকা। আসলে এটা সীমান্ত পার হওয়ার আগের একটা বিশ্রাম করার জায়গা। মনসুর নৌকা বেঁধে হাঁক দিল--- কাহিমা রান্ধা বারা করুইন---বৈকালের আগে যাওন যাইত না। বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তাদের ভাত খাওয়া হয়নি। চিড়ে মুড়ি খেয়েই চলছিল। সুপ্রভা তোলা উনুনে লাকড়ি দিয়ে রান্না চাপিয়ে দিলেন। রান্না বলতে ডাল আর ভাত।

মনসুর আর তার ভাতিজা খাওয়ার পর কিছুটা ঘুমিয়েই নিল। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার মুখে তারা আবার নৌকা ছাড়ার প্রস্তুতি নিল। কিন্তু ঐ সময়ই হঠাৎ কানে এলো বেশ গুরুগম্ভীর গুলির আওয়াজ। উৎকণ্ঠিত সবাইকে মনসুর আশ্বস্ত করলো যে শব্দটা অনেক দূর থেকে আসছে। ওইডা বন্দুক না, কামানের আওয়াজ---যত বর্ডারের দিকে যাইবাইন তত হুনবাইন--ভয়ের কিছু নাই— ।  

জলাজমি ছেড়ে একসময় দেখা গেল একটা নদী ধরে তাদের নৌকা এগোচ্ছে। রাত হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারে একদিকে পাহাড়, একদিকে সমতল। জায়গাটা কোথায়, তার উত্তরে মনসুর জানালো---কাহা এইমাত্র বর্ডার পার অইলাম—আর এট্টু পরেই আফনেরার লামতে অইব। এইখানে বর্ডার বোঝা মুশকিল। তবু কথাটা শুনে রবীন্দ্রবাবুর বুক থেকে যেন পাথর সরে গেল। চোখে পড়তে লাগলো নদীর পাড়ে পাহাড়ের দিকটায় অজস্র বাতি জোনাকির মত জ্বলছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ঘাটে মনসুর তার নৌকা লাগালো। ঘাটে নৌকা আর মানুষের বেজায় ভিড়। একটা বাজারর মত জায়গা। নাম শোনা গেল এলং বাজার। রাতে এখানে নেমে কোথায় কী আছে  বোঝা মুশকিল হবে ।  ঠিক হলো মনসুরের নৌকা রাতে থাকবে । রবীন্দ্রবাবুরা রাতটা নৌকাতেই কাটাবেন। ভোরবেলা  তারা নেমে যাবেন এবং মনসুরও ফিরে যাবে। কেরোসিনের কুপি ধরিয়ে রাতে তাই সুপ্রভা আবার সবার জন্য রান্না করলেন। বহুদিন পর জলে ভাসা এক নৌকায় বসে তারা বেঁচে থাকাটা নতুন করে অনুভব করলেন। নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তাও বললেন। খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও আশ্চর্য, রবীন্দ্রবাবু আর সুপ্রভা ঘুমোলেন না। তাদের চোখে আর ঘুম এলো না। ধীরে ধীরে মানুষের কোলাহল থেমে গিয়ে জায়গাটা নীরব হয়ে গেল। নির্ঘুম দু’জন মানুষ নৌকার নিচে জলস্রোতের মৃদু শব্দ আর মাঝে মাঝে দূরাগত কামান গর্জনের ভেতর নিজেদের ছড়িয়ে দিয়ে খান খান হয়ে পড়া স্তব্ধতার ভেতর ভাসতে থাকলেন।  

৩৬
এটা ইন্ডিয়া। হউক নদীর এপার ওপার—তবু তারা এখন ইন্ডিয়ায়। অনেকদিন  না-দেখা ছেলেদের এবার দেখতে পাবেন সুপ্রভা।  আশায় বুক বেঁধে কত মানুষইতো ভেসে গেছে। সুপ্রভা আশা করতে চিরদিনই ভয়ও পেয়েছেন সঙ্গে। কিন্তু আজ ভোরবেলা তার মুখ  একটু উজ্জ্বল মনে হচ্ছে । কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক। তাদের এই এলং বাজারে নামিয়ে দিয়ে মনসুররা ফিরে গেছে। ভাড়ার অতিরিক্ত আরো দশটাকা মনসুরের হাতে দিয়ে দিলেন রবীন্দ্রবাবু। বলে দিলেন পৌঁছেই বাড়িতে এবং সালাউদ্দিনকে যেন তাদের পৌঁছানোর খবরটা দিয়ে দেয় । নৌকা থেকে নামার সময় রবীন্দ্রবাবু ওনার অভ্যস্ত পোশাক ধুতি আর পাঞ্জাবি পরে নিলেন। পা’এ দিলেন অনেকদিনের অব্যবহৃত একজোড়া পাম্পশু। মালপত্র সমেত বাজারের এককোণে দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে সুপ্রভা দাঁড়িয়ে। এত সকালে বাজার তখনও খোলেনি। রবীন্দ্র বাবু একটু খোঁজ খবর করতে গেলেন এদিক ওদিক। স্থানীয় মানুষ এখানে চোখে পড়ছেনা। তবে যা চোখে পড়ছে সবইতো ওপারের মানুষ দেখি--চারদিকে তাকিয়ে সুপ্রভা অবাক হয়ে গেলেন যে উঁচু নিচু রাস্তার বাঁকে বাঁকে ছোট ছোট ঘর—তাতে প্রচুর মানুষ। সকালেই ঘাটে নৌকা আর মানুষের ভিড় জমছে—মানুষ পারাপারও হচ্ছে। ওপারের পাহাড়টা বেশ উঁচু। তারা যেখানে দাঁড়িয়ে সেটা ততোটা নয়। হঠাৎ একটু ফ্যাস ফ্যাসে চেনা গলায় ‘কাকিমা’ডাক শুনে চমকে সামনে তাকিয়ে দেখেন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে আমিত্তিপুরের আব্দুল গনি। আমিত্তিপুরের যে ক’জন নিখোঁজ ছিল গনি তাদের অন্যতম। কাছে আসতে আসতে গনি শুধু বললো---তাইলে আইলেন শেষপর্যন্ত!

কিছুক্ষণ পর রবীন্দ্রবাবু ফিরে এদিক ওদিক তাকিয়ে যখন সবাইকে খুঁজতে লাগলেন তখনই শুনলেন—কাহা এইদিকে এইদিকে--। দেখলেন একটি চা’এর দোকানের সামনে সকলেই বসা। সঙ্গে গনি, তার একসময়কার ছাত্র। শালপাতায় করে বাচ্চারা পুরি খাচ্ছে। গনিই এনে দিয়েছে তাদের ক্যাম্প থেকে। এতক্ষণ ঘুরে কোন দিশা না পেয়ে রবীন্দ্রবাবু যখন একটু চিন্তিত তখনই গনির সাক্ষাতে বহুকাল পর রবীন্দ্রবাবুর মুখে এক চিলতে হাসি দেখা গেল। এতক্ষণে দোকানদার চা তৈরি করে ফেলেছে। তারা তিনজনই চা নিলেন।

গনি আমিত্তিপুরের খবর নিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সকলের কথা জিজ্ঞেস করলো। আকবর আলির কথা শুনে কষ্ট পেল। ঢাকায় অবস্থান কালে গনি এই আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পড়ে। একসময় ঢাকায় থাকা বিপজ্জনক হয়ে উঠলে কিছুদিনের অন্য আমিত্তিপুরে আত্মগোপন করেছিল। তখন আমিত্তিপুর বা ঐ অঞ্চলে এই আন্দোলন সম্পর্কে কেউ তেমন ওয়াকিবহাল ছিল না। বিশেষ প্রয়োজনে গনি  একসময় আমিত্তিপুর ত্যাগ করে। তার বাড়ির মানুষেরা কেউ কেউ থাকলেও মা বাবা ভাইবোনদের সে আমিত্তিপুর ত্যাগ করার পরপরই অন্যত্র সরিয়ে দেয়। ইশকুলের উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই গনি গ্রাম ছাড়া। ফলে উপদ্রুত সময়ে তার খোঁজ কেউ তেমন নেয়নি। তবে নিজের কাজের সূত্রে সে আমিত্তিপুর বা শ্রীমন্তপুরের খবর ঠিকই রাখতো। আকবর আলির খবরে ব্যথিত হলেও তার ঘটনা সে সবটাই প্রায় জানে। কিন্তু কোন কিছুই প্রকাশ্যে বলা সম্ভব নয় যতক্ষণ না বিজয় সুনিশ্চিত হচ্ছে।  

মুক্তিযোদ্ধাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বেস ক্যাম্প এই এলংবাজারে। যার দায়িত্বে গনি এসেছে কিছুদিন আগে। এ-সবকিছু রবীন্দ্র বাবুর জানার কথা নয়। তবু তিনি ছেলেটির সংস্পর্শে এসে কিছুটা অবাক বোধ করলেন। সেদিনকার  ছেলেটি কত বড় কাজের দায়িত্ব নিয়ে আছে! বর্ডার পার হওয়ার পর দুশ্চিন্তার বোঝাটা গনি অনেকটাই হাল্কা করে দিল। বলল—কাহা, এই জায়গাটায় থাকা যদিও নিরাপদ নয় আপনাদের পক্ষে—তবে আজকের দিনডা থাহেন—কাইল আফনেরারে বাঘমারা পাঠায়া দিব—ঐ খানেই শরণার্থীরা সব থাহে। একদিনের জন্য গনি একটা ঘরের বন্দোবস্ত করে দিল। অল্পবয়সী দুটো ছেলেকে পাঠিয়ে মালপত্র টানাটানি এবং গোছগাছও  করিয়ে দিল। গনির হেফাজতে অনেকদিন পর একটা নিশিন্ত আশ্রয় পেয়ে রবীন্দ্রবাবু যেন কিছুটা উজ্জীবিত হলেন। ঠিক হলো যে কাল বাঘমারা পৌঁছে বড় ছেলেকে একটা টেলিগ্রাম করবেন তাদের আসার সংবাদ দিয়ে।

পরদিন সকালে বাঘমারা পৌঁছেও তাদের বাঘমারার অনেকটা বাইরে থেকে যেতে হলো। ভয়ানক ভিড়। তাদের শরীক বা গ্রামের লোকের সন্ধান প্রথম দিন পেলেনই না। এখানেও গনির পরোক্ষ সাহায্যে পাহাড়ের গায়ে একটা ঘর কোন মতে পেলেন। এসব ঘর প্রথম দিকে স্থানীয় লোকেরা ভাড়া দেয়ার জন্য তৈরি করেছিল। সরকারি ব্যবস্থার চেয়ে কিছুটা ভাল। কেউ বেশিদিন এই সব ঘরে থাকে না। কেউ নিজের লোকজনের কাছে দেশের ভেতরের দিকে চলে যায়। কেউ চলে যায় সরকারী আশ্রয় শিবিরে। ঘরে ঢুকে প্রথম কাজ টেলিগ্রাম করা। তার জন্য প্রায় একটা বেলা রবীন্দ্রবাবুর ঘোরাঘুরি করে কেটে গেল। শেষে একটা ডাকঘর খুঁজে পেয়ে টেলিগ্রাম করলেন এবং একটা সংক্ষিপ্ত চিঠিও লিখলেন। ঘরে ফিরে দেখলেন সুপ্রভা কিছুটা গুছিয়ে ফেলেছেন। সামান্য রান্নাও করে ফেলেছেন। যে কাজটা বাকি রয়ে গেল তা হলো শরণার্থী কেন্দ্রে গিয়ে নাম লেখানো এবং রেশন তোলা। আজ আর তা সম্ভব না। কালকের জন্য সেই সব কাজ রেখে দিলেন। সন্ধ্যা থেকে এখানেও শোনা যাচ্ছে কামান গর্জনের নির্ঘোষ। ঘরে কেরোসিন না থাকার কারণে তারা ঘরে আর বাতি  জ্বালালেননা। অন্ধকার হওয়ার পর তারা শুয়েও পড়লেন।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য