বেঁচে থাকার দুঃসহ নির্ভারতা, দ্বিতীয় পর্ব ২২-২৩

 প্রকাশিত: ২০১৬-০২-২৭ ০১:০৪:১৮

কাজী মাহবুব হাসান:

[পূর্ব প্রকাশের পর...]
২২
তেরেজার জন্য ক্যামেরা একই সাথে যান্ত্রিক চোখ, যা দিয়ে সে টমাসের রক্ষিতাকে পর্যবেক্ষণ করে এবং একটি পর্দা, যা পেছনে সে তার মুখটাকে ঢেকে রাখে সাবিনার কাছ থেকে।

সাবিনার বেশ খানিকটা সময় লাগে পরনের কাপড় থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসার জন্য। সে যতটুকু  আশা করেছিল পরিস্থিতিটা তেরেজার জন্য আরো বেশী কঠিন প্রমাণিত হয়েছিল;  বেশ কয়েক মিনিট ছবি তোলার জন্য নানা ভঙ্গী  দেবার পর, সাবিনা তেরেজার কাছে গিয়ে বললো, ‘এখন আমার পালা তোমার ছবি তুলবো; ‘সব কাপড় খোল’!

টমাসের কাছ থেকে  সাবিনা এই নির্দেশটা এত বার শুনেছে যে, ‘সব কাপড় খোল’, যে তার স্মৃতিতে এটি গেঁথে আছে। এভাবেই টমাসের প্রেমিকা টমাসের স্ত্রীকে এইমাত্র টমাসের নির্দেশটাই দিল। দুই রমণী একটি ম্যাজিক শব্দে বাধা পড়লো। এটাই টমাসের একটা পদ্ধতি, হঠাৎ করেই কোনো নারীর সাথে চলমান সাদামাটা কথোপকথনকে একটি যৌনউদ্দীপক পরিস্থিতিতে রূপান্তরিত করার জন্য। কোনো হালকা আদর, এলোমেলো প্রশংসা, বা কোনো ধরনের অনুরোধ না করেই সে একটা নির্দেশ ছুড়ে দেয়, খুব অকস্মাৎ, কেউ যখন আশা করেনা, মৃদু অথচ দৃঢ় স্বরে এবং কর্তৃত্বের সাথে এবং অবশ্যই দূর থেকে, এই সময়টায় যে নারীকে সে নির্দেশ দিচ্ছে তাকে স্পর্শ করেনা টমাস।

তেরেজার সাথেও মাঝে মাঝে এর প্রয়োগ করেছে টমাস এবং যদিও সেটা খুবই কোমলভাবে, যেন ফিস ফিস করে, তবু সেটা নির্দেশ, তার তেরেজার জন্য এই আদেশটা মান্য করার সময় যৌন উত্তেজিত হয়ে ওঠার ব্যাপারটাতেও কোন ব্যতিক্রম হয়নি। এখন সেই শব্দটাই শুনে সেটা তার মান্য করতে আরো তীব্র ইচ্ছা হয়, কারণ এক আগন্তুকের আদেশ মান্য এমনিতেই অন্যরকম পাগলামি, আর পাগলামিটা আরো বেশী তাকে নেশাগ্রস্থ করে কারণ এই ক্ষেত্রে  আদেশটা এসেছে কোন পুরুষের কাছ থেকে না, একজন নারী কাছ থেকে।

সাবিনা তার কাছ থেকে ক্যামেরাটা নিজের হাতে নেয়, তেরেজা তার কাপড়গুলো খুলতে শুরু করে। সাবিনার সামনে নিরস্ত্র এবং নগ্ন সে দাড়িয়ে আছে। আক্ষরিক অর্থে ‘নিরস্ত্র’ :  তেরেজা এখন তার সেই যন্ত্রটি থেকে বঞ্চিত, যেটা সে এতক্ষণ ব্যবহার করছিল তার মুখটা আড়াল আর সাবিনার দিকে একটি অস্ত্র হিসাবে নিশানা করার জন্য। সে এখন পুরোপুরি টমাসের রক্ষিতার দয়ার উপর ভর করে আছে। এই সুন্দর আত্মসমর্পণ তেরেজাকেও মত্ত করে। সে কামনা করে সাবিনার মুখোমুখি নগ্ন হয়ে দাঁড়ানো এই মুহূর্তগুলো যেন কখনোই শেষ হবে না।

আমার মনে হয় সাবিনারও এমনটা মনে হয়েছিল, সেও পরিস্থিতিটার একটি অদ্ভুত মোহে আচ্ছন্ন থাকার অনুভূতিটা অনুভব করেছিল: তার প্রেমিকের স্ত্রী তার সামনে দাড়িয়ে, অনুগত, ভীত, খানিকটা সন্ত্রস্ত। কিন্তু দুই তিনবার শাটারে চাপ দেবার পরই, যেন পরিস্থিতির সেই মুহূর্তের যাদুতে ভীত হয়ে এবং তার থেকে মুক্তি পাবার তীব্র ইচ্ছায়, বেশ জোরে সাবিনা হেসে উঠে।

তেরেজাও তার মত হেসে ওঠে এবং দুজনেই কাপড় পরতে শুরু করে।

২৩
রুশ সাম্রাজ্যের এর আগের সব অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছিল গোপন ছায়ার অন্তরালে; এক মিলিয়ন লিথুয়ানিয়াবাসীদের জোরপূর্বক দেশান্তর, শত হাজার পোলদের হত্যা, ক্রিমিয়ার তাতারদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, এইসব কিছু অবশিষ্ট রয়ে গেছে শুধু আমাদের স্মৃতিতে, কিন্তু কোনো ফটোগ্রাফি বা দৃশ্যমান রেকর্ড এর অস্তিত্ব নেই; সে কারণে আগে বা পরে কোনো একসময় তারা দাবী করতে পারে, এসব মিথ্যা, বানোয়াট। ১৯৬৮ সালের চেকোস্লোভাকিয়ায় তাদের আগ্রাসন কিন্তু তেমন নয়, সারা পৃথিবী জুড়ে নানা আর্কাইভে সেই ঘটনার স্থির এবং চলচ্চিত্র সংরক্ষিত আছে।

চেক ফটোগ্রাফার এবং ক্যামেরাম্যানরা খুবই সচেতন ছিল, তারা জানতেন যে, রুশ আগ্রাসনের পর একটাই কাজ অবশিষ্ট আছে যা শুধুমাত্র তারাই ভালোভাবে করতে পারবেন: ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য এই সন্ত্রাসের চেহারাটিকে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করে যাওয়া। টানা সাত দিন, তেরেজা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছে, নানা  বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রুশ সেনা ও তাদের অফিসারদের ছবি তোলার জন্য। রুশদের জানা ছিলনা তারা কি করবে এমন পরিস্থিতিতে। তারা খুব ভালোভাবে নির্দেশিত ছিল, কি করতে হবে, যদি কেউ তাদের লক্ষ্য করে বন্দুক তোলে, গুলি বা পাথর ছোড়ে, কিন্তু কোন নির্দেশই তারা পায়নি, কি করতে হবে যদি কেউ তাদের দিকে ক্যামেরার লেন্স তাক করে।

রোল এর পর রোল ফিল্ম সে ছবি তুলেছিল, এর প্রায় অর্ধেকটা, ডেভেলপ না করেই সে বিদেশী সাংবাদিকদের হাতে তুলে দিয়েছিল (তখনও চেক সীমানা বন্ধ হয়নি, এবং রিপোর্টাররা যারা সীমানা তখন অতিক্রম করছে, তারা এই ঘটনার যে কোনো ধরনের ডকুমেন্ট পেলেই কৃতজ্ঞ ছিল); পশ্চিমা প্রেসে সে সময় তার তোলা অনেক ছবিও ছাপা হয়েছিল। সেগুলো ছিল রুশ ট্যাঙ্কের ছবি, ভয় দেখানো মুষ্টিবদ্ধ হাত, ধ্বংস হওয়া বাড়িঘর, রক্তাক্ত লাল সাদা নীল চেক পতাকায় ঢাকা মৃতদেহ, মটোর সাইকেলে করে সজোরে ট্যাঙ্কের পাশ দিয়ে যাওয়া লম্বা লাঠিতে লাগানো পতাকা সহ চেক তরুণদের ছবি, অবিশ্বাস্য রকম ছোট স্কার্ট পরা চেক তরুণীরা, যারা ভীষণভাবে যৌন ক্ষুধার্ত রুশ সেনাদের ক্ষেপিয়ে তুলছিল, রাস্তা ঘাটে যে কাউকে তাদের সামনে চুমু খেয়ে।

আমি যেমনটা আগে বলেছিলাম, রুশ আগ্রাসন শুধু একটা ট্রাজেডি ছিলনা, এটা ছিল চেকদের চূড়ান্ত ঘৃণা প্রকাশের একটা কার্নিভাল (এবং এখন যা ব্যাখ্যাতীত), যা পূর্ণ ছিল অদ্ভুত উল্লাসময়তায়।
[চলবে...]

আপনার মন্তব্য